চুরি হলো কীভাবে?

প্রকাশিত: ২৯ জুলাই, ২০১৮ ০১:০০:১০

চুরি হলো কীভাবে?

বাংলাদেশের মানুষ দুর্নীতির অনেক রূপ দেখে অভ্যস্ত। কেবল জ্বালানি খাতেই গ্যাস চুরি, তেল চুরি, বিদ্যুৎ চুরি হয় অহরহ। এখন উঠল কয়লা চুরির বিরাট এক অভিযোগ। পথে পথে, ঘরে ঘরে আলোচিত হলো এটি, সাড়া পড়ল কয়লা চোরের খোঁজে। সরকার জানান, এ চুরির প্রতি তাদের জিরো টলারেন্স নীতির কথা। ইতিমধ্যে একাধিক তদন্ত কমিটি তাদের কাজ শুরু করেছে। কীভাবে এত বড় চুরির ঘটনা ঘটে গেল, তা জনগণের কাছে এখনো অস্পষ্ট। সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের অনুসন্ধানী রিপোর্ট যথাসাধ্য তথ্যভিত্তিক করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নানা ধরনের তথ্য এসে জমা হচ্ছে, ছড়িয়ে পড়ছে ও আলোচিতও হচ্ছে।

এমতাবস্থায় এই কয়লা চুরি বা লোপাট বা উধাও হওয়ার সম্ভাব্য পন্থা বা পন্থাসমূহ সঠিকভাবে আলোচনা করা দুরূহ কাজ। কিন্তু এ সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্যসমূহ সন্নিবেশিত করে একটি বিশ্লেষণধর্মী ধারণা গড়ে তোলা যায় বৈকি! সবাই আশা করে যে তদন্ত কমিটি তাদের অনুসন্ধান সঠিকভাবে সম্পন্ন করে এর প্রকৃত পন্থা ও হোতাদের শনাক্ত করতে পারবে। প্রথমত দেখা যাক কথিত চুরির ঘটনাটি কী?

বড়পুকুরিয়া খনি কর্তৃপক্ষ জানায় যে ২০০৫ সালে খনি চালুর পর থেকে আজ অবধি ১ কোটি ১ লাখ ৬৬ হাজার টন কয়লা উৎপাদিত হয়েছে। আর এ থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ হয় ৬৬ লাখ ৮৭ হাজার টন কয়লা, বাইরে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে দেওয়া হয় ৩৩ লাখ ১৯ হাজার টন ও নিজস্ব ব্যবহারের জন্য নেওয়া হয় ১২ হাজার টন কয়লা। অর্থাৎ মোট কয়লা ব্যবহারের পরিমাণ ১ কোটি ১৮ হাজার টন, তাই বাকি থাকার কথা ১ লাখ ৪৮ হাজার টন কয়লা। কিন্তু ইয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেল, পড়ে আছে ৪ হাজার টন কয়লা। তাই প্রশ্ন ওঠে, বাকি ১ লাখ ৪৪ হাজার টন গেল কোথায়?

১.প্রথমেই দেখা যাক, কয়লা উধাওয়ের ঘটনায় অভিযুক্ত বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি কোম্পানি কর্তৃপক্ষ তাদের দায় এড়াতে কী ব্যাখ্যা দিচ্ছে। কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বলছে, চুরি নয়, হিসাবে কম আসা এ পরিমাণ কয়লা টেকনিক্যাল লস হিসেবে হারিয়ে গেছে। এর অর্থ হলো, স্টক ইয়ার্ডে খোলা অবস্থায় রাখা কয়লা বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণে, যেমন সহজাত প্রজ্বালন, অর্থাৎ বাতাসের সংস্পর্শে থাকা অবস্থায় কোনো কোনো অংশ নিজে নিজে জ্বলে যাওয়া, উন্মুক্ত থাকা অবস্থায় বৃষ্টির পানিপ্রবাহের কারণে কয়লার গুঁড়া তৈরি হয়ে অংশবিশেষ অন্যত্র সরে যাওয়া, শুষ্ক অবস্থায় কয়লার ধুলা বাতাসে উড়ে যাওয়া ইত্যাদি প্রাকৃতিক পদ্ধতির মাধ্যমে হারিয়ে গেছে। কয়লা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্মুক্ত অবস্থায় রাখা কয়লার স্তূপে এই প্রাকৃতিক ক্ষয় হয়ে থাকে, কিন্তু এর পরিমাণ কত, তা নির্ভর করে বহুবিধ বিষয়ের ওপর। তাই কয়লার স্তূপ থেকে কী পরিমাণ কয়লা টেকনিক্যাল লস হিসেবে হারিয়ে যায়, তা জানতে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে মেপে রাখার বিধান রয়েছে।

 

২০০৫ সালে উৎপাদন শুরু হওয়ার পর থেকে এই টেকনিক্যাল লস নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে মাপা ও তার রেকর্ড রাখা হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে খনি কর্তৃপক্ষ জানায় যে তাদের কাছে এ রকম কোনো তথ্য নেই। অর্থাৎ বিগত ১৩ বছরে উৎপাদিত কয়লার টেকনিক্যাল লস নিয়ে কেউ কোনো দিন ভাবেননি ও কোনো নথিতে এর কোনো উল্লেখ নেই। সাধারণ দৃষ্টিতে, এ পরিমাণ টেকনিক্যাল লস অনেক বলে মনে হয়, কিন্তু পরিমাণ গণনা সাধারণের পক্ষে সম্ভব নয়। খনি কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী যে পরিমাণ কয়লা উধাও হয়েছে, তা মোট উৎপাদনের ১ দশমিক ৪৪ শতাংশ। তাদের দাবি, আন্তর্জাতিক পরিসরে এ ধরনের কয়লার স্তূপে ৩ থেকে ৪ শতাংশ টেকনিক্যাল লস হওয়ার রেকর্ড রয়েছে, যে তথ্যটির সূত্র হিসেবে ইন্টারনেটভিত্তিক ওয়েবসাইটগুলোর উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু নিজস্ব খনির ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল লসের কোনো লিপিবদ্ধ তথ্য বা রেকর্ড না দেখাতে পারায় তাদের এই দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। সত্য উদ্‌ঘাটনের স্বার্থে তদন্ত কমিটির উচিত হবে একটি কারিগরি দলের সহায়তা নিয়ে এই ১৩ বছরে সম্ভাব্য কত টেকনিক্যাল লস হয়ে থাকতে পারে, এর আনুমানিক হিসাব বের করা। এটি করা হলে তদন্তের পরবর্তী ধাপগুলো আরও সুদৃঢ় হবে।

২.ধরা যাক, কয়লা বহনকারী ট্রাকে করে এই কয়লা চুরি করে নেওয়া হয়েছে। যদি তা হয়ে থাকে, তবে বড়পুকুরিয়ায় ব্যবহৃত সবচেয়ে বড় ট্রাকগুলো (৩০ টন ধারণক্ষমতা) ব্যবহার করে এই খোয়া যাওয়া ১ লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লা বহন করতে ৪ হাজার ৮০০টি ট্রাক লাগবে। যদি তিন মাসে এই চুরি সংঘটিত হতে হয়, তবে প্রতিদিন ৫৩ ট্রাক কয়লা পরিবহন করতে হবে। দিবালোকে বা রাতের আঁধারে এই বিপুলসংখ্যক চোরাই ট্রাকের লোকচক্ষু এড়িয়ে চলাচল করা অস্বাভাবিক বা অসম্ভব। তাই এ পন্থায় চুরি হলে তা দীর্ঘদিন ধরে হয়ে থাকবে। যেমন এক বছর সময়ে এই পরিমাণ কয়লা চুরি করতে প্রতিদিন ১৩টি করে কিংবা ১৩ বছরে করলে প্রতিদিন ১টি করে ট্রাক লাগবে। অর্থাৎ এটা পরিষ্কার যে এ কয়লা চুরি হয়ে থাকলে তা স্বল্প সময়ে নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে পাচারের মাধ্যমে করা হয়েছে। বড়পুকুরিয়া কর্তৃপক্ষ বলছে, কয়লা সরবরাহে বর্তমানে যে ব্যবস্থা রয়েছে, অর্থাৎ একটি ট্রাক গেটে ঢোকার সময় এবং কয়লা নিয়ে বের হওয়ার সময় ডিজিটাল যন্ত্রে মাপা, একাধিক স্থানে কাগজপত্র পর্যবেক্ষণ করা ও বিশেষ ধরনের সফটওয়্যার-সংবলিত কম্পিউটারে রেকর্ড করা ইত্যাদি, এগুলো ভেদ করে কোনো চোরাই ট্রাক কয়লা নিয়ে চলে যাবে, তা অসম্ভব। এদিকে কোনো একটি টেলিভিশন সংবাদমাধ্যম দেখাচ্ছে কয়লাখনি স্থাপনার পেছনের দিকে একটি গেট, যা দিয়ে কয়লাভরা ট্রাক যেতে দেখেছেন স্থানীয় লোকজন। উপরিউক্ত দুটি বক্তব্য পারস্পরিকভাবে বিপরীতমুখী। তদন্ত কমিটির উভয় পক্ষের দাবি বা অবস্থানটি বিশেষ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যাচাই করা আবশ্যক।

