বুড়িগঙ্গার দূষণ রোধে করণীয়

প্রকাশিত: ২২ এপ্রিল, ২০২১ ১১:০০:৫৫

বুড়িগঙ্গার দূষণ রোধে করণীয়

বুড়িগঙ্গার দূষণ যেমন পানিতে হচ্ছে, তেমনি তা আশেপাশেও ছড়িয়ে পড়ছে। এতে মানুষের চামড়ার রোগ, ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, ফুসফুস ড্যামেজসহ ফুসফুসের নানারকম রোগ হচ্ছে

রায়হান রহমান (২৫)। বুড়িগঙ্গার পাশে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা একটি ঘরে বাস করেন। তিনি বলেন, এখানে এভাবে বাস করার সুযোগ আছে তাই থাকছি। তবে আমরাও চাই বুড়িগঙ্গা রক্ষা পাক এবং দূষণমুক্ত হোক। তাহলে আমরাও এর উপকারভোগী হতে পারবো।

কীভাবে এবং কারা বুড়িগঙ্গাকে দূষিত করছে জানতে চাইলে ওয়েস্ট কনসার্ন”-এর নির্বাহী পরিচালক মাকসুদ সিনহা বলেন, প্রায় দুই যুগ ধরে বর্জ্য নিয়ে কাজ করছি। শুরু থেকেই দেখছি বুড়িগঙ্গার পাশে সিটি করপোরেশন বর্জ্য স্তুপ করে রাখতো, এখনও তাই করছে। এই বর্জ্য বিজ্ঞানসন্মত উপায়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু এত দিনেও এ বিষয়ে আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারিনি। বর্জ্যগুলোর উপর কভার দিয়ে রাখা নিয়ম। কিন্তু ওখানে তা নেই। ফলে বর্জ্যরে উপর কাক বা পাখি বসছে এবং সেগুলো আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলছে। এর মাধ্যমে বাতাসে দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে। যা শুধু পরিবেশ নয়, সরাসরি মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর।

তিনি আরও বলেন, দূষিত পানিতে কোনো জলজ জীবন বৃদ্ধি পায় না। দূষিত পানিতে থাকতে থাকতে তারা সরে যায় বা মরে যায়। দূষণের জন্য বুড়িগঙ্গার পানিতে অক্সিজেন নেই। সেখানকার বাতাসও দূষিত। দূষণে বুড়িগঙ্গার আশেপাশের ফসল, মাছ, মাটি, পানি সব কিছুই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বলা যায় পুরো ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স ধ্বংসের দিকে।

ষাটের দশকের শুরুর দিকে হাজারিবাগে ট্যানারি কারখানাগুলো স্থাপিত হয়। ২০০৩ সালে সরকার ১৫৪টি ট্যানারি হাজারিবাগ থেকে একটি পরিকল্পিত শিল্পনগরীতে সরিয়ে নেওয়ার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সাভারের হেমায়েতপুরের হরিণধরা গ্রামে ধলেশ্বরী নদীর পাশে প্রায় ১৯৯ একর জমিতে এই চামড়ানগরী গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়। কিন্তু ১৭ বছরেও সেখানে সবগুলো ট্যানারি সরিয়ে নেয়া হয়নি। সর্বশেষ তথ্য মতে, সেখানে ৩৬টি ট্যানারি সরিয়ে নেয়া হলেও  বাকিগুলো হাজারীবাগে রয়েছে। ট্যানারির বর্জ্য সরাসরি বুড়িগঙ্গায় যায়। বলা হচ্ছে, ট্যানারীতে কমপক্ষে দুই শত রকমের রাসায়সিক ব্যবহার হয়। এছাড়া বেশ কিছু শিল্প-কারখানার বর্জ্য, ড্রেন ও সুয়ারেজের বর্জ্য, গৃহস্থলী ও মেডিকেল বর্জ্য এমনকি প্লাস্টিকের বর্জ্যও যোগ হচ্ছে সেখানে।

শুধু বুড়িগঙ্গার পানি নয় মানুষের স্বাস্থ্যেও এ দূষণ ভূমিকা পালন করছে বলে জানান মুগদা মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের প্রিন্সিপাল ডা. আহমেদুল কবীর। তিনি বলেন, বুড়িগঙ্গার এ দূষণ ঢাকা শহরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ট্যানারি ছাড়াও আশেপাশে ছোটবড় যেসব কারখানা আছে সেগুলোর বর্জ্য ইটিপি প্লান্টের মাধ্যমে শোধন করে তা বের করে দেয়া নিয়ম। বাস্তবে কি তা হচ্ছে? সুয়ারেজ সিস্টেমের কথা বলা যায়। সেগুলোতে কি কোনো লিকেজ নেই? মিডফোর্ট হাসপাতালের বর্জ্য, ওর আশেপাশে জর্দ্দা কারখানাসহ নানা রকমের কারখানা আছে। সেগুলোর বর্জ্য কোথায় যাচ্ছে? সবই তো বুড়িগঙ্গায় যাচ্ছে। বুড়িগঙ্গার দূষণ যেমন পানিতে হচ্ছে, তেমনি তা আশেপাশেও ছড়িয়ে পড়ছে। এতে মানুষের চামড়ার রোগ, ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, ফুসফুস ড্যামেজসহ ফুসফুসের নানারকম রোগ হচ্ছে।

