প্রকাশিত: ২১ অগাস্ট, ২০২০ ০২:৫৩:৩০
"কত দিন হলো?" খালামণির শ্লেষপূর্ণ প্রশ্নে হঠাৎ ঘোর ভেঙে গেল ৷ মনের অজান্তেই জবাব দিলাম , "এই তো, এই শরতে সাত বছর পূর্বে ৷"
তা এসব ভেবে বুড়ি হলে চলবে? এবার তো এক জায়গায় নোঙর ফেলো ! আর কতো কাল ভাসবে এভাবে ?" খালামণির এসব কথায় পুরোনো স্মৃতি গুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো , আর আমি ফিরে গেলাম ক্লাস ফোরের দিনগুলোয় ৷
সবে এসেছি এ নতুন গাঁয় , এলাকা একেবারেই নতুন৷ বছরের মাঝামাঝি হওয়াতে নতুন কোনো স্কুলে ভর্তি হওয়া আর পুরোনো স্কুল ছাড়া মুশকিল হলো৷ তবে পড়াশোনায় মোটামুটি ভালো হওয়ায় পুরোনো স্কুলের স্যাররাও ছাড়তে নারাজ৷
আর তাই রোজ এই এলাকা ছেড়ে সেই এলাকার স্কুলে যেতে হতো৷ সকালে প্রাইভেট থাকত, সে কারণে সকাল সকাল বাড়ির থেকে বের হতে হতো সব ছাত্র-ছাত্রীদেরকেই ৷ আর আমাকে আরো সকালে বের হতে হতো৷ একে তো এতো দূর আর তার উপর আমি তো পিচ্চি !
তখন পুরো শরৎকাল ৷
আমি রোজ যে পথ দিয়ে স্কুলে যেতাম সে পথে একদম রাস্তার সাথেই এক বাড়ি ছিল এবং এখনো আছে৷ সেই বাড়ির গেইটে একটা মস্ত বড় শিউলী ফুলের গাছ ছিল ৷ পুরো শরৎ জুড়ে শিউলীতলটা সাদা হয়ে থাকতো ৷ আর ফুলের কমলা ডাঁটাটুকু ফুলটাকে আরো মোহিনী করে তুলতো ৷
গাছটা আমার তুলনায় এতো বিরাট! উফ!! দারুণ লাগত ৷ রোজ সাড়ে ছ'টায় বের হতাম বাড়ি থেকে হাঁটতে হাঁটতে শিউলীতলে গিয়ে ফুল কুড়োতাম, যতটুকু পারা যায় ফুল নিয়ে স্কুলে যেতাম ৷ পায়ের তলায় যদি ফুল পড়ে দলে যায়, সেই ভয়ে ফুল সরিয়ে সরিয়ে হাঁটতাম ৷ কারণ ফুল নষ্ট হতে দেখলে শুধু আমার কেন, সবারই খারাপ লাগে !
সেই বাড়িতে এক ছেলে ছিল ৷ নামটা না ই বা বলি! সেই ছেলে রোজ সকালে জানালার পাশে বসে আরবি পড়তো আর আমি ফুল কুড়োনোর সময় খেয়াল করতাম,
তার পড়া বন্ধ থাকত ৷ মানে সে আমাকে হয়তো দেখতো ৷ তবে যদি কখনো গেইটের ধারে এসে দাড়াতো, লজ্জায় সেদিন আর আমার ফুল কুড়ানো হতো না ৷
খেয়াল করলাম, সে বিকেলের দিকে কথা বলার একটা সুযোগ খুঁজতো ৷ হঠাৎ একদিন সামনে পড়ে গেলাম , আর সে জিজ্ঞাসা করলো , "তোমার নাম কি?"
আমি থতোমতো খেয়ে জবাব দিলাম তড়বড় করে , "ইরশাতজাহানস্মৃতি !!" সে কিছু বুঝলোই না৷ বলে বসলো , "বুঝলাম না " এবার কিছুটা স্বাভাবিক হলাম৷ বললাম, "ইশরাত জাহান স্মৃতি" বলেই দিলাম ছুট ৷ না না ৷ অামি ভিতু ছিলাম না কোনো অামলেই ৷ তবে তার অাকষ্মিক অাবির্ভাব অামাকে অপ্রস্তুত করেছিল ৷
পরদিন বিকেলেও অাবারো নাম জিজ্ঞাসা করলো, অামি স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই ডাক নামটুকু বলে চলে এলাম ৷ কিছু দূর যেতেই বুঝলাম সে বিকট হাসি হাসছে , অার অাগের দিন যে নিজের নাম নিজেই ভুল করেছি তার মজা নিচ্ছে ৷
মেজাজ কিছুটা বিগড়ে গেল ৷ মনে মনে ঠিক করে নিলাম পরের দিন নাম জিজ্ঞাসা করুক, এমন বলা বলব, টেরটা পাবে সোনাচাঁদু ৷ পরদিন সকালে ফুল কুড়োনোর সময় সে গেইটে এসে বসে রইলো ৷ অামি রাগতে পারলাম না ৷ বিকেলেও সে নাম জিজ্ঞাসা করলে অামি নামটুকু বলে চলে এলাম ৷
এভাবে প্রায় পনেরো দিন গেল ৷
আস্তে আস্তে জানলাম সে জঙ্গল বাঁধাল মাধ্যমিকের ক্লাস সেভেনের ছাত্র ৷ পুরো গ্রামে তার সুনাম ,তেমন ভাবে স্কুলেও ! হঠাৎ এক সকালে তাকে গেইটে পেলাম না, জানালায়ও সে নেই ৷ বিকেলেও নেই ! পরদিনও সকালেও একই অবস্থা!! বাহ! এভাবে উধাও হয়ে গেল! একবার কিছুটা বলোও না!
