প্রযুক্তির অন্ধকারে আচ্ছন্ন শিশু কিশোর

প্রকাশিত: ০৭ অক্টোবর, ২০১৮ ০৬:৩১:০৬

প্রযুক্তির অন্ধকারে আচ্ছন্ন শিশু কিশোর

আসিফ ইকবালঃআমি হব সকালবেলার পাখি, সবার আগে কুসুমবাগে উঠব আমি ডাকি- কবিতার লাইন দুটি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের।

তিনি সবার আগে ঘুম থেকে ওঠার ইচ্ছা পোষন করেছিলেন।  প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছিল এলার্ম ঘড়ি সকালে ওঠার জন্য।এখন সেই প্রযুক্তির কারনে ই সকালে ঘুম থেকে ওঠা হয় না। ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, আর ইমোর নোটিফিকেশন টোনের শব্দে কেটে যায় রাত। আর সকাল গুলো কেটে যায় ঘুমিয়ে। দিনের কাজ গুলো শুরু হয় দেরিতে। আর সময় মত শেষ করা হয় না পরিক্ষার সিলেবাস।সব মিলিয়ে অপচয় হয় আমাদের মূল্যবান সময়।  নষ্ট হয় স্বাস্থ্য।অপব্যবহার হচ্ছে মেধার।

বছরের শুরুর হিসেবে সারা বিশ্বে ১৮৬ কোটি লোক ফেসবুক ব্যাবহার করেন। সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারীর হিসেবে ঢাকা এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চল মিলিয়ে প্রায় ২ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ সক্রিয়ভাবে ফেসবুক ব্যবহার করছেন।

যুক্তরাজ্যে নিবন্ধিত ‘উই আর সোশ্যাল লিমিটেড’ও  কানাডার ‘হুটস্যুট ইনকরপোরেশনের” এক যৌথ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

আর এই ফেসবুক ব্যাবহার কারির অধিকাংশ ই কিশোর এবং যুকব যাদের বয়স ১৪-২৫ বছর এর মধ্যে। মানুষের জীবন গড়ার এ গুরুত্বপূর্ন সময় নষ্ট হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় কাজে।জীবন গড়ার এই সময়ে আমাদের দেশের যুবক রা  বই এর পাতা ছেড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ফেসবুক এর নিউজফিডে আর ম্যাসেঞ্জারের ইনবক্সে ইনবক্সে।

অধিকাংশ কিশোর কিশোরী রাত ১০ টা থেকে ২.৩০ বা ভোর রাত পর্যন্ত ফেসবুক ব্যাবহার করে। ফলে তাদের সকালে ঘুমাতে হয়  পর্যাপ্ত সময়। এতে যেমন বাড়ছে স্কুল কলেজ ক্লাস বন্ধ দেওয়ার প্রবনতা ঠিক তেমন স্বাস্থ্যহানি ও ঘটছে মারাত্বক ভাবে।

কিশোর রা ফেসবুক আর মেসেঞ্জারের কল্যানে জড়িয়ে পড়ছে প্রেমে আর  প্রেম থেকে বাড়ছে হতাশা, হতাশা থেকে নেশা,  শেষে আত্নহনন এর ঘটনা ও কম ঘটছে না।

প্রযুক্তির কল্যানে আর একটা মারাত্বক বিষয় আমাদের শিশু কিশোর দের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। যা সরাসরি আমাদের মানবতার জন্য হুমকি সরূপ । আর তা হল পর্নগ্রাফি। শিশু -কিশোর, আবাল- বৃদ্ধ -বনিতা ,আজ প্রযুক্তির বিষময় ফল হিসেবে সবার হাতে পৌছে গেছে পর্নগ্রাফি। যা নষ্ট করছে আমাদের চিন্তা শক্তি, শারীরিক শক্তি। বাড়াচ্ছে হতাশা। মানুষের ভালবাসার সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে।বিবাহ বিচ্ছেদ এর ঘটনা ও কম ঘটছে না।

আর যদি বলা হয় বর্তমানে ধর্ষন, শিশু ও নারী নির্যাতন এর ঘটনার জন্য পর্নগ্রাফি ই দায়ি তাহলে মনে হয় ভুল বলা হবে না। বর্তমান যুগে যোগাযোগের সহজমাধ্যম ইন্টারনেট। আর এ ইন্টারনেটেই যখন সহজ প্রবেশাধিকার দিয়ে দেয় ৪৫০ মিলিয়ন পর্নোগ্রাফিক সাইটের তখন প্রিয় সন্তানের জন্য  অভিভাবকের উদ্ধিগ্নতা প্রশমিত করার যেন কোন উপায় ই থাকে না। আর যখন পরিসংখ্যান বলে, ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১৬ থেকে ১৯ বছর বয়সের ৩৮ ভাগই ইন্টারনেটে আসক্ত তখন অভিভাবকদের ভাবতে হয় অনেক কিছু। আর সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনের কারণে  ৫-৭ বছরের ইন্টারনেট ব্যবহারকারী শিশুর ১২ শতাংশ এবং ৮-১৭ বছরের ১৬ শতাংশ শিশুর সামনে ইনডেক্স করা এই ৪৫০ মিলিয়ন পেইজগুলোর সাজেশন্স চলে আসে, শিশু মন পরিচিত হয় পর্নোগ্রাফি নামক ভয়াল মানসিক বিকারের সাথে, পরিসংখ্যানের এ তথ্যে প্রযুক্তিকে অভিশাপ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয় অভিবাকদের কাছে।

বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদে পর্ণগ্রাফি আসক্তির কারনে মানুষ যে শারীরিক এবং মানসিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে- এ ব্যাপারে অনেকেরই এখনো ও স্বচ্ছ কোন ধারনা হয়নি। সাম্প্রতিক  এক গবেষণায় দেখা গেছে শৈশব বা কৈশোরেই পর্ণে আসক্ত হয়ে গেলে পরবর্তীতে মানুষের কাছে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের মত ব্যাপারগুলো খুব গতানুগতিক বা সাধারন আচরন বলে মনে হয়। এসব আচরণের মাঝে যে বীভৎসতা কিংবা কদর্যতা আছে- তা আর পরবর্তীতে পর্ণ আসক্ত মস্তিষ্কটি আলাদাভাবে বুঝতে পারে না। আর পর্ণ আসক্তদের অস্বাভাবিক আচরণের কারনে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে আগামী দিনের স্বপ্ন শিশুরাই।

মনোবিজ্ঞানীরা বলছে, পর্নোগ্রাফি অন্যান্য মাদকের মতোই একটা আসক্তি। মাদক যেমন মাদকাসক্তকে প্রভাবিত করে, নীল ছবিগুলোও মানুষের মস্তিষ্কে ঠিক সেভাবেই প্রভাব ফেলে। ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় পর্নোগ্রাফি আসক্তি মাদকের চেয়েও ভয়ানক হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। সাধারণত ১৩ বছরের কিশোররা ইন্টারনেট পর্নোতে বেশি আগ্রহী এবং তারা মেয়েদের যৌনতার একটি বিষয় হিসেবে চিন্তা করতে শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোবিজ্ঞানী জেফরি সেটিনোভার বলেন, আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের বুঝতে সাহায্য করেছে, পর্নোগ্রাফির আসক্তি হেরোইনের মতোই।

প্রসঙ্গত, বিজ্ঞান গবেষকদের দাবি, যাঁরা অধিক মাত্রায় অশ্লীল দৃশ্য উপভোগ করেন, তাঁদের মগজের ধূসর পদার্থ উল্লেখযোগ্য হারে কমতে থাকে।

 ‘দ্য গার্ডিয়ান’পত্রিকা সূত্রে জানা গিয়েছে, পরীক্ষা থেকে গবেষকরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে অবিরল যৌন দৃশ্য উপভোগ করলে মস্তিষ্কে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে। আমরা শঙ্কিত যে আগামী প্রজন্ম একটি মেধাহীন ও অসুস্থ সমাজ উপহার দিবে।

আমদের শিশু কিশোর রা আগে অবসর সময় খেলা ধুলা করে, বই পড়ে কাটাতো।কিন্তু প্রযুক্তির কল্যানে এখন তারা আর মাঠে যায় না। দিনের শেষে গোধুলির আলোতে বসে বই পড়ার সৌভাগ্য আর তাদের হয় না, ফলে আগামি প্রজন্ম যেমন শারীরিক ভাবে অক্ষম হয়ে গড়ে উঠছে তেমনি, তারা জ্ঞানে ও সমৃদ্ধ হতে পারছে না।

তবে কেউ ভবিষৎ প্রজন্মের ভবিষৎ নিয়ে প্রশ্ন তুললে খুব একটা ভুল করবেন না।

প্রযুক্তির কল্যানে মানুষ অনেক কাজ দ্রুত করতে পারছে ফলে মানবজাতি  এগিয়ে যেতে পারেছে দ্রুত, কিন্তু প্রযুক্তির ব্যাবহার ধীরে ধীরে আমাদের প্রজন্মকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। তারা একেবারে ই শারীরিক ভাবে অক্ষম হয়ে গড়ে উঠছে।

আমার প্রযুক্তি তৈরি করেছি আমদের ব্যাবহারের  জন্য কিন্তু এখন প্রযুক্তি ই আমাদের ব্যাবহার করছে।

সৃষ্টির শুরু থেকে ই মানুষের নিজেকে প্রকাশ করার সুপ্ত বাসনা রয়েছে আর সোস্যাল মিডিয়া গুলো সেই বিষয়টিকে পুজি করে খুলে বসেছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যাবসা। মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা সময় নষ্ট করছে ফেসবুকে, মেসেঞ্জার আর ইমো তে।

ফলে তারা হারাচ্ছে তাদের কাজের সময়।

মেধাকে শানিয়ে নেওয়ার সময়।

এই ভাবে প্রযুক্তি আমাদের ব্যাবহার করতে থাকলে ভবিষৎ প্রজন্মের ভবিষৎ নিয়ে চিন্তা করার মত ও প্রান শক্তি অবশিষ্ট থাকবে কিনা তা এখন ভাবার বিষয়।

প্রজন্মনিউজ২৪/এম বিল্লাহ

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন