প্রকাশিত: ০৪ অগাস্ট, ২০২২ ০৪:৫৫:৪৮
আফগানিস্তানের মাটি ছাড়ার পর আমেরিকার প্রথম ক্ষেপনাস্ত্র হামলা এবং নির্ভুল লক্ষ্যভেদ। কাজটা কি এতই সহজ ছিল, নাকি এটা পরবর্তী পদক্ষেপের নান্দীমুখ! ভোরের নমাজ সেরে নিত্য অভ্যাস মতো নিজের বাড়ির বারান্দায় বেরিয়েছিলেন আয়মান-আল-জাওয়াহিরি ৭১ বছরের প্রাক্তন আল-কায়দা নেতা। সূর্যোদয়ের ঘণ্টা খানেক পরে কাবুল শহরের প্রাসাদোপম বাড়ির বারান্দায় তখন খেলা করছে সকালবেলার হাওয়া।
স্থানীয় সময় ৬.১৮ নাগাদ সেই বারান্দা এসে পড়ল দু’খানি মার্কিন মিসাইল। ধ্বংস হয়ে গেল বারান্দা আর বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মিশরীয় জিহাদি নেতা, যিনি 9/11-র অন্যতম চক্রী বলে পরিচিত। গত ৩১ জুলাইয়ের ঘটনা। অথচ, দু’খানা মিসাইল হানার পরও দিব্যি দাঁড়িয়ে রয়েছে সাদা রঙের বাড়িটি। এমনকী অক্ষত শরীরে রয়েছে নিহত নেতার স্ত্রী ও কন্যা। দীর্ঘদিনের আল-কায়েদা প্রধান আয়মান আল-জাওয়াহিরির হত্যার পর সারা বিশ্বকে আশ্চর্যান্বিত করেছে আমেরিকার এই নিখুঁত লক্ষ্যভেদী অস্ত্র।
এর আগে আমেরিকার দিকে বহুবার অঙুল উঠেছে নিরপরাধ নাগরিক হত্যার অভিযোগে। লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়ে বহু ক্ষেপনাস্ত্র প্রাণ কেড়েছে অসামরিক ব্যক্তির। কিন্তু এ বার ঠিক কী ভাবে এত নিখুঁত আঘাত করা সম্ভব হল?বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষ ক্ষেপনাস্ত্রের চরিত্রগত কৌশলই এত নিখুঁত লক্ষ্যভেদে সহায়ক হয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে মার্কিন গোয়েন্দা দলের নিপুণ গবেষণা। জাওয়াহিরির দৈনন্দিন জীবনের অনুপুঙ্ক্ষ বিবরণ তাঁদের হাতে না থাকলে এত সহজ হত না হানাদারি। মনে করা হচ্ছে এমন হামলা আরও চালাতে পারে আমেরিকা।
নির্ভুল লেজার-দৃষ্টিএ ক্ষেত্রে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ব্যবহৃত ক্ষেপণাস্ত্রের ধরনটি। মার্কিন কর্মকর্তা এই অস্ত্রগুলিকে ‘ড্রোন-চালিত হেলফায়ার’ বলে উল্লেখ করেছেন। বায়ু থেকে ভূমিতে হামলা চালাতে সক্ষম এ ধরনে ক্ষেপণাস্ত্র এর আগেও ব্যবহার করেছে আমেরিকা। বিশেষত, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর থেকে গত দু’দশকে আমেরিকার সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের অঙ্গ হয়ে উঠেছে এগুলি।
এ ধরনের ক্ষেপনাস্ত্র সাধারণত বহন করে হেলিকপ্টার, স্থলযান , জাহাজ এবং ফিক্সড উইং এয়ারক্রাফ্ট । জাওয়াহিরির ‘মৃত্যুবাণ’ অবশ্য বহন করেছিল একটি মনুষ্যবিহীন ড্রোন।
এর আগে ২০২০ সালের প্রথম দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাগদাদে ইরানি জেনারেল কাসেম সোলেইমানি এবং তারও আগে ২০১৫ সালে সিরিয়ায় "জিহাদি জন" নামে পরিচিত ব্রিটিশ বংশোদ্ভুত ইসলামিক স্টেট জিহাদিকে হত্যা করার জন্য হেলফায়ার ব্যবহার করেছিল বলে মনে করা হয়। হেলফায়ার বারবার ব্যবহারের অন্যতম প্রধান কারণগুলির একটি হল এর নির্ভুল লক্ষ্যভেদের ক্ষমতা।
আরও পড়ুন: 'আমি গেলে বিজেপি কর্মীরা আঘাত পেতেন', রাজভবনের কাছে গিয়েও ঘুরে গেল শুভেন্দুর গাড়ি!