৩.যে পথেই চুরি হোক না কেন, কয়লা অবৈধ হাতে অবৈধ স্থানে গিয়েছে, এর প্রমাণ পাওয়া যায় বড়পুকুরিয়ার কোনো কোনো ব্যবসায়ী ব্যক্তির নিজস্ব কয়লাস্তূপের অবস্থান দেখে। নিয়ম অনুযায়ী খনি কর্তৃপক্ষ প্রথমে বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা সরবরাহ নিশ্চিত করবে এবং ১৫ থেকে ২০ দিনের কয়লার মজুত প্রস্তুত রাখবে। এরপরই কেবল নিজস্ব শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে, এমন ব্যক্তিকে কয়লা দিতে পারবে। কোনো সিনেমা হলের মালিক বা অন্য কোনো ব্যবসায়ী তাঁর আঙিনায় কয়লা কিনে স্তূপ করে রাখবেন ও স্থানীয় শিল্পে উচ্চতর মূল্যে বিক্রি করে লাভজনক ব্যবসা চালাবেন, তা নিষিদ্ধ। কিন্তু এই অবৈধ কাজ বৈধ কাগজ হাতে নিয়েই করা হয়। রাজনৈতিক ও আর্থিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাঁদের প্রভাব খাটিয়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক নন, এমন ব্যক্তির হাতে কয়লা ক্রয়ের কাগজ তুলে দেন। এমন ব্যক্তি যখন কয়লা নিয়ে বের হয়ে আসেন, তা বৈধ পথেই বৈধ কাগজের মাধ্যমে করেন, কিন্তু ব্যাপারটি পুরোপুরি অবৈধ। তিনি কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক নন বিধায় তিনি কয়লা নিতে পারেন না এবং এই কয়লা তিনি শিল্পমালিকদের উচ্চ মূল্যে বেচতেও পারেন না।

কিন্তু উপরিউক্ত উপায়ে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ ব্যবসা চালানো হচ্ছে। আর এ প্রক্রিয়ায় সহায়ক হিসেবে কেবল খনির বাইরের লোকেরাই নয়, বরং এর সঙ্গে খনি কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এতে জড়িত থেকে যে কমিশন পাওয়া যায়, তা লোভনীয় বটে। একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এই অবৈধ ব্যবসা দেখভাল করে এবং প্রয়োজনে শক্তি ও অর্থ উভয়ই খাটিয়ে থাকে বলে অভিযোগ আছে।

৪.বর্তমানে খনি কর্তৃপক্ষ ১ টন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিক্রি করলে পায় ১১ হাজার টাকা। আর বাইরের শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিক্রি করলে পায় ১৭ হাজার টাকা। কয়লা বিক্রি করে যত বেশি লাভ দেখানো যায়, খনি কর্তৃপক্ষের ততই সুবিধা। কারণ, বেশি লাভে তাদের প্রাপ্য ব্যক্তিগত বোনাসের পরিমাণও বেশি হয়। তাই খনি কর্তৃপক্ষ বাইরের শিল্পে কয়লা দিতে বেশি আগ্রহী বলে অনেকে অভিযোগ করেন। কেবল তা-ই নয়, কয়লা উৎপাদন ও ব্যবহারের হিসাবে গরমিল করে বিদ্যুৎকেন্দ্রে ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কয়লা ভাগাভাগিতে শেষোক্ত ক্রেতার প্রতি খনি কর্তৃপক্ষের পক্ষপাতিত্ব নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করেন। দীর্ঘদিন ধরে কয়লা উৎপাদন ও বিক্রির রেকর্ড, তথা সামগ্রিক বিষয়টি অস্পষ্ট থাকায় নানাবিধ প্রশ্ন উঠেছে।

দেশীয় কয়লা উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড়পুকুরিয়া কেলেঙ্কারি একটি বিরাট আঘাত। দুর্নীতির কাদায় আটকে পড়লে এটি সমগ্র দেশীয় কয়লাখনি উন্নয়ন পরিকল্পনাকে হতাশায় নিমজ্জিত করবে। আশার বিষয় যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শক্ত হাতে এর যথাযথ তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি বিধানের আদেশ দিয়েছেন। একটি নিরপেক্ষ ও কারিগরি সদস্য-সংবলিত তদন্ত কমিটি কর্তৃক বিষয়টি নিবিড়ভাবে তদন্ত করে প্রকৃত ঘটনা উন্মোচিত হোক, সবাই সে অপেক্ষায় রয়েছে।

প্রজন্মনিউজ২৪/রায়হান

 

 

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



A PHP Error was encountered

Severity: Notice

Message: Undefined index: category

Filename: blog/details.php

Line Number: 417

Backtrace:

File: /home/projonmonews24/public_html/application/views/blog/details.php
Line: 417
Function: _error_handler

File: /home/projonmonews24/public_html/application/views/template.php
Line: 199
Function: view

File: /home/projonmonews24/public_html/application/controllers/Article.php
Line: 87
Function: view

File: /home/projonmonews24/public_html/index.php
Line: 315
Function: require_once

বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