প্রাণের উৎসব নববর্ষ

প্রকাশিত: ১৪ এপ্রিল, ২০২৩ ০৩:২২:২৫ || পরিবর্তিত: ১৪ এপ্রিল, ২০২৩ ০৩:২২:২৫

প্রাণের উৎসব নববর্ষ

তৌফিক আহমেদ: পৃথিবীর প্রায় সকল জাতির নিজস্ব উৎসব রয়েছে। যা ধর্ম, বর্ণ, কিংবা গোত্র সীমার বাইরে স্বতন্ত্র জাতিগত উৎসব। এই উৎসব গুলো একান্তই জাতির স্বীয় অভিব্যাক্তি। আর নববর্ষ উৎসব তার শেকড়, যা ভিন্ন জাতির সাথে কোনো কিঞ্চিত সামঞ্জস্যতা থাকে না। নববর্ষ উৎসব সাম্প্রদায়িক নাকি অসাম্প্রদায়িক। এসব মতবাদ আলোচনা প্রধান্য না দিয়ে যদি বলা হয় নববর্ষ প্রত্যেক জাতির প্রাণের উৎসব তা হলে খুব বেশি ভুল হবে কি?  যেমন বলা যেতে পারে ইরানের নববর্ষ। বর্তমান ইরানে দু’সপ্তাহ ব্যাপী নওরোজ উৎসব পালিত হয়ে আসছে প্রায় ১৫ হাজার বছর আগে থেকে। চীনের নববর্ষ উৎসব চলে ১ মাসব্যাপী। ফেব্রুয়ারিতে চীনের চান্দ্র নববর্ষ। এই উৎসবকে বলা হয় চুন জি” ইংরেজিতে স্পিং ফোস্টভ্যাল বা স্পিং ফেস্ট। চীনের মহাপ্রাচীরের একটি অংশে এই দিন বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

প্রাচীন মেসোপটেমিয়া বা ব্যাবিলনে নববর্ষ উদযাপিত হয়ে আসছে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে থেকে। রোমানরা অনেক আগে থেকেই বসন্তকালে নববর্ষ উৎসব পালন করে আসছে। ব্যাবিলনীয়দের দেখাদেখি ইহুদিরা নববর্ষ উৎসব বুশ হুশনা” পালন করে আসছে যিশু খ্রিস্টের জন্মের অনেক আগে থেকে। পাশ্চাত্যের খ্রিস্টানরা ১ জানুয়ারি Happy New Year ডে পালন করছে অনেক দিন থেকে। অবশ্য পাশ্চাত্য নববর্ষ এখন পুরো পৃথিবী ব্যাপী জাকজমক পূর্নতার সাথে পালিত হয়। হিজরি নববর্ষ আরবসহ গোটা মুসলিম বিশ্বেই প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে পালন করে আসছে। এছাড়াও পার্শ্ববর্তী দেশ মায়ানমার সহ নেপাল, লাওস, ককম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড সহ পৃথিবীর প্রতি টি দেশে প্রত্যেক জাতির স্বতন্ত্র নববর্ষ উৎযাপন এর ইতিহাস সুদীর্ঘ।

সেই বিবেচনায় বাংলা নববর্ষ খুব বেশি সুপ্রাচীন নয়। এই তো কয়েক শতক পূর্বে ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হত। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন।
সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন।

১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়। আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেক চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হত। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত, হয় যার রুপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে।

আর নববর্ষ কে আরো নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে পুন্যাহ ও হালখাতা। পুণ্যাহ ছিল রাজস্ব আদায় এবং বন্দোবস্ত সংক্রান্ত প্রাক-ব্রিটিশ সময়ের একটি পদ্ধতি। যে ব্যবস্থায় সরকার কর্তৃক সকল জমিদার, তালুকদার, ইজারাদার এবং অন্যান্য রাজস্ব প্রদানকারী ব্যক্তিদের বছরের নির্দিষ্ট দিনে একটি অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণের মাধ্যমে পূর্ববর্তী বছরের রাজস্ব আদায় এবং নতুন বছরের বন্দোবস্ত প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো। এই দিন জমিদার সারা বছর কৃষক দের জমি চাষাবাদ হিসাব ও খাজনা আদায় করে থাকতেন।

হালখাতা বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। বছরের প্রথম দিনে ব্যবসায়ীরা তাদের দেনা পাওনার হিসাব সমন্বয় করে এ দিন হিসাবের নতুন খাতা খোলেন। এজন্য খদ্দেরদের বিনীতভাবে পাওনা শোধ করার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। এ উপলক্ষে নববর্ষের দিন ব্যবসায়ীরা তাদের খদ্দেরদের মিষ্টিমুখ করান। খদ্দেররাও তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী পুরোনো দেনা শোধ করে দেন। আগেকার দিনে ব্যবসায়ীরা একটি মাত্র মোটা খাতায় তাদের যাবতীয় হিসাব লিখে রাখতেন।

শহর অঞ্চলে পান্তা-ইলিশ, মঙ্গল শোভাযাত্রা, আর শাড়ি- পাঞ্জাবি পরিহিত নানা আনন্দ উৎসাহ উদ্দীপনায় নববর্ষ পালন হয়ে। গ্রাম অঞ্চলে মেলা, সংগীত, নৌকাবাইচ, মোরগ লড়াই ও বিভিন্ন বিনোদনমূলক প্রতিযোগিতায় বাংলা নববর্ষ দিন টি অতিবাহিত হয়।

ফোকলোর বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


প্রজন্মনিউজ২৪/জেড আই

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