বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে আইন লঙ্ঘন করে নির্বিচার প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার

প্রকাশিত: ২৮ অগাস্ট, ২০২৪ ১২:৩২:২১

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ ছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক। গত ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ ছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক। গত ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হনছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মিছিলটি যখন পার্কের মোড়ে যায়, তখন সবার সামনে ছিলেন আবু সাঈদ। পুলিশের বাধার মুখে অন্যরা সরে গেলেও আবু সাঈদ দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে যান। একা নিরস্ত্র প্রতিবাদী এই তরুণকে একের পর এক গুলি করে পুলিশ। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়।

শুধু রংপুর নয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমন করতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বিচার গুলি করেছে। এর মধ্যে অন্তত তিন শ্রেণির প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে মানুষ হত্যা করার তথ্য পাওয়া গেছে। ১৬ জুলাই থেকে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরদিন পর্যন্ত যে বিপুলসংখ্যক মানুষ হতাহত হয়েছেন। এখন পর্যন্ত ৭৫৮ জনের নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁদের বেশির ভাগই নিহত হয়েছেন প্রাণঘাতীর অস্ত্রের গুলিতে। বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির হিসাবে ৭০ শতাংশ মৃত্যুই হয়েছে গুলিতে।

রংপুরে আবু সাঈদকে গুলির ওই ঘটনার দুটি ভিডিও যাচাই করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ক্রাইসিস এভিডেন্স ল্যাব। সংস্থাটি জানিয়েছে, স্যাটেলাইট ছবি ব্যবহার করে তারা দেখেছে, ১৫ মিটার দূর থেকে আবু সাঈদকে গুলি করা হয়। সাঈদ তখন পুলিশের জন্য কোনো হুমকির কারণ ছিলেন না। আপাতদৃষ্টে ওই গুলির ঘটনা ইচ্ছাকৃত ছিল।

এ রকম আরও ছয়টি ঘটনার ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করেছে তথ্য যাচাইকারী বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। তাতে দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ প্রয়োগের মতো পরিস্থিতি না থাকা সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে ১৬ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত ৩৪১ জন নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৭৫ জনের মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৩৭ জনের শরীরে প্রাণঘাতী গুলি ও ২২ জনের শরীরে শটগানের গুলির চিহ্ন ছিল। তাঁদের অনেকে ‘এইম ফায়ার’ বা লক্ষ্যবস্তু করে গুলির শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।

৪ আগস্ট থেকে পরের সময়ে আরও ৪১৭ জন নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে এখন পর্যন্ত। এর মধ্যে ৪ আগস্ট এক দিনেই সারা দেশে নিহত হন ১১৬ জন। ওই দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মীও আন্দোলনকারীদের ওপর প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করতে দেখা গেছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ প্রয়োগের মতো পরিস্থিতি না থাকা সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে

                  আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’প্রয়োগের  মতো পরিস্থিতি না থাকা সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ফাইল ছবি

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলায় অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের হাতে শটগান, বন্দুক ও পিস্তল বেশি দেখা গেছে। কোথাও কোথাও রাইফেলও দেখা গেছে। ফেনীতে সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর অনুসারীরা একে-৪৭ ও এম-১৬ রাইফেল দিয়েও গুলি করেছেন বলে স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে।

শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালানোর পর অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী এবং থানায় ও পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে। এ সময় বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য নিহত হন। ৫ আগস্ট আক্রান্ত বিভিন্ন থানা থেকে পুলিশও অনেক গুলি করেছে। পুলিশের ভাষ্য, তারা আত্মরক্ষার্থে গুলি করতে বাধ্য হয়েছে।তবে আন্দোলনকারীরা বলছেন, ৫ আগস্ট সকাল থেকেই বিভিন্ন স্থানে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়েছে। সবচেয়ে বেশি গুলির ঘটনা ঘটেছে যাত্রাবাড়ীতে। এ ছাড়া থানায় হামলার ঘটনা বাদ দিলে ১৬ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত পুলিশ বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক গুলিবর্ষণ করেছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র, গোলাবারুদ বিশেষজ্ঞ, বিভিন্ন হাসপাতাল ও তথ্য যাচাইকারী একাধিক ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের তথ্য এবং সংঘর্ষের সময় ব্যবহৃত অস্ত্রের ভিডিও ও ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করার ক্ষেত্রে শটগান, পিস্তল ও চাইনিজ রাইফেল—এই তিন শ্রেণির অস্ত্রের ব্যবহার বেশি হয়েছে। কোথাও কোথাও এসএমজি ও এলএমজির মতো অস্ত্রও ব্যবহৃত হয়েছে। এ ছাড়া ছত্রভঙ্গ করার জন্য কাঁদানের গ্যাসের শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়েছে।সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, শটগান থেকে রাবার ও সিসার দুই ধরনের গুলি ব্যবহার হয়েছে। এই গুলিগুলোকে ছররা গুলিও বলে থাকেন অনেকে। কারণ, এর কার্তুজের ভেতরে ছোট ছোট বল (স্প্লিন্টার) থাকে। বলের সংখ্যা, আকার ও লক্ষ্যবস্তুর দূরত্বভেদে ছররা গুলিও প্রাণঘাতী হতে পারে। যেমনটা ঘটেছে রংপুরের আবু সাঈদের ক্ষেত্রে। মৃত্যুর পর দেখা গেছে, স্প্লিন্টারবিদ্ধ হয়ে তাঁর বুক ও পেট ঝাঁঝরা হয়ে গেছে।

পুলিশ সূত্র জানায়, এখন পুলিশ বাহিনীতে ৭ পয়েন্ট ৬২ এবং ৯ এমএম ক্যালিবারের অস্ত্রের ব্যবহার আছে। তবে ৯ এমএম পিস্তলের ব্যবহারই বেশি। এ ছাড়া পুলিশের কাছে ৭ পয়েন্ট ৬২ এমএম চাইনিজ রাইফেল, সাব মেশিনগান (এসএমজি) ও লাইট মেশিনগান (এলএমজি) রয়েছে।গোলাবারুদ বিশেষজ্ঞ একজন অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ৯ এমএম পিস্তলের গুলির কার্যকর সীমা (ইফেক্টিভ রেঞ্জ) ৫০ মিটার। তবে অবস্থাভেদে কয়েক শ মিটার দূরত্বে আঘাত করলেও তা প্রাণঘাতী হতে পারে। আধা স্বয়ংক্রিয় (সেমি-অটোমেটিক) ৭ পয়েন্ট ৬২ এমএম চাইনিজ রাইফেলের গুলি ৩০০ মিটারের মধ্যে কারও শরীরে লাগলে তা প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে।আর কার্তুজের ধরনের ওপর নির্ভর করে শটগানের গুলি ৪০-৫০ মিটারের মধ্যে লাগলে প্রাণনাশের কারণ হয়ে উঠতে পারে।

পদে পদে আইন লঙ্ঘন

পুলিশ প্রবিধানের ১৫৩ ধারা অনুযায়ী, তিন ক্ষেত্রে পুলিশ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে। এগুলো হলো ব্যক্তির আত্মরক্ষা ও সম্পদ রক্ষার অধিকার প্রয়োগ, বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করা ও গ্রেপ্তার কার্যকর করার জন্য।

দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ১০০ ও ১০৩ ধারা অনুযায়ী, প্রাণহানি, মারাত্মক আঘাত ও অগ্নিসংযোগের দ্বারা অনিষ্ট করাসহ কয়েকটি ক্ষেত্রে পুলিশকে আক্রমণকারীদের মৃত্যু ঘটানোর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশ প্রবিধান (পিআরবি) ১৫৩-তে বলা হয়েছে, নিজেদের বা জনগণের সরকারি সম্পত্তি হামলা থেকে রক্ষার জন্য পুলিশ শক্তি প্রয়োগ করতে পারে।

তবে দণ্ডবিধির ৯৯ ধারায় এই শক্তি প্রয়োগের মাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী, আত্মরক্ষার জন্য যতটুকু প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি শক্তি প্রয়োগ করা যাবে না। তা ছাড়া দণ্ডবিধির ১০২ ধারা অনুযায়ী, যখনই ক্ষতির আশঙ্কা শেষ হবে, তখনই আত্মরক্ষার জন্য শক্তি প্রয়োগের অধিকারও শেষ হবে।

