২৬ জুন আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস

মাদকের সমস্যা রুখতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই

প্রকাশিত: ২৬ জুন, ২০২২ ১২:২০:১৫ || পরিবর্তিত: ২৬ জুন, ২০২২ ১২:২০:১৫

মাদকের সমস্যা রুখতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই

ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদঃ সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও রোববার (২৬ জুন) পালিত হচ্ছে বিশ্ব মাদক বিরোধী দিবস-২০২২। মাদকের বিভীষিকাময় থাবা থেকে বাঁচতে এবং সবাইকে সচেতন করতে ২৬ জুন পালিত হয় বিশ্ব মাদকমুক্ত দিবস। এই দিবসটিকে আরো বলা হয় আন্তর্জাতিক মাদক বিরোধী দিবস এবং ওষুধের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার বিরোধী দিবস।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৮৭ সালের ৪২তম অধিবেশনে পৃথিবীকে মাদকের ভয়াবহ প্রভাব থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে প্রতিবছর ২৬ জুন মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরের বছর থেকে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। আমাদের সমাজের প্রতিটি স্তরে বিচরণ করছে সর্বনাশা মাদক। ঘুণে পোকার মত কুরে কুরে খাচ্ছে মানব অস্থিমজ্জা। অজগরের ন্যায় হা মুখে খাওয়ার উপক্রম করছে গোটা মানব জাতিকে। এ ভয়ানক পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব। অভিভাবকরা আতঙ্কিত, উৎকণ্ঠিত। তারা শংকিত কখন মাদকের স্রোতে দিক হারিয়ে নেশার জালে আটকা পড়ে যায় তাদের প্রিয় সন্তান। কখন ছোবল মেরে নেশাগ্রস্ত করে পাঠিয়ে দেয় মরণকূপে। এ ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে নিজের সন্তানকে রক্ষার জন্য মা-বাবার সাথে পুরো জাতি আজ শংকিত, আতঙ্কিত।

মাদক এক জটিল সমস্যার নাম, মাদকাসক্তি আধুনিক সভ্যতার ভয়ঙ্করতম ব্যাধিগুলোর অন্যতম। বিশ্বে অগণিত সফল জ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, টেকনিশিয়ান ও অনুরূপ সফল মানুষের জীবন ও পরিবার ধ্বংস হয়েছে মদের কারণে। দিনে দিনে এই সমস্যা আরো প্রকট হয়ে উঠছে। একটা পরিবারে একজন সদস্য মাদকাসক্ত হয়ে পড়লেই সেই পরিবারে নেমে আসে বিভীষিকাময় পরিবেশ। মাদককে ঘিরে যেসব সমস্যা তৈরি হয় সেটা একটা পরিবারকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। মাদক সমস্যা পারিবারিক ক্ষেত্র থেকে ছড়িয়ে যায় সমাজের গন্ডিতে। শেষ পর্যন্ত সেটা রাষ্ট্রীয় সমস্যায় পরিণত হয়।

মাদক কী?
মাদক এমন একটি দ্রব্য, যা খেলে নেশা হয়। গাঁজা, ফেনসিডিল, চরস, ভাং, গুল, জর্দা, হেরোইন, প্যাথেড্রিন, মদ, ইয়াবাসহ সবই মাদকের অন্তর্ভুক্ত। যখন কেউ এসব দ্রব্যাদির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তখনই তাকে মাদকাসক্ত বলা হয়। ১৯৮৯ সালে প্রণীত বাংলাদেশ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মাদকাসক্ত বলতে, শারীরিক বা মানসিকভাবে মাদকদ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তি বা অভ্যাসবশে মাদকদ্রব্য ব্যবহারকারীকে বোঝানো হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এভাবে মাদকাসক্তির সংজ্ঞা দিয়েছে, মাদক ব্যক্তি ও সমাজের জন্য ক্ষতিকারক এবং মাদকের বারবার সেবন দ্বারা উৎপাদিত হয় (প্রাকৃতিক এবং সিন্থেটিক)।