কী ভাবে কাজ করে এই অস্ত্র? অনেক সময়ই যখন কোনও ড্রোন থেকে একটি ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করা হয়, দেখা যায় তখন যিনি অস্ত্র শানাচ্ছেন তিনি হয়তো বসে রয়েছে অন্য কোনও মহাদেশে। ঠিক যেমন এ বারে অস্ত্র উৎক্ষেপক বসে ছিলেন আমেরিকার কোনও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নিরাপদ ঘরে। সেখান থেকেই তিনি লক্ষ্যবস্তুর ভিডিও সরাসরি দেখতে পাচ্ছিলেন। আর সেই ভিডিও তাঁকে সরবরাহ করছিল ড্রোন ক্যামেরার সেন্সরগুলি, উপগ্রহ চিত্রের মাধ্যমে।
স্ক্রিনে "টার্গেটিং ব্র্যাকেট" ব্যবহার করে, ক্যামেরা অপারেটর লক্ষ্যবস্তুকে "লক আপ" করে ফেলেন, এবং তখন ওই লক্ষ্যবস্তুতে লেজার নির্দেশ করা যায়৷ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারছে, ততক্ষণ তা ওই লেজার পথই অনুসরণ করে চলে।
বেসামরিক হতাহতের ঝুঁকি কমানোর জন্য অস্ত্র উৎক্ষেপনেক আগে ড্রোন পরিচালনাকারী স্পষ্ট, অনুক্রমিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। এর আগে বহুবার মার্কিন সামরিক বা CIA হানাদারির ক্ষেত্রে গুলি করার আদেশ দেওয়ার আগে পরামর্শের জন্য সামরিক আইনজীবীদের ডাকা হয়েছে।
লক্ষ্যবস্তু হত্যা বিশেষজ্ঞ এবং সিরাকিউজ ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট ফর সিকিউরিটি পলিসি অ্যান্ড ল এর প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর উইলিয়াম ব্যাঙ্কস বলেন, সামরিক আধিকারিকদের সব সময়ই ভেবে দেখতে হবে, যে ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে অস্ত্র শানানো হচ্ছে তার এবং বেসামরিক নাগরিকের প্রাণের মূল্যের গুরুত্ব কতখানি। জাওয়াহিরির উপর হওয়া হামলাকে তিনি ‘একটি মডেল অ্যাপ্লিকেশনের মতো’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন।
তাঁর দাবি, ‘মনে হচ্ছে এটি খুব সাবধানে এবং পরিকল্পনা করে ঘটানো হয়েছে, যাতে জাওয়াহিরিকে এমন এক অবস্থানে এবং এমন এক সময়ে খুঁজে পাওয়া যায় যখন শুধুমাত্র তাকেই আঘাত করা সম্ভব। অন্য কোনও ব্যক্তির ক্ষতি যাতে না হয় সে দিকে নজর দেওয়া হয়েছিল আগেই।’অনেকই মনে করছেন ‘জাওয়াহিরি স্ট্রাইকে’র ক্ষেত্রে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হেলফায়ারের তুলনামূলক অপরিচিত একটি সংস্করণ R9X ব্যবহার করে থাকতে পারে। তবে এ বিষয়ে নিশ্চিত ভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। এই জ৯ঢ-এ থাকে ছ’টি ব্লেড যা প্রবল গতিশক্তি নিয়ে লক্ষ্যবস্তুর উপর আছড়ে পড়ে তাকে ফালাফালা করে দেয়।
২০১৭ সালে, জাওয়াহিরির সহকারী, আর এক আল-কায়েদা নেতা আবু খায়ের আল-মাসরিকে হত্যা করা হয়েছিল সিরিয়ায়। সে বারও জ৯ঢ হেলফায়ার ব্যবহার করা হয়েছিল বলে জানা গিয়েছে। সে বারের হানাদারির পরে তোলা মাসরির গাড়ির ছবিতে দেখা গিয়েছিল, ক্ষেপণাস্ত্রটি গাড়ির ছাদে একটি গর্ত তৈরি করে ফেলেছে এবং ভিতরের যাত্রীরাও টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ওই এলাকায় কোনও বিস্ফোরণ ঘটেনি। গাড়িটির শরীরেরও অন্য কোনও ধ্বংসচিহ্ন নেই।
জাওয়াহিরির দৈনন্দিন চর্যায় নজর ছিল আমেরিকার—কাবুলে জাওয়াহিরির বাড়িতে হামলা চালানোর আগে মার্কিন গোয়েন্দারা ঠিক কী কী তথ্য সংগ্রহ করেছিল সে সম্পর্কে এখনও বিস্তারিত জানা যায়নি। তবে হামলার পরে, মার্কিন সামরিক কর্তারা বলেন, তাঁদের কাছে জাওয়াহিরির একান্তবাসের জীবনযাপন সম্পর্কে ধারণা করার মতো যথেষ্ট তথ্য ছিল। যেমন, সকাল বেলা একা বারান্দায় দাঁড়ানোর অভ্যাস।বোঝাই যাচ্ছে, মার্কিন গুপ্তচর গত কয়েক মাস, বা অন্তত গত কয়েক সপ্তাহ ধরে জাওয়াহিরির উপর নজর রাখছিল। CIA-এর প্রাক্তন পদস্থ কর্তা মার্ক পলিমেরোপোলস সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, সম্ভবত এই হানাদরির আগে বিভিন্ন গোয়েন্দা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছিল। তার একাধারে যেমন থাকতে পারে সাধারণ গুপ্তচর, তেমনই থাকতে পারে সঙ্কেত পাঠানোর মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
