ক্ষেতে পচছে ফুল, ক্ষতির মুখে চাষিরা

প্রকাশিত: ১৪ এপ্রিল, ২০২০ ০৯:৪৯:৩৭

ক্ষেতে পচছে ফুল, ক্ষতির মুখে চাষিরা

উৎসব, অনুষ্ঠান মানেই ফুলের প্রয়োজন। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে সকল ধরনের উৎসব ও অনুষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বন্ধ থাকায় বিক্রি করতে না পেরে ক্ষেতের ফুল ক্ষেতেই পচে শুকিয়ে যাচ্ছে, বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে ফুল ব্যবসায়ী ও চাষিরা। সারা বছরে কয়েকটি অনুষ্ঠানকে ঘিরেই চাষিরা ফুল বিক্রি করে থাকে। সেই সমস্ত অনুষ্ঠানের মধ্যে গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস ছিল, এই দিবসে কোটি কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়, কিন্তু এবার অনুষ্ঠান না হওয়ায় বিক্রি ছিল না।

সামনে পহেলা বৈশাখ, ফুলের বড় বাজার কিন্তু এই দিনটিও আনুষ্ঠানিকভাবে পালন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তাহলে দুইটি অনুষ্ঠানে চলতি মৌসুমে কৃষকের প্রায় আড়াইশ কোটি টাকার ফুল নষ্ট হবে। গত অর্থবছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়েছিল। গত কয়েক বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও কিছু কিছু ফুল রপ্তানি হয়। বর্তমানে ফুল উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ফুলের খুচরা ব্যবসার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় অর্ধকোটি মানুষ জড়িত রয়েছে। এ অবস্থায় তারা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে।

যশোরের ফুল চাষি লিয়াকত আলী কালের কণ্ঠকে জানান, আমি সাত বিঘা জমির মধ্যে বিভিন্ন রকমের ফুল চাষ করেছি। এ ফুল চাষ করতে আমার এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে পাঁচ লাখ থেকে ছয় লাখ টাকা। দেশের সকল অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ায় ফুলের ব্যবসায়ীরা ফুল কিনছেন না। এখন ক্ষেতের মধ্যেই ফুল পচে পচে শুকিয়ে যাচ্ছে। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস ও পহেলা বৈশাখ এ দুটি অনুষ্ঠান হলো ফুলের বড় বাজার। কিন্তু এবছর ২৬ মার্চে কোনো ফুল বিক্রি হয়নি এবং সামনে পহেলা বৈশাখ সেই অনুষ্ঠানটিও বন্ধ ঘোষণা দিয়েছে। শুধু মাত্র এ দুটি অনুষ্ঠানে ফুল বিক্রি করতে না পারায় আমার তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। দুটি ব্যাংক ও একটি এনজিও থেকে ৪ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে এবং আমার জমানো টাকা দিয়ে এ বছর ফুল চাষ করেছিলাম।

সাভার নামাবাজার এলাকার ফুল চাষি আফসার উদ্দিন কালের কণ্ঠকে জানান, পূবালী ব্যাংক থেকে ৫ লাখ টাকা লোন নিয়ে, আরো ৫ লাখ টাকা বিভিন্নভাবে ব্যবস্থা করে মোট ১০ লাখ টাকা খরচ করে ১০ বিঘা জমিতে ফুল চাষ করেছিলাম। করোনার কারণে আমাদের এখন অনেক সর্বনাশ হয়ে গেছে। সারা দেশ লকডাউনে থাকায় ফুল বিক্রি না হওয়ায় ক্ষেতের ফুল ঝড়ে পরে যাচ্ছে। এটা তো পচনশীল, ধরে রাখার সুযোগ নেই। তাই ফুলগুলো কেটে কেটে ফেলে দিতে হচ্ছে। ফুল বিক্রি করতে না পারলেও প্রতিদিন ক্ষেত পরিচর্চার কাজে ২ হাজার টাকা করে খরচ হচ্ছে আমাদের।

রাজধানীর শাহবাগের ফুল ব্যবসায়ী ও অনন্যা পুষ্প বিতানের মালিক মো. লোকমান হোসেন কালের কণ্ঠকে জানান, করোনার শতভাগ প্রভাবটা আমাদের উপর পরেছে। পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় ফুল বিক্রি বন্ধ রয়েছে। প্রতিটি ফুলের দোকানে ৪-৫ জন করে ফুলের কারিগড় রয়েছে, দোকান বন্ধ থাকলেও তাদের বেতন দিতে হচ্ছে। কৃষক থেকে শুরু করে এ সেক্টরের সাথে যারা জড়িত সবাই অনেক লোকসানের মধ্যে রয়েছে। পহেলা বৈশাখকে ঘিরে আমাদের সবচেয়ে বেশি ব্যবসা ছিল, দেশের এ অবস্থার কারণে পহেলা বৈশাখ উদযাপন বন্ধ করে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী, ২৬ মার্চ এবং পহেলা বৈশাখ এ তিনটি অনুষ্ঠানে ফুল বিক্রি করতে না পেরে শাহবাগের প্রতিটি দোকানের গড়ে ৫ লাখ টাকা করে ক্ষতি হবে। 