কেন এই আসক্তি?
মানুষকে মাদকাসক্তির দিকে পরিচালিত করার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা, সামাজিক অস্থিরতা, উত্তেজনা, একঘেয়েমি, একাকিত্ব এবং পারিবারিক কাঠামো পরিবর্তনের পরিবেশে ব্যর্থতার সঙ্গে লড়াই করতে অক্ষমতা। তবে মাদকাসক্তদের সংখ্যা বৃদ্ধির মূল কারণ হলো মাদকের সহজলভ্যতা। দ্রুত নগরায়ণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ব্যাপক উন্নয়ন এবং ইন্টারনেট ও তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার, সামাজিক সচেতনতার অভাব ইত্যাদিও মাদকের সমস্যা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। পারিবারিক কলহ, বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে ভেঙে যাওয়া পরিবার, প্রেম ও চাকরিতে ব্যর্থতা থেকে হতাশার কারণেও মাদকাসক্তের হার বাড়ছে। বেশির ভাগ মাদক ব্যবহারকারী ‘পিয়ার প্রেশার’ বা বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়াকে ‘পুল ফ্যাক্টর’ হিসেবে দোষারোপ করেছেন। প্রথমবারের মতো মাদক গ্রহণের জন্য কৌতূহল অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে কাজ করে।

মাদকের ধরন
দেশে বর্তমানে ৩২ ধরনের মাদক সেবন চলছে। এ পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন নামের যেসব মাদক উদ্ধার হয়েছে সেগুলো হচ্ছে হেরোইন, গাঁজা, চোলাই মদ, দেশি মদ, বিদেশি মদ, বিয়ার, রেক্টিফায়েড স্পিরিট, কেডিন, ফেনসিডিল, তাড়ি, প্যাথেড্রিন, টিডি জেসিক, ভাং, কোডিন ট্যাবলেট, ফার্মেন্টেড, ওয়াশ (জাওয়া), বনোজেসিক ইনজেকশন(বুপ্রেনরফিন), টেরাহাইড্রোবানাবিল, এক্সএলমুগের, মরফিন, ইয়াবা, আইএসপিল, ভায়াগ্রা, সানাগ্রা, টলুইন, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, মিথাইল, ইথানল ও কিটোন। এছাড়া ইনোকটিন, সিডাক্সিনসহ বিভিন্ন ঘুমের ট্যাবলেট, জামবাকসহ ব্যথানাশক ওষুধ কিংবা টিকটিকির লেজ পুড়িয়ে কেউ কেউ নেশা করে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

মাদকাসক্তির বিভিন্ন কারণ চিহ্নিতঃ ১.সমবয়সীদের চাপ ২.হাতের কাছে মাদকদ্রব্য পাওয়া অর্থাৎ মাদকের সহজলভ্যতা ৩.বেকারত্ব ও কর্মক্ষেত্রে ব্যর্থতা ৪.আর্থ-সামাজিক অস্থিরতা ৫. মাদকের কুফল সম্পর্কে অজ্ঞতা ৬.সমাজে ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ৭.পারিবারিক কলহ ৮. চিকিৎসা সৃষ্ট মাদকাসক্তি, ৯.কৌতূহল ১০.ধূমপান ইত্যাদি। 

মাদকের নাটের গুরু হচ্ছে সিগারেট।

একটি কথা না বললেই নয় যে, মাদকের নাটের গুরু হচ্ছে সিগারেট। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মাদকাসক্তি ও ধূমপানে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি মারাত্মক বলে উল্লেখ করেছে। তামাকের ধোঁয়ায় ৭ হাজার রাসায়নিক পদার্থ আছে, যার মধ্যে ৭০টি ক্যান্সার সৃষ্টি করে এবং এর একটি উপাদান মাদকের আওতায় পড়ে, সেটি হচ্ছে নিকোটিন। গবেষণায় দেখা যায়, মাদকাসক্তদের মধ্যে ৯৮ ভাগই ধূমপায়ী। অর্থাৎ ধূমপান দিয়ে তারা তাদের নেশা শুরু করে। পরবর্তীকালে তারা গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইন ও কোকেনে আসক্ত হয়।

এক নজরে বাংলাদেশে মাদকের পরিসংখ্যানঃ বাংলাদেশে প্রায় ৭.৫ মিলিয়ন মানুষ মাদকাসক্ত। দেশের বেকার জনসংখ্যারও বেশ বড় অংশ মাদকাসক্ত। মোট মাদকাসক্তদের ৪৮ শতাংশ শিক্ষিত এবং ৪০ শতাংশ অশিক্ষিত। মাদকাসক্তদের প্রায় ৫৭ শতাংশ যৌন অপরাধী, যাদের ৭ শতাংশ হলো এইচআইভি ভাইরাস দ্বারা সংক্রামিত। সারা দেশে প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার মাদক ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা পরিচালনা করছেন, যাদের মধ্যে ২৭ হাজার ৩০০ জন মহিলা।

