সিলেটে ছাত্রলীগের উপর হামলা ঢাবিতে প্রতিশোধ

প্রকাশিত: ২৪ অগাস্ট, ২০১৭ ০৭:২০:১৪ || পরিবর্তিত: ২৪ অগাস্ট, ২০১৭ ০৭:২০:১৪

সিলেটে ছাত্রলীগের উপর হামলা ঢাবিতে প্রতিশোধ

গত সাত আগস্ট সিলেট ছাত্রলীগ নেতা শাহীন আহমদ ও আবুল কালাম আসিফের উপর বর্বরোচিত হামলার পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগ অমানবিক নির্যাতন চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।সিলেটের ওই হামলা শিবির চালিয়েছে বলে অভিযোগ করে ছাত্রলীগ।এর পর থেকেই শিবির ধরার নামে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ঘেটে কে কোথায় লাইক দিয়েছে, কমেন্টস করেছে তার ভিত্তিতে এসব নির্যাতন চালানো হচ্ছে বলে বিশ্ববিদ্যালয়টির সূত্রে জানা গেছে।

তবে হতাহতদের মধ্যে নিরীহ শিক্ষার্থীরসহ নিজেদের দলের নেতা কর্মীরাই বেশি বলে জানাচ্ছে ছাত্র সংগঠনটিরই অন্য অংশ।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,সিলেটের ঘটনার পরবর্তী এক সপ্তাহেই শিক্ষার্থী নির্যাতনের এসব ঘটনার বেশিরভাগই ঘটেছে।হল ছাড়া করা হয়েছে বিভিন্ন ছাত্রবাসের প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থীকে।আর শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে ৩৫ জনকে।এদের মধ্যে প্রায় ২০ জনের অবস্থা বেশ গুরুতর।কমপক্ষে দুইজনের হাটুর গিরা ভেঙে দেয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে।আর এসব নির্যাতন করা হয়েছে বিভিন্ন হলের প্রায় ২২টি কক্ষে।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে নানা অজুহাতে এসব রুমগুলোকে টর্সার সেল (নির্যাতন কেন্দ্র) হিসেবে ব্যবহার করে আসছে ছাত্রলীগ।বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ নির্যাতনের এসব ঘটনা সম্পর্কে অবগত হলেও তা থামাতে কার্যত কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলেও অভিযোগ উঠেছে।আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় এসব ঘটনাকে ছাত্রলীগ ক্যাম্পাস থেকে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির মূলোৎপাটনের কথা বললেও নির্যাতনের শিকারদের বেশিরভাগই সাধারণ শিক্ষার্থী বলে জানা গেছে।আবার নির্যাতীতদের মধ্যে ছাত্রলীগের পদধারী একাধিক নেতাও রয়েছে।

মূলত, নিজেদের দলের প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে শিবির অপবাদকে কাজে লাগিয়ে এসব নির্যাতন করে চলাচ্ছে।এ অবস্থায় কে কখন কিভাবে শিবির অপবাদের শিকার হয় তা নিয়ে হলে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যেও অনেক গ্রুপ, উপ গ্রুপ ও প্রতিগ্রুপ রয়েছে।এসব গ্রুপের মধ্যকার বিরোধ বিভিন্ন সময়ে হিংস্রতায় রূপ নেয়ারও অনেক নজির রয়েছে।অনেক সময়ে নিজ দলের প্রতিদ্বীদেরকে বিতাড়িত করে নিজের অবস্থানকে শক্তিশালী করার প্রবণতা রয়েছে সংগঠনটির নেতাদের মধ্যে।

আর এ জন্য শিবির অপবাদ সবচেয়ে বেশি কার্যকরি। প্রতিপক্ষ বা তার কর্মীরা জামায়াত,শিবির, বিএনপি বা হেফাজতে ইসলামের কোন ফেসবুক গ্রুপ বা অন্য কোন সামাজিক মাধ্যমে লাইক-কমেন্টস করেছে কিনা বা এ জাতীয় কোন ব্যাক্তি তাদের ফ্রেন্ডলিস্টে আছে কিনা এমন সব তথ্যের উপর ভিত্তি করে পূর্বেও বিভিন্ন সময়ে সাধারণ শিক্ষার্থী বা নিজ দলের প্রতিদ্বীদের মারধর করেছে ছাত্র সংগঠনটির নেতারা।গত কয়েক দিনে বিভিন্ন হল থেকে যাদেরকে নির্যাতন করে বের করা হয়েছে তাদেরও প্রায় সকলকেই বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে লাইক পোস্ট দেয়াকে কারণ হিসেবে সামনে এনে নির্যাতন করা হয়েছে বলে হলগুলোর সূত্র জানাচ্ছে।

তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে দক্ষ এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিজের অজান্তেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গ্রুপে অ্যাড হয়ে যাওয়া অত্যান্ত স্বাভাবিক একটি ঘটনা।নিজের ফ্রেন্ড লিস্ট থেকে যে কেউ একজনকে সহজেই তার অনুমতি ছাড়াই একটি গ্রুপে অ্যাড করে নিতে পারে।আবার একজন যখন এসব মাধ্যম ব্যবহার করে তখন কে পোস্ট দিয়েছে তা না দেখেও ভাল পোস্ট পেলে নিজের অবচেতন মনে লাইক দিয়ে ফেলাও মোটেও অস্বাভাবিক নয়।ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কে কোথায় লাইক দিয়েছে,অ্যাড হয়েছে বা কমেন্টস করেছে এর ভিত্তিতে শিবির অপবাদ দেয়াটা যুক্তি সংগত নয়।

গত কয়েকদিনে আক্রান্তদের মধ্যে ছাত্রলীগের নিজেদের দলের নেতা, কর্মী বা প্রতিদ্বন্দ্বী নেতার কর্মীদের সংখ্যাই বেশি বলে জানা গেছে।বিভিন্ন সূত্রের খবরে বলা হচ্ছে, গত সাত তারিখে সিলেটের ওই ঘটনার পর ছাত্রলীগের কেন্দ্র ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা থেকে হলগুলোতে ছাত্র শিবির আছে কিনা তা চিহ্নিত করে বের করা নির্দেশ দেয়া হয়।আর এটাকে একটা সুযোগ হিসেবে নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী বা তাদের কর্মীদেরকে শিবির অপবাদ দিয়ে নির্যাতন করে হল ছাড়া করা শুরু করে বিভিন্ন গ্রুপ ও উপ গ্রুপের নেতারা।যা থেকে রেহাই পাচ্ছে না ছাত্রলীগের পোস্টধারী নেতারাও।

গত ৮ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ জিয়াউর রহমান হলের আবাসিক  শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়টির সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমানুল্লাহকে ছাত্র শিবির অপবাদ দিয়ে বেধড়ক মারধোর করে হলটির সেক্রেটারি গ্রুপের কয়েকজন।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আমানুল্লাহ ক্যাম্পাস ছাত্রলীগের নেতা হলেও ভবিষ্যতে হল ছাত্রলীগের নেতাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে বলে পূর্বেই আভাস পেয়ে তার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রপাগান্ডা চালাতে শুরু করে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী।

এরই এক পর্যায়ে কেন্দ্রের নেতারা শিবির খুজে বের করার আদেশ জারি করলে তার ফেসবুক চেক করে এক শিবির নেতার ফেসবুক পেজে লাইক দেয়ার তথ্য পায় প্রতিদদ্বী গ্রুপের কয়েকজন।তার ভিত্তিতে পরে তাকে বেধড়ক পিটিয়ে পায়ের হাটুর মালা ভেঙে দেয়া হয়েছে।আমানুল্লাহর পিতা একজন সরকারি কর্মকর্তা। তার পরিবারের সদস্যরা স্থানীয়ভাবে আওমীলীগ পন্থী বলেও জানা গেছে।১৩ই আগস্ট একই হলের মনিরুল ইসলাম নামের এক ছাত্রলীগ কর্মীকেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুই বছর আগের একটি পোস্ট নিয়ে শিবির অপবাদ দেয়া হয়।

তাকেও ওই রাতে মেরে গুরুতর যখম করা হয়। পরে ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগের হস্তক্ষেপে তাকে আবার হলে যেতে দিতে বাধ্য হয় মারধোর করা ওইসব কর্মীরা।মনিরুলের গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার শারদা ইউনিয়নে। সেখানকার চেয়ারম্যান ও চারঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসানুজ্জামান মধুর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, মনিরুলের বাড়ির সকলেই তার দলের (আওয়ামী লীগের) রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

বিশ্ববিদ্যালয়টির বঙ্গবন্ধু হলের ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির এক সদস্য হারুনুর রশিদ হিমেল গত ১৩ তারিখে এবং ওই একই হলের আরো এক শিক্ষার্থী এবং ইসলামের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানাও একই অভিযোগে ১০ তারিখে নির্যাতনের শিকার হন।এছাড়া অন্যান্য হলেও ছাত্রলীগের কর্মীদেরকে মেরে বের করার একাধিক ঘটনা ঘটেছে।নির্যাতনে শিকার ছাত্রলীগের কয়েক জন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিবেদককে জানিয়েছেন,তারা দলীয় রাজনীতির নোংরা গ্রুপিংয়ের শিকার হয়েছেন।