মনে মনে অভিমান হলো ৷ সেদিন বিকেলে সে সাইকেল নিয়ে পিছু করলো, আর জিজ্ঞাসা করতে থাকলো, "ওই ! তোমার নাম কি? " এবার আমার অভিমান রাগে পরিণত হলো, " আপনার মাথায় কি ছিট? তারতুর ছেঁড়া নাকি ? একটা নাম মনে রাখতে পারেন না!?? "
সে আর কিছু বলল না, মাথাটা নিচু করে চলে যেতে থাকলো সাইকেল থেকে নেমে ৷ বাকি তিন বছর আর কোনো কথা হলো না ৷ মাঝে মাঝে সামনা সামনি পড়ে যেতাম, কখনো কখনো চোখে চোখ পড়ে যেত, তবে ফিরিয়ে নিতাম ৷ মকখনো তার চোখের ভাষা পড়তে চাইনি, কখনো নিজে থেকেও বুঝতে চাইনি ৷ আমি এখন বুঝি , সে হয়তো কথা চালিয়ে নেবার জন্য প্রয়োজনীয় কথার বড্ড অভাবে ছিল ,
সেজন্য রোজই ওই এক প্রশ্ন দিয়ে হলেও কথা বলতে চাইত , আর আমি যদি তখন পাল্টা প্রশ্নে তার নামটা শুনতে চাইতাম, তবে হয়তো নতুন কোনো কথা বলতে সে সাহস পেতো! তার পর আমি জঙ্গল বাঁধাল হাই স্কুলে ক্লাস সেভেনে আর সে ক্লাস টেন এ৷
আবার সেই শরৎ এলো ! গত তিন বছরে আর ফুল কুড়ানো হয়নি, তবে কখনো একটা ফুলও পা চাপা দিই নি ৷ হঠাৎই আবার তার নিয়মিত দেখা, অাবার সেই গেইটের ধারে বসে থেকে অপলক দেখা ৷ আর আমার সেই সাড়ে ছ'টাতেই বাড়ির থেকে বের হওয়া ৷ মনের অজান্তেই অাবার শিউলী ফুল তোলা ৷
তার বলতে চাওয়া কথা গুলো নিজের করে ভাবা আর তাকে কিছু বলার সুযোগ না দেওয়া.. ..এসব রোজকার রুটিনের অংশ হয়ে গেল ! হঠাৎ এক সকালে সে কোথা থেকে দৌড়ে এসে রেগেমেগে বলল, "ওই , ফুল গুলো নষ্ট করছো কেন? জানো না , ফুল গুলো আমার পছন্দের?? " এতোটুকু কথায় রাগ হলো খুব, কারণ অামি তখনও ফুল কুড়োচ্ছি আর সে এটা দেখছে, তবে এখানে নষ্টের প্রশ্ন কেন এলো?
আমি বলে বসলাম, " এতই যখন দরদ, তা সকালে আমার আগে এসে ফুল গুলো নিয়ে বালিশের ধারে রাখলেই তো হয় ! তবে তো আর কেউ নষ্ট করতে আসে না ! যত্তোসব ! " রাগে গজগজ করে হাতের ফুল গুলো তার গায়ে ছুঁড়ে হাঁটা দিলাম, অাবার কিছু দূর গিয়ে পিছনে খেয়াল করে দেখলাম , সে ফেলে আসা ফুল গুলো তুলে নিচ্ছে !
যা খুশি করুক ! আমার কি! এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে রাস্তায় তার অাব্বুর সাথে দেখা , গ্রামের মধ্যে অন্যতম ভালো মানুষ অার আমাকে খুবই ভালো বাসতেন ৷ অথচ, আমি জানতামই না যে ইনিই ওই ছেলের আব্বু ! যা হোক, স্কুলে গিয়ে প্রাইভেট পড়ে যেই অ্যাসেম্বলির জন্য মাঠে এসেছি, দেখলাম সে তার আরো চার পাঁচটা বন্ধুদের নিয়ে গল্প করেই যাচ্ছে ৷ সকালে ওই ভাবে কথা বলার জন্য নিজের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করছিল , ভাবলাম গিয়ে সরি টরি বলে অাসি ৷
তবে এর জন্য তাকে তো একা দরকার, আর কেউ থাকলে তো হবে না! আমি তাই খুব কাছে দিয়েই ধীর পায়ে হেঁটে যেতে লাগলাম,যদি সে একবার তাকায়, তবে ডেকে নেব ৷ অথচ দেখো ! কি ছেলে রে বাবা !! একবারও তাকালোই না! কি এমন গল্প করছে রে! হয়তো খেয়াল করে নি! এসব ভেবে তার একা হওয়ার অপেক্ষা করছিলাম ৷ অথচ, অ্যাসেম্বলি শেষ হলেও তাকে একা পাওয়া গেল না !