২০১৯ সালে গড়ে প্রতিদিন ১১৪ জন রোগী সরকারি ও বেসরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্রে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ১০৪ এবং ২০১৭ সালে ৬৯। এটাও অবাক করার মতো বিষয় যে, ২০১৯ সালে মহিলা মাদকসেবীদের সংখ্যা চার গুণ বেড়েছে। ২০১৮ সালে ৯১ জন মহিলা সরকারি সুযোগ-সুবিধায় চিকিৎসা পেয়েছিলেন। এই সংখ্যা বেড়ে ২০১৯ সালে ৩৬০ হয়েছে।

র‌্যাবের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে প্রায় ৬০ লাখ মাদকসেবী রয়েছে। মাদকসেবীদের শতকরা ৯১ ভাগই কিশোর ও তরুণ। এরমধ্যে ৪৫ দশমিক ৭৪ ভাগ বেকার, ৬৫ দশমিক ১ ভাগ আন্ডার গ্র্যাজুয়েট, ১৫ ভাগ উচ্চ শিক্ষার্থী, ২২ দশমিক ৬২ ভাগ ব্যবসায়ী, ১০ দশমিক ৬৭ ভাগ চাকরিজীবী, ৬ দশমিক ৬৭ ভাগ ছাত্র এবং ৬ দশমিক ৮০ ভাগ শ্রমিক। এর পেছনে ব্যয় হওয়া টাকার অংশও কম নয়। ৬০ লাখ মাদকসেবীর পেছনে খরচ করে ৯১১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। তন্মধ্যে কেবলমাত্র ফেনসিডিলই বছরে আমদানি হয় ১৭০০ কোটি টাকার; যা সীমান্ত পথে, যশোর, রাজশাহী, বেনাপোল, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, কুমিল্লা, আখাউড়া ও সিলেট হয়ে দেশে ঢুকছে।

মাদকাসক্তির বহু কারণের মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় অন্যতম। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক অস্থিরতা, দারিদ্র্যের কষাঘাত, বেকারত্বের নৈরাশ্যও কম দায়ী নয়। আর ২০১৮ সালের ৩ মে থেকে  ২০২১ সালে ২০ জুন পর্যন্ত শুধু র‌্যাব সারাদেশ থেকে এক হাজার তিন কোটি ৭৭ লাখ টাকার মাদকদ্রব্য উদ্ধার করেছে। এই দুই বছরে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৩৪ হাজার ৫১৭ জন মাদক কারবারিকে। হেরোইন উদ্ধার করা হয়েছে ৮৪ কেজি। এক কোটি ৫২ লাখ ২৩ হাজার ৬৭৩ পিস ইয়াবা বড়ি, দুই লাখ ৭৪ হাজার ৩০৩ বোতল ফেনসিডিল, আট হাজার ৫৫৪ কেজি গাঁজা, প্রায় দুই কেজি কোকেন, ছয় লাখ ৪৭ হাজার ২১৪টি নেশাজাতীয় ইনজেকশনসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক উদ্ধার করা হয়।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চে সারাদেশে মাদক মামলা হয়েছে সাত হাজার ৬২৫টি। এপ্রিল মাসে এই মামলা কমে দাঁড়ায় এক হাজার ৬৪০টিতে। মে মাসে মামলার সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৪৬৫টি। দেশের বেকার জনসংখ্যারও বেশ বড় অংশ মাদকাসক্ত। মোট মাদকাসক্তদের ৪৮ শতাংশ শিক্ষিত এবং ৪০ শতাংশ অশিক্ষিত। মাদকাসক্তদের প্রায় ৫৭ শতাংশ যৌন অপরাধী, যাদের ৭ শতাংশ হলো এইচআইভি ভাইরাস দ্বারা সংক্রামিত। সারা দেশে প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার মাদক ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা পরিচালনা করছেন, যাদের মধ্যে ২৭ হাজার ৩০০ জন মহিলা।