প্রতিপক্ষ সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে মিথ্যা অভিযোগে তাদেরকে টার্গেট করেছে।এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেসব গ্রুপে লাইক কমেন্টের কথা বলা হচ্ছে তাও বানোয়াট বলে দাবি তাদের।নির্যাতনের শিকার বিভিন্ন হলের ছাত্রদের মধ্যে স্যার এ এফ রহমানহলের জিল্লুর রহমান, মাহবুব, বঙ্গবন্ধু হলের আরিফুল ইসলাম, তুহিন, সুমন,হারুনুর রশীদ, বিজয় একাত্তর হলের ভ‚ইয়া মোহাম্মদ কাউসার, হাজী মুহম্মদ মহসিন হলের গফফার, বাপ্পি, ইরফান, মাশরুর, মেহেদী, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের মুজাহিদুল ইসলাম, যুবায়ের আল বানী, সোহেল রানা, আমানুল্লাহ, সূর্যসেন হলের রাকিব, হাসান,আজাদ, জিয়া হলের আমানুল্লাহ, শহীদুল্লাহ, মেহেদী, সজীব, মনিরুলের নাম উল্লেখযোগ্য।এরা সকলেই ছাত্রলীগের নেতাদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

এর বাইরে অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা তাদের নাম সংবাদ মাধ্যমে না দেয়ার জন্য বলে।শিক্ষার্থীদেরকে নির্যাতনে অংশ নেয়া ছাত্রলীগের নেতাদের মধ্যে স্যার এ এফ রহমান হলের হারুন, রাজু, সাগর, আপেল, রাজন, জিহাদ, বঙ্গবন্ধু হলের সজিব, সোহাগ,সূর্য একাত্তর হলের ফকির রাসেল, মহসিন হলের সাইফুল, জহির, সানী, শাহাজালাল, সৈয়দ আশিকুর, এস এম হলের আলম, আরিফ, মিলন, কামাল, ওয়াসিম, ফাহিম, সিজান, নওসেন,মাসুম, সায়েম, তারেক, প্রান্ত, মিজান, ইমন, মিশাদ, রিয়াজ, সজীব, জিয়া হলে ইমরুল কায়েস, মাহমুদুল, হাবিব, সামি, শান্ত, নাসির, আবির উল্লেখযোগ্য।শিক্ষার্থী নির্যাতনের এসব ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আবিদ আল হাসান প্রতিবেদককে বলেন, ‘স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি যেখানেই থাক না কেন খুজে করা হবে।

এবং শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।তবে নিজের দলের ও সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকে নির্যাতনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটাকে যদি কেউ নিজ দলের প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করে থাকে তবে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।তবে সিলেটে একটি ঘটনা ঘটলে তার জন্য ঢাবি শিক্ষার্থীদের উপর এমন ব্যবস্থা কতটা যুক্তি সংগত জানতে চাইলে, তার কোন সুস্পষ্ট জবাব দেননি ছাত্রলীগের এ নেতা।এ বিষয়ে ঢাবি ছাত্রদলের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা এসব ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর এসব নির্যাতনের ঘটনাকে তারা বর্বোরোচিত আখ্যা দিয়ে জানিয়েছে,এসব ঘটনায় তাদের একজন কর্মী আহত হয়েছে।নির্যাতীত শিক্ষার্থীদের ল্যাপটপ, মোবাইল, মানিব্যাগ ও অন্যান্য জিনিসপত্রও আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের নেতাদের বিরুদ্ধে।নির্যাতনের শিকার একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছে তাদের ল্যাপটপ, মোবাইল, মানিব্যাগ, নগদ অর্থসহ আরো অনেক কিছুই ছাত্রলীগের নির্যাতনকারি অংশের নেতারা নিয়ে নিয়েছে।বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আধ্যাপক ড. এম এ আমজাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও এ বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভাব হয় নি।

পরে বিশ্ববিদ্যালয়টির সহকারি প্রক্টর অধ্যাপক মো: ফজলুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনিও এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।প্রসঙ্গত, গত ৭ আগস্ট সিলেটের জালালাবাদে দুর্বৃত্তের হামলায় ছাত্রলীগের দুই কর্মী মারাত্মক আহত হন। এ ঘটনার জন্য শিবিরকে দায়ী করেছে ছাত্রলীগ।ওই ঘটনার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সমাবেশে শিবিরের বিরুদ্ধে ‘অ্যাটাকে’যেতে নির্দেশ দেন সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ এবং সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন।

তাদের নির্দেশনার পর থেকেই বিভিন্ন হল থেকে শিবির ধরার নামে এসব অভিযানে নামে হলের নেতারা। কেন্দ্রের নেতাদের কাছে ভাল সাজার প্রবণতা থেকেও হলের শিক্ষার্থীদেরকে শিবির বানাতে মরিয়া হয়ে ওঠে হল ছাত্রলীগ।এটাকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে নিজেদের দলের প্রতিপক্ষকেও আঘাত করছে।

প্রজন্মনিউজ২৪ডট কম

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