রাজধানীর রামপুরা এলাকার একটি ভিডিও ফুটেজ যাচাই করে আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এএফপির বাংলাদেশ ফ্যাক্ট চেক এডিটর কদরুদ্দীন শিশির প্রথম আলোকে বলেন, রামপুরা-মৌচাক সড়কের ওয়াপদা রোডের মুখে বিক্ষোভরত এক যুবক হঠাৎ করে পড়ে যান। গুগল স্ট্রিট ভিউ থেকে নেওয়া ছবি এবং ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১০০ মিটার বা তার কিছু দূরে থাকা বিজিবি দলের অবস্থান থেকে ছোড়া একটি বুলেট ওই যুবকের শরীরে লাগে।

ভিডিও ও ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করার ক্ষেত্রে শটগান, পিস্তল ও চাইনিজ রাইফেল—এই তিন শ্রেণির অস্ত্রের ব্যবহার বেশি হয়েছে।

ভিডিও ও ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করার ক্ষেত্রে শটগান, পিস্তল ও চাইনিজ রাইফেল—এই তিন শ্রেণির অস্ত্রের ব্যবহার বেশি হয়েছে। ফাইল ছবি

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ক্রাইসিস এভিডেন্স ল্যাব এই এলাকার একটি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে গত ২৫ জুলাই জানিয়েছে, এতে পুলিশ ও বিজিবির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে একটি সাঁজোয়া যানের (এপিসি) পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। একজন কর্মকর্তা একটি অ্যাসল্ট রাইফেল থেকে দুটি গুলি করেন।

ভিডিওটি যাচাই করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, এ ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র সমাবেশের পুলিশিংয়ের জন্য উপযুক্ত হাতিয়ার নয়। মৃত্যু বা গুরুতর আঘাতের আসন্ন হুমকির মোকাবিলায় কঠোরভাবে প্রয়োজন হলেই কেবল এমন অস্ত্র ব্যবহার করা উচিত।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, কোনো বিক্ষোভ বা রাস্তায় নেমে আসা বিক্ষুব্ধ জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে ধৈর্য নিয়ে কাজ করতে হয়। কাউকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে গুলি করা পুলিশের কাজ নয়। তা ছাড়া ঘর, বারান্দা ও ছাদে থাকা মানুষের শরীরে গুলি লেগেছে, কেউ কেউ মারা গেছেন—এগুলো খুবই ভয়ংকর অপেশাদার কাজ।

সাবেক এই আইজিপির মতে, এখন পুলিশে পেশাদারত্বের কাজের চেয়ে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বেশি হয়ে গেছে। এ কারণে এগুলো হয়েছে। তা না হলে এভাবে গোলাগুলি করার কোনো কারণ নেই। পেশাদারত্বের জায়গা থেকে পুলিশ অন্যদিকে সরে গিয়েছিল।


প্রজন্মনিউজ/সারাফাত

এ সম্পর্কিত খবর

২৩৭ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী চূড়ান্ত, কোন আসনে কে?

বিএনপি নেতার কার্যালয়ে বোমা হামলা ও নিহতের ঘটনায় বিক্ষোভ

প্রাথমিকে থাকছেনা সঙ্গীত ও শারীরিক শিক্ষক

১০৮৯টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত হচ্ছে, ফাইলে প্রধান উপদেষ্টার স্বাক্ষর

গার্মেন্টস শ্রমিদের বিক্ষোভ,তীব্র যানজট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে 

‘বিএনপির উপর নিরর্ভর করছে এনসিপির সংসদে যাওয়া’

সাভারের ভাকুর্তায় জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদাণ

নোট অব ডিসেন্টের মাধ্যমে বিএনপির স্বৈরাচার হওয়ার চিন্তাভাবনা বোঝা যায়: তাহের

বরগুনাতে চাঁদা দাবি ব্যবসায়ীকে প্রাণনাশের হুমকি

ফের জামায়াত আমির নির্বাচিত হলেন শফিকুর রহমান

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