মাদক ব্যবহারে শরীরে স্বল্প মেয়াদী প্রতিক্রিয়া
মাদক রক্তচাপ কমায় এবং শ্বাস–প্রশ্বাসের মাত্রা হ্রাস করে। মাদক সেবনে ক্ষুধা ও যৌন অনুভূতি দ্রুত হ্রাস পায়। মতি বিভ্রম ঘটে এবং তার মধ্যে সন্ত্রস্ত ভাব দেখা যায়। শ্বাস–প্রশ্বাস ক্ষীণ থেকে ক্ষীনতর হয়। মাদকসেবী ক্রমে ক্রমে নিস্তেজ এবং অবসন্ন হয়ে যায়। হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পেলে রক্তচাপও বৃদ্ধি পায়। চলাফেরায় অসংলগ্নতা ধরা পড়ে। স্মৃতি শক্তি ও মনোযোগের ক্ষমতা সাময়িক হ্রাস পায়। তাই যে কোন মুহুর্তে জীবন বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। চোখ লালচে হয় এবং মুখ শুকিয়ে যায়। উগ্র মেজাজ, নিদ্র্র্রাহীনতা ও রাগান্বিত ভাব দেখা যায়। চামড়ায় ফুসকুড়ি, বমি বমি ভাব এবং নানা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অধিক মাত্রায় মাদক সেবী মাতালের মতো আচরণ করে এবং হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ে।

মাদক ব্যবহারে শরীরে দীর্ঘ মেয়াদী প্রতিক্রিয়া
স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে। এছাড়া মস্তিস্কে কোষের ক্ষয় প্রাপ্তি ঘটতে পারে। স্মৃতি শক্তি লোপ পায়। ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা জ্ঞান লোপ পায়। জীবনের সব বিষয় নিরাসক্ত হয়ে পড়ে। কোন কোন মাদকদ্রব্যে আসক্ত ব্যক্তিকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। মাদকাসক্ত মেয়েদের গর্ভের সন্তানের উপরও ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে এবং সন্তানও মাদকাসক্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

মাদক ব্যবহারে কারণে বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হয়
১.মাদক ব্যবহারে অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ক্ষতি: শ্বাস প্রণালীতে ক্ষতি; খুসখুসে কাশি থেকে যক্ষা, ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া, ক্যান্সার, শ্বাস–প্রশ্বাস ক্ষীণ হওয়া।
২.চোখের ক্ষতি: চোখের মনি সঙ্কুচিত হওয়া, দৃষ্টি শক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়া।
৩.লিভারের ক্ষতি: জন্ডিস, হেপাটাইটিস, সিরোসিস ও ক্যান্সার।
৪.কিডনীর ক্ষতি: কার্যক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, ঘন ঘন সংক্রমণ হওয়া, পরিশেষে কিডনী অকার্যকর হয়ে যাওয়া, হৃদযন্ত্রের কার্যকারীতা হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি।
৫.হূদযন্ত্র ও রক্ত প্রণালীতে ক্ষতি: হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া, হৃদযন্ত্র বড় হয়ে যাওয়া, হৃদযন্ত্রের কার্যকারীতা হ্রাস পাওয়া।
৬.রক্ত কণিকার সংখ্যায় পরিবর্তন: রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, রক্তস্বল্পতা ইত্যাদি।
৭.খাদ্য প্রণালীতে ক্ষতি: রুচি কমে যাওয়া, হজম শক্তি হ্রাস পাওয়া, আলসার, এসিডিটি, কোষ্ঠ কাঠিন্য, ক্যান্সার ইত্যাদি।
৮.ত্বকের ক্ষতি: ভিটামিন ও পুষ্টির অভাবে ত্বক হয়ে উঠে খসখসে শুস্ক। চুলকানী, ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হওয়া, ফোঁড়া, ঘা ইত্যাদি।
৯.যৌন ক্ষমতা ও প্রজননের ক্ষতি: যৌন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, যৌন স্পৃহা কমে যাওয়া, বিকৃত শুক্র থেকে বিকৃত সন্তানের জন্ম, সন্তান জন্মদানে অক্ষমতা।
১০.সিফিলিস, গনোরিয়া, এইডস ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হওয়া। মেয়েদের ক্ষেত্রে এ প্রভাব আরো মারাত্মক। গর্ভের সন্তান বিকৃত হয়ে যাওয়া, মৃত সন্তান প্রসব করা, জন্মকালীন শিশুর স্বল্প ওজন, জন্মের সাথে সাথেই নবজাতকের বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হওয়া।
১১.মস্তিস্ক ও স্নায়ুতন্ত্র এবং মানসিক ক্ষতি: নেশাগ্রস্ত অবস্থায় প্রলাপ বকা, আত্মহত্যার প্রবণতা, পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে অসচেতনতা, মাথা ঘুরানো, চিন্তা শক্তি লোপ পাওয়া, অমনোযোগিতা, স্নায়ুবিক দুর্বলতা, স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, অস্থিরতা ও অধৈর্য অবস্থা, ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন, আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, উদ্বেগ, ভয় পাওয়া, বিষন্নতা ইত্যাদি মানসিক রোগ দেখা দেয় অনেক ক্ষেত্রে।