হুহ !
আমি কিছু আর বললাম না ক্লাস করতে লাগলাম ৷ ভাবলাম হয়তো বেশি বলে ফেলেছি ৷ তাই কষ্ট পেয়েছে ৷ যাহোক, টিফিনে ঠিকই সরি বলব, এই জন্য ক্লাস শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম ৷ প্রথমে বাংলা, ইংরেজি, গনিত, এখন বিজ্ঞান ! আর তারপর টিফিন.. আর একটু অপেক্ষা ৷ তখন স্কুলে বড় ম্যাডাম বিজ্ঞান নিতো ৷ আমাদের ক্লাস প্রায় শেষ ৷ তখনই ম্যাডামের ফোন বেজে উঠলো, ম্যাডাম ফোন তুললেন, " হ্যালো ! ওয়ালাইকুম আসসালাম! কি বলছেন?? কখন? কি করে? আমাদের স্কুলেরই ? তিন জন ?
আচ্ছা আমি দেখছি ৷ কি একজন খুব সিরিয়াস ? এই পর্যন্ত বলেই ম্যাডাম অামাদের সরি বললেন ৷ আমরা জানতে চাইলাম, " কি হয়েছে?" ম্যাডাম বলতে লাগলেন , "আমাদের স্কুলের তিনটি ছেলে অ্যাকসিডেন্ট করেছে একজন খুব খারাপ অবস্থায় ৷" বলেই চেয়ার ছেড়ে রীতিমতো ছুটলেন হেডস্যারের রুমে ৷
আমি আমার হৃদকম্পন অনুভব করলাম অার সাথে বাঁ পাশে এক তীব্র যন্ত্রণা , তখন ই টিফিনের চুড়ান্ত ঘণ্টাধ্বনি ! হৃদপিন্ডের ধাক্কা আর ঘণ্টার শব্দ মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল ! " আমার আর "সরি" বলা হয়নি ! কারণ "সরি" শুনবার মানুষটা পরপারে পাড়ি জমিয়েছে সেদিন ৷
এই আপসোস হয়তো অামি সারা জীবনেও মিটাতে পারব না, চলে যাবার অাগে এভাবে ঝগড়া করে কেন গেল?
তবে কি প্রিয় মানুষ গুলোকে যাবার অাগে দূরে রাখার চেষ্টা করেছিল? তার যাবার পর শুনেছিলাম, সেদিন সকালে নাকি সে তার আব্বুর সাথেও ঝগড়া করেছিল, আর সেই ঝগড়াই ছিল তার পরিবারের সাথে প্রথম আর শেষ ৷ "
খালামণির দ্বিতীয় ধাক্কায় অতীত ছেড়ে বর্তমানে ফিরে এলাম, "কি রে এখনো কি ভাবছিস? "
" আচ্ছা খালামণি, শরৎ আসতে আর কতো দেরি? " খালামণি হাতে মাস গুনে বললেন , "এই তো আর এক দেড় মাস !"
"আচ্ছা, এখন কি একটাও শিউলী ফুল ফোঁটে ?" "এই সাত সকালে ফুল দিয়ে কি করবি??"
"একটু বিছানায় ছড়িয়ে রাখতাম! আর একটু অপেক্ষা করতাম !"
লেখকঃইশরাত জাহান স্মৃতি
গাজীপুরে চিরকুট লিখে স্বামী-স্ত্রীর আত্নহত্যা
তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে বাঁচবে হাজারও কোটি টাকার সম্পদ
গ্রাহকের ২ লাখ টাকার ফ্যামিলি ট্রিপের স্বপ্ন পূরণ করলো রিয়েলমি
বাস যাত্রী শূণ্য, মেট্রোতে চড়তে মানুষের ভিড়
মুস্তাফিজের দুর্দান্ত ক্যাচের প্রশংসায় গিলক্রিস্ট
সৌদিতে ঈদুল ফিতরের তারিখ ঘোষনা
আপনি কি জানেন মর্যাদা পূর্ণ রাত কী
Severity: Notice
Message: Undefined index: category
Filename: blog/details.php
Line Number: 417
Backtrace:
File: /home/projonmonews24/public_html/application/views/blog/details.php
Line: 417
Function: _error_handler
File: /home/projonmonews24/public_html/application/views/template.php
Line: 199
Function: view
File: /home/projonmonews24/public_html/application/controllers/Article.php
Line: 87
Function: view
File: /home/projonmonews24/public_html/index.php
Line: 315
Function: require_once