অনেকেই মনে করছেন, গত প্রায় কয়েক মাস বা কয়েক সপ্তাহ ধরেই মার্কিন ড্রোন বা বিমান নজরদারি চালিয়ে গিয়েছে ওই এলাকার উপর। কিন্তু এমনই প্রযুক্তি যে দেশের মাটি থেকে তা শোনা বা বোঝাই যায়নি।পলিমেরোপোলস বলেন, ‘এমন একটা হানাদারি চালানোর জন্য অনেকটা ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। হামলা চালানোর সময় লক্ষ্যবস্তুকে ফাঁকা জায়গায় একা থাকতে হবে, যাতে অন্য কোনও নিরপরাধ মানুষের কোনও ক্ষতি না হয়।’ পাশাপাশি তিনি মনে করেন, গত দু’দশকে মার্কিন গোয়েন্দারা যে ভাবে আল-কায়দার একাধিক ব্যক্তির উপর নজরদারি চালিয়েছেন তাতে এই মুহূর্তে তাঁরা অনেক বেশি অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলেছেন এদের জীবনধারা সম্পর্কে। ফলে সন্ত্রাসবাদী লক্ষ্যবস্তু খুঁজে বের করা আগের থেকে সহজ হচ্ছে। সহজ হচ্ছে নির্ভুল হামলা চালানোও।তাঁর দাবি, গত ২০ বছর ধরে একটু একটু করে আমেরিকা এই প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করেছে। এই মুহূর্তে তারা অসামন্য পারদর্শী। আর সে কারণেই অনেকবেশি নিরাপদ আমেরিকাবাসী।
তবে এই কৌশল থেকেই বোঝা যায়, এ ধরনের মার্কিন অভিযান সব সময় পরিকল্পনা অনুযায়ী করা যায় না। ২০২১ সালের ২৯ অগাস্ট কাবুল বিমানবন্দরের ঠিক উত্তরে একটি গাড়িতে ড্রোন হামলা চালানো হয়েছিল। তার লক্ষ্য ছিল ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর একটি স্থানীয় শাখা। কিন্তু সেই মার্কিন হানায় ১০ নিরীহ নাগরিকের মৃত্যু হয়েছিল। পরে পেন্টাগন এই ঘটনাকে ‘মর্মান্তিক ভুল’ বলে স্বীকার করে নেয়।ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিসের গবেষক বিল রোজিও বহু বছর ধরে মার্কিন ড্রোন হামলার উপর নজরদারি চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘জাওয়াহিরি স্ট্রাইকটি সম্ভবত পূর্ববর্তী হত্যাকাণ্ডের তুলনায় অনেক বেশি কঠিন ছিল। কারণ এ সময় সে দেশে মার্কিন সরকারের উপস্থিতি নেই।’আর এখানেই এই ঘটনার গুরুত্ব। রোজিও বলেন, ‘আফগানিস্তানের মাটি ছেড়ে চলে গিয়েছে আমেরিকা। আর তারপর এটি আল-কায়েদা বা ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে প্রথম হামলা। এটি কিন্তু কোনও সাধারণ ঘটনা নয়।’
ভবিষ্যতে কি আবারও এ ধরনের হামলা হতে পারে?রোজিও-র দাবি, আফগানিস্তানের মাটিতে ফের এ ধরনের মার্কিন হামলা হলে আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু নেই। কারণ, আমেরিকার ‘টার্গেটে’র অভাব নেই। আল কায়দার পরবর্তী নেতা যদি এখনও আফগানিস্তানে না থেকে থাকেন, তিনি অবিলম্বেই সেখানে যাবেন। সেই সঙ্গে রোজিও তোলেন একটি মোক্ষম প্রশ্ন, ‘আমেরিকা কি পরবর্তী হামলাও এত সহজে চালাতে পারবে, সেই ক্ষমতা কি এখনও তার রয়েছে? নাকি কাজটা কঠিন হয়ে যাবে?
প্রজম্মনিউজ২৪/ফারহান আহমেদ
তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে বাঁচবে হাজারও কোটি টাকার সম্পদ
ইসরায়েল থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের দাবিতে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন
বশেমুরবিপ্রবিতে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন
যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় যেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বিএনপি: কাদের
টেকনাফে ১০ কৃষক অপহরণের ঘটনায় আসামি দেলু ডাকাত আটক।
ডাকঘরে পোস্ট মাস্টারের আইসক্রিম ডিলারের ব্যবসা
টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশেই থাকবে : শিল্পমন্ত্রী
নেতানিয়াহুর পদত্যাগ চান ন্যান্সি পেলোসি