মাদকসেবীদের চিহ্নিত করার উপায়
মাদকসেবীদের চিহ্নিত করার স্বাভাবিক লক্ষণগুলো হলো চোখে সাধারণ আকৃতির চেয়ে বড় করে তাকানো। হঠাৎ স্বাস্থ্যহানী বা আকস্মিক স্বাস্থ্যবান হয়ে যাওয়া। চোখ ও মুখ ফোলা এবং চোখ লালচে হওয়া। সামান্য বিষয়ে অতিরিক্ত রেগে যাওয়া। অধিক রাত করে ঘুমানো এবং বিলম্বে ঘুম থেকে উঠা। একাকী অন্ধকার নির্জন রুমে সময় কাটানো। উদাসী–উদাসী ভাব এবং সবকিছুতে ভুল করা। নিকটাত্মীয় এবং পরিবার পরিজনদের সাহচর্য এড়িয়ে চলা। সব বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতা, হীনমন্যতায় ভোগা। বিষন্ন খেয়ালে ভাবনার গভীর অন্তরালে কিছু খোঁজা। বেশি বেশি টাকা ব্যয় করা এবং অভিভাবকদের কাছ থেকে জোরপূর্বক টাকা আদায় করা। কখনো খাদ্যের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া আবার কখনো হ্রাস পাওয়া। নিজের শরীর স্বাস্থ্য ও পোশাকের প্রতি খেয়ালহীনতা ইত্যাদি সাধারণ কারণ, যা সহজেই ধরা পড়তে পারে।

পারিবারিক কর্তব্য
পারিবারিক ভাবে মাদক বা ড্রাগসেবীদের চিহ্নিত করতে পারলে, তাদের উচিৎ কাজ হলো মাদকে আসক্তির মূল কারণ খুঁজে বের করা। প্রেম ঘটিত কোন কারণ হলে এর সুস্থ সুন্দর সমাধান দেওয়া। মানসিক পারিবারিক চাপ প্রয়োগ না করে তাকে ভালবাসা ও স্নেহের বন্ধনে আরো নৈকট্যে নিয়ে আসা। পরিবারের কেউ অন্ততঃ তার খুব কাছাকাছি হওয়া এবং বন্ধুত্বের সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়া। সর্বোপরি, তাকে বুঝিয়ে মাদক সেবন থেকে দূরে থাকতে সহায়তা করা।

মাদক সেবনে মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতির কারণগুলো
মাদক জীবন থেকে জীবন কেড়ে নেয়। মাদক সেবন ভীষণ ক্ষতিকর। একজন মানুষের ব্যক্তি জীবন এবং সামাজিক জীবনকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। নিয়মিত মাদক সেবনের ফলে ব্যক্তির মেজাজ-মর্জি, বিচার-বিবেচনা এবং নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণহীনতা, আবেগের উচ্চমাত্রা পরিবর্তন প্রভৃতি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যার কারণে ব্যক্তিগত সমস্যার পাশাপাশি পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা তৈরি হয়। আসুন জেনে নেই মাদক সেবনে কী কী মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতি হয়।

সম্পর্কের অবনতিঃ নিয়মিত মাদক সেবনের ফলে ব্যক্তির মেজাজ দ্রুত পরিবর্তিত হয়। ফলে তারা অল্পতেই বিরক্ত হয় এবং রেগে যায়। যার কারণে অন্যদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি হয় এমনকি কারো কারো সাথে বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয়ে যেতে পারে। আমাদের দেশে প্রায়ই শোনা যায় মাদকসেবীদের হাতে পরিবারের সদস্যরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

বিচার-বিবেচনা লোপ পায়ঃ নিয়মিত মাদক সেবনের ফলে ব্যক্তির সুস্থ চিন্তা-চেতনা সম্পূর্ণ লোপ পায়। যার কারণে কোনো ঘটনা বা পরিস্থিতি কিংবা কোনো বিষয়ে সঠিক বিচার-বিবেচনা, মূল্যায়ন কিংবা বিশ্লেষণ এবং অনুধাবন করার ক্ষমতা স্বাভাবিক থাকে না।

সিদ্ধান্ত হীনতাঃ মাদক গ্রহণের ফলে ব্যক্তির সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হয়। বিচার-বিবেচনা লোপ পাওয়ায় সঠিক সিদ্ধান্তটি সঠিক সময়ে নিতে পারে না তারা। যেকোনো বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলে তাদের আত্মবিশ্বাস কমে যায় এবং আত্মমর্যাদাবোধ বিলুপ্ত হয়।