বুড়িগঙ্গার আশেপাশের আবাদি জমিগুলোতে বুড়িগঙ্গার পানি ব্যবহার হয় বলে এসব খাবারও সমান ক্ষতিকর বলেন ডা. আহমেদুল। তিনি বলেন, বুড়িগঙ্গার জলজ জীবনের কথা বাদ দিলাম। সে ক্ষতির পরিমাণ ভয়াবহ। তবে এ দূষিত পানি আশেপাশের আবাদী জমি ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করছে। ওসব পানিতে হেভি মেটাল থাকায় তা খাবারের সাথে মিশে গিয়ে কিডনি ও ফুসফুসের নানা রোগব্যধি হচ্ছে। অনেকের চামড়া ও নখের সমস্যা হতে পারে। ওসব খাবার পাকস্থলী ও লিভারের সমস্যা করতে পারে। অনেক সময় ফুড পয়জনিং এবং ডায়রিয়াও হতে পারে।

বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানো প্রয়োজন। এজন্য আইন রয়েছে। ২০১৯ সালে হাইকোর্ট নদী নিধনকে যুথবন্ধ আত্মহত্যা” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে পরিবেশগত ছাড়পত্রবিহীন যে সব কারখানা ও স্থাপনা বুড়িগঙ্গার পাড়ে রয়েছে সেগুলো বন্ধ করে দেওয়ার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছিলো হাইকোর্ট। এই নির্দেশ বাস্তবায়ন করে পরিবেশ অধিদপ্তরকে ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি এ ব্যাপারে হাইকোর্টে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেয়। একই দিনে বুড়িগঙ্গার সাথে যুক্ত ড্রেন ও সুয়ারেজ লাইনগুলো পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার জন্য আদেশ দেওয়া হয়েছিলো ঢাকা ওয়াসাকে।

এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার চিফ ইঞ্জিনিয়ার মো. কামরুল হাসান বলেন, কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী র‌্যাব ও পুলিশের সহায়তায় বেশ কিছুদিন আগে থেকেই এ কাজ আমরা শুরু করেছি। যারা নিয়ম ভঙ্গ করেছে তাদের বিরুদ্ধে আমরা ম্যাজিট্রেট কোর্টে মামলাও করেছি। তবে এগুলো ঠিকমতো ফলোআপ না করলে এর সুফল পাওয়া যাবে না। এজন্য এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন থাকা প্রয়োজন।

ওই সময় পরিবেশ অধিদপ্তর হাইকোর্টকে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দিয়েছিলো। প্রতিবেদনে বলা আছে, নদীর দক্ষিণ পাড়ে অবৈধভাবে পরিচালিত ৫২টি কারখানা নদীর পানিতে বর্জ্য ফেলে দূষণ ঘটাচ্ছে। ওই কারখানাগুলোর পরিবেশগত ছাড়পত্র ও তরল বর্জ্য শোধনাগার বা ইটিপি প্ল্যান্ট নেই। নদীর উত্তর পাড়েও কিছু কারখানা অবৈধভাবে চলছে। ২০১৭ সালে এ রকম ২৭টি কারখানা এবং এ বছর ১৮টি কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।

এভাবে কারখানা বন্ধ করে দেয়া হলেও এখনো কিছু কারখানা সেখানে বর্জ্য ফেলছে। এরকম চলতে থাকলে কীভাবে বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানো সম্ভব জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক এ কে এম রফিক আহমেদ বলেন, দূষণ বন্ধে আইনগতভাবে কাজ করতে গিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আটকে যাই। তারা রিট করে। এগুলো দীর্ঘদিন ধরে চলছে। ছোট করে বলতে পারি, ওয়াসার বর্জ্য সরাসরি বুড়িগঙ্গায় যায়। সিটি করপোরেশনকে বারবার বলেছি, বর্জ্যরে ট্রিটমেন্ট করতে। তারা বলে, কাজ করছি। প্রকল্প নেয়ার কথাও বলে। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায় না। তারা সময় নেন। কাজ হয় না। এ বিষয়ে সন্মিলিতভাবে কাজ করা দরকার এবং নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে অঙ্গীকারবন্ধ হওয়া উচিত।