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটি’র সভাপতি মো. আব্দুর রহিম কালের কণ্ঠকে জানান, ফুল কাঁচা কৃষি পণ্য। প্রতিদিন ফুল কেটে খুচরা বিক্রেতাদের দ্বারা বাজারজাত করতে হয়, না হলে জমিতে নষ্ট হয়। গত ১৮ মার্চ থেকে এই পর্যন্ত ফুল চাষিরা কোনো ফুল বিক্রি করতে পারেনি। এমনকি সারা দেশে যে সমস্ত খুচরা বিক্রেতারা আছে তারাও তাদের দোকানগুলো বন্ধ করে বসে আছে। সারা বছরে কয়েকটি অনুষ্ঠানকে ঘিরেই চাষিরা ফুল বিক্রি করে থাকে। সেই সমস্ত অনুষ্ঠানের মধ্যে গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস ও পহেলা বৈশাখ এ দুইটি অনুষ্ঠানে চলতি মৌসুমে ফুল বিক্রি না হওয়ায় চাষিদের প্রায় আড়াইশ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে এখন ফুল সেক্টরটি চরম ক্ষতিগ্রস্তর ভিতর দিয়ে ধবংসের মুখে। ফুল উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও খুচরা ফুল ব্যবসার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থেকে প্রায় অর্ধকোটি মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে, তারা প্রান্তীক, ক্ষুদ্র ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির। এ সেক্টরকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের বিভিন্ন সহযোগিতা প্রয়োজন। 

এদিকে কালের কণ্ঠ যশোর প্রতিনিধি জানান, করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাবে দিশেহারা দেশের সবচেয়ে বেশি ফুল উৎপাদন এলাকা যশোরের গদখালি অঞ্চলের ফুলচাষিরা। পর পর কয়েকটি ফুল বিক্রির মৌসুমে ফুল বিক্রি করতে পারেননি তারা। ১৭ মার্চ,  ২৬ মার্চ ও পহেলা বৈশাখে বিপুল পরিমাণ ফুল বেচাকেনা হয় এ অঞ্চলে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ হয় এখানে উত্পাদিত ফুল। তবে করোনার কারনে বন্ধ সব অনুষ্ঠান আয়োজন। নেই কোন বেচাকেনা। সে কারণে ক্ষেতের ফুল ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে। অনেকে ফুল কাটলেও বিক্রি করতে না পেরে গরু ছাগল দিয়ে খাইয়ে দিচ্ছেন। করোনার কারনে যশোর জেলার ফুল চাষি ও বিক্রেতা পর্যায়ে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকার। 

নিজস্ব প্রতিবেদক সাভার : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী, ২৬ মার্চ এবং বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বৈশাখে ফুলের চাহিদা থাকবে বেশি। বিষয়টি মাথায় রেখে গোলাপ বাগানের প্রতি একটু বেশি যত্নশীল ছিলাম চাষিদের। টাকা-পয়সাও খরচ করেছি অন্যান্য বছরের চেয়ে অনেক বেশি। করোনার কারণে সকল অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্রেতা না থাকার কারণে সভারের চাষিরা ফুল বিক্রি করতে পারছেন না। বিঘার পর বিঘা জমিতে চাষ করা গোলাপ বাগানেই ফুটে ঝরে যাচ্ছে।

নিজস্ব প্রতিবেদক ও আঞ্চলিক প্রতিনিধি (রংপুর): ভয়াবহ করোনাভাইরাস আতঙ্কে আনুষ্ঠানিকভাবে সব ধরণের সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আর এতেই সর্বনাশের মুখে পড়েছেন চাষিরা। অন্যান্যবারের চেয়ে এবারে বাগানে ফুলের ফলনও হয়েছে বাম্পার। করোনার কারণে বৈশাখের সকল অনুষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করায় ফুল চাষিরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। প্রতিদিন বাগান থেকে ফুল কেটে ফেলে দিতে হচ্ছে। রংপুরের শতাধিক ফুল চাষি পহেলা বৈশাখ পালন না হওয়ার খবরে হতাশায় দিন গুণছেন।

চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি : চুয়াডাঙ্গায় ৬৩ হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ধরনের ফুল চাষ করা হয়েছে। ফুল বিক্রি করতে না পারায় জমির ফুল জমিতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফুল নিয়ে বিপাকে পড়েছেন চুয়াডাঙ্গার চাষিরা। ফুল চাষিদের বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে আর্থিক অনুদান দেওয়ার দাবি জানান চাষিরা।

ঈশ্বরদী (পাবনা) প্রতিনিধি : ফুল চাষিদের লক্ষ্য ছিলো ১ বৈশাখে ফুল বিক্রয় করা। এই জন্য খাজনা নিয়ে চাষিরা চাষ করেছিল গাধা, রজনীগন্ধা, গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, চেরিসহ নানা জাতের ফুল। দিনরাত পরিশ্রম ও পরিচর্যা করে ফুটানো হয় ফুল। কিন্তু বিধিবাম। ফুল ফোটা শুরু হলেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও নেমে আসে করোনা মহামারী। এ মহামারীর কারণে দেশের সকল অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় চাষিদের ফুল বিক্রিও বন্ধ। তাই ভেঙ্গে পড়ছে রজনীগন্ধা। চন্দমল্লিকা ও গোলাপের নানা রঙয়ের পাপড়িও ঝড়ে যাচ্ছে। এ লোকসান কাটিয়ে উঠা হয়তোবা কোনো মতেই সম্ভব না এ ফুল চাষিদের। 

করোনাভাইরাসের কারণে দেশের এই দূর্যোগ পরিস্থিতিতে সম্ভবনাময় ফুল সেক্টরের বর্তমান সার্বিক অবস্থা তুলে ধরে গত ২ এপ্রিল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটি’র সভাপতি মো. আব্দুর রহিম কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে চিঠি দিয়েছেন।

projonmonews24/maruf

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