আসক্তিঃ যারা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে তারা নিজের পরিবারের জন্য যেমন একটি মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা তৈরি করে একই সাথে অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে ওই পরিবারগুলোকে দারুণভাবে ক্ষতির মধ্যে ফেলে দেয়। সমাজের বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে এরা সহজে জড়িয়ে পড়ে।

আত্মনিয়ন্ত্রণ হারানোঃ মাদকাসক্ত ব্যক্তির নিজের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। যদিও সে বুঝতে পারে যে কাজটি করছে তা অন্যায় হচ্ছে তবুও সে নিজেকে অন্যায় থেকে নিবৃত করতে পারে না। আর ধীরে ধীরে তার অন্যায়ের মাত্রা বাড়তে থাকে, তবুও সে নিজেকে অন্যায়ের পথ থেকে ফেরাতে পারে না।

উদ্বিগ্নঃ নিয়মিত মাদক গ্রহণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বদা একটা উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা বিরাজ করে। তাদের মন-মানসিকতা দ্রুত পরিবর্তিত হয়। যেমন, এই খুব উৎফুল্ল আবার এই খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। ফলে কোনো কাজ একাগ্রচিত্তে করতে পারে না।

কাজে আনন্দ লোপ পাওয়াঃ মাদক গ্রহণকারী ব্যক্তি কোন কাজে উৎসাহ পায় না। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার আনন্দ আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে থাকে। আর কোনো কাজ করেই তখন সে আর আনন্দ বা আগ্রহ পায় না।

বিপজ্জনক কাজে জড়িয়ে পড়েঃ মাদক গ্রহণকারী ব্যক্তি ক্রমান্বয়ে মারাত্মক বিপজ্জনক কাজ করতে শুরু করে। যেমন: রাস্তায় বেপড়োয়া গাড়ি চালানো, ট্রাফিক আইন অমান্য প্রভৃতি কাজগুলো দিন দিন বেড়ে যাবে। যার ফলে সড়ক দুর্ঘটনা, অকাল মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটে থাকে।

পরিশেষে বলতে চাই, সীমান্তে মাদক-চোরাচালান রোধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও তৎপর, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। কারণ আমাদের দেশ মাদক-চোরাচালানের রুটগুলোর মাঝামাঝি ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে অবস্থিত। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের (১৯৯০) ধারাগুলো সময়োপযোগী করে এর যথাযথ প্রয়োগ ও কঠোর বাস্তবায়ন করা গেলে মাদকের অপব্যবহার অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব। মাদক-ব্যবসায়ী ও চোরাচালানকারীরা দেশ ও জাতির সবচেয়ে বড় শত্রু। এদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধে সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণ প্রয়োজন। মাদকব্যবহারের ধ্বংসাত্বক প্রভাব সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে এবং মাদকবিরোধী সামাজিক আন্দোলনকে সমগ্র দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মাদকের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করতে মাদকমুক্ত সুস্থ সমাজ গড়ে তোলার কোনও বিকল্প নেই।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি। ইমেইল, drmazed96@gmail.com


প্রজন্মনিউজ২৪/এসএমএ

এ সম্পর্কিত খবর

এলাকার রেজান আলীর প্রতারণার ফাঁদে ফারুক মিয়া

কাশ্মীর উপত্যকায় উত্তেজনা, সেনা অভিযানে একজন নিহত

এক মিনিটেই তাদের বিসিএসের স্বপ্নভঙ্গ

উপজেলা নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রীরা প্রভাব ফেলতে পারেন

গাজীপুরে চিরকুট লিখে স্বামী-স্ত্র‌ীর আত্নহত্যা

কাচিয়ায় ৭নং ওয়ার্ড উপনির্বাচনে প্রার্থীর বিরুদ্ধে জ্বিন প্রতারনা মামলার অনুসন্ধানশ্লিপ পাঠিয়েছে সিআইডি

ঘোড়াঘাটে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চাপমুক্ত আওয়ামী লীগ

ঘোড়াঘাটে দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ, নিহত ২

ইউএসএ বাংলা সাহিত্য সম্মেলনে আসতে শুরু করেছেন দুই বাংলার কবি সাহিত্যিকগন

পঞ্চগড়ে হিট স্ট্রোকে প্রাইভেট কার চালকের মৃত্যু

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন





ব্রেকিং নিউজ