যেখানে বুড়িগঙ্গার দূষণ বন্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর আইনগতভাবে কাজ করতে গিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠানের কাছে বাধাগ্রস্থ হয় সেখানে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে কাজ করছে জানতে চাইলে জাতীয় নদী সংরক্ষণ কমিশন-এর চেয়ারম্যান ড. মুজিবর রহমান হাওলাদার বলেন, বুড়িগঙ্গার দূষণ কমাতে এর আশেপাশে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বাজার-দোকান, বাড়ি-ঘর ইত্যাদি উচ্ছেদ করতে হবে। এ বিষয়ে আমরা আইনগতভাবে কাজ করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছি। তবে এর আইনগত ক্ষমতা বিআইডব্লিউটিএ, সিটি করপোরেশন এবং ঢাকা জেলা প্রসাশকের রয়েছে। তাদেরকে বিষয়গুলো আমরা একাধিকবার বলেছি। তারা এ বিষয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেননা। বরাবরই এ বিষয়ে তাদের অবহেলা এবং অনীহা দেখা যায়। তাদেরকে আমরা যাতে জবাবদিহি করতে পারি এজন্য আমরা সেই ক্ষমতা চেয়ে সরকারের কাছেও আবেদন করেছি।

তিনি আরও বলেন, দূষণ বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণের জন্য থ্রি আর পদ্ধতি অপরিহার্য। এই পদ্ধতি ছাড়া যখন নব্যতা বৃদ্ধি বা এ ধরনের কোনো কাজ হয় তখন কাজটি সঠিকভাবে হয়না। কেননা এখানে একটা জিনিস আরেকটার সাথে সম্পর্কিত। কেউ হয়তো  ড্রেজিং করছে কিন্তু মাটি নদীর পাশেই ফেলছে এবং কিছুদিন পর সেই মাটি আবার নদীতে জমা হচ্ছে। এখানে ভূমি মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় স্থানীয় সরকারসহ অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান জড়িত। এজন্য আমাদের সকলকে এক হয়ে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। সিটি করপোরেশন যদি বর্জ্য না ফেলে বা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি গ্রহণ করে, বিআইডব্লিউটিএ যদি নদীতে অবৈধ দখলদার এবং জেলা প্রশাসক নদীর দুই ধারে গড়ে ওঠা বাজার দোকানপাট ইত্যাদি উৎখাতের ব্যবস্থা করে তাহলে হয়তো বুড়িগঙ্গাকে অনেকটাই রক্ষা করা সম্ভব। এজন্যই সকলের মাঝে সমন্বয় প্রয়োজন।

সমন্বিত প্রচেষ্টায় বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানো সম্ভব বলে মুজিবর রহমানের সাথে একমত পোষণ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এন এম ফকরুদ্দিন। তিনি বলেন, পৃথিবীর অনেক নদী এক সময় ‘ইকোলজিক্যালি ডেথ থাকলেও উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে সেগুলো পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। যেমন বলা যায় প্রায় ৬০ বছর আগে টেমস নদীর অবস্থা বুড়িগঙ্গার চেয়েও খারাপ ছিল। আমরাও তা করতে পারি। এজন্য সরকারকে কঠোরভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।”      

সরকার মাঝে মধ্যে উদ্যোগ নিলেও তা কার্যকর সম্ভব হয় না। বরং ওই দূষিত পানিতে অবাধে গোসল, কাপড় ধোয়া এবং বাণিজ্যিকভাবে লন্ড্রির কাপড় পরিস্কার করা হচ্ছে। গৃহর্স্থ্যলী কাজকর্ম করে অনেকে। গরু-ছাগলসহ বিভিন্ন প্রাণীদেরও  গোসল করানো হয়। জেলেরা মাছ ধরে। অনেকে পলিথিন ব্যাগ ও প্লাস্টিক কন্টিনার পরিস্কার করে। এ রকম   পরিবেশে বিনোদনের জন্য রিভার ক্রুজও রয়েছে। এত অনিয়মের মাঝে বুড়িগঙ্গাকে রক্ষা করা কি সম্ভব হবে? অধ্যাপক ফকরুদ্দিন বলেন, অবশ্যই সম্ভব। এজন্য নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুনসহ সাধারণ মানুষের সচেতনতাও প্রয়োজন।

সরকার, সাধারণ মানুষ এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সকলের আন্তরিক সহযোগিতাই একদিন বুড়িগঙ্গা টেমস নদীর মতো কিংবন্তীতে পরিনত হতে পারে এমনই স্বপ্ন দেখেন রায়হান ও সুশীল সমাজ।

প্রজন্মনিউজ২৪/নাজমুল

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