বিশ্ববিদ্যালয় পথ দেখায়, রুদ্ধ করে না: নজরুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২৪ মার্চ, ২০২৪ ০৪:৩২:১৮

বিশ্ববিদ্যালয় পথ দেখায়, রুদ্ধ করে না: নজরুল ইসলাম

বিশ্ববিদ্যালয় মুক্ত চিন্তা করতে শেখায়, চিন্তার প্রক্রিয়াকে বিশেষ কোন ফ্রেম বা গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে না 

তাবৎ দুনিয়ার নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সব ধরনের চিন্তা, মত, পথের অবাধ প্রস্ফুটন স্বীকার করা হয়, যত্ন আত্তির করা হয়। সেকুলার, রিলিজিয়াস সব চিন্তা সেখানে আছে। হার্ভাড, অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজসহ নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বায়োলজি যেমনি আছে তেমনি থিওলোজিও আছে। এসব জায়গাতে যেমন কট্রর নাস্তিক আছে তেমনি আছে কট্রর ধার্মিক মানুষ। অক্সফোর্ডের কথাই ধরুন, একদিকে আছেন ইভলুশনারি বায়োলজিস্ট আধুনিক নাস্তিক্যবাদের অন্যতম গুরু প্রফেসর রিচার্ড ডওকিন, অন্যদিকে আছেন ইসলামপন্থিদের অন্যতম গুরু তারিক রামাদান। তারা যার যার জায়গায় নিজ নিজ বিশ্বাস ও চিন্তা অনুযায়ী কাজ করেছেন। কই সেখানে তো কোন সমস্যা হয় না। 

যদ সমস্যা এই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা অদ্ভুত ডিসকোর্স তৈরি হয়েছে বা বলা ভাল যে,ধর্ম ও ধার্মিকতা প্রগতির অন্তরায়। হ্যা কেউ এটা ভাবতেই পারেন। এই ভাবার অধিকার নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সাথে সাথে একজনের অধিকার ও আছে এটা ভাবা যে ধর্ম প্রগতির অন্তরায় নয়, বরং তা প্রগতির জন্য সহাযক কিংবা প্রগতি অর্জনে অবদান রাখতে পারে। আদতে পারে কি পারে না তা পরের কথা। কিন্তু ভাবনাটা ভাবতে দেওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিউটি এই জায়গাতেই।

কিন্তু এই দেশের বিশ্ববিদ্যালয় যেন সেই স্পেস দিতে নারাজ। বোরকা পরলে, হিজাব পরলে এই দেশে আইডিন্টিফিকেশনে সমস্যা হয়, অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, হার্ভাডে হয় না। এই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে কোরআন তেলাওয়াত করলে সমস্যা হয়, হার্ভাড, অক্সফোর্ড ক্যামব্রিজে হয় না। এই দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পন্ডিতদের মোটাদাগে বিশ্বাস করে না, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তাদের যে দূরত্ব তার দায় এই পন্ডিতদের এই ডাবল স্টান্ডার্ড নীতি। এই পন্ডিতরা অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, হার্ভাডে বা এ জাতীয় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে এসে আবার স্ববিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এই দ্বিমুখী আচরণ এই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বড় সংকট। 

অর্থনীতির শিক্ষক শিক্ষার্থীরা অর্থনীতির বিষয়ে সেমিনার করতে পারেন, আলোচনা সভার আয়োজন করতে পারেন। বিজনেসের শিক্ষক শিক্ষার্থীরা বিজনেস নিয়ে সভা করতে পারেন। ঠিক তেমনই পলিটিক্যাল সায়েন্সের লোকেরা রাজনীতি বিষয়ক, সাহিত্যের ছাত্ররা সাহিত্য বিষয়ক, নাট্যকলার শিক্ষার্থীরা নাটক সিনেমা সংশ্লিষ্ট এবং বিজ্ঞানের ছাত্র শিক্ষকরা বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা, সেমিনার সিম্পোজিয়াম করতে পারেন। তো বাপু আরবী, ইসলামিক স্টাডিজের ছাত্র শিক্ষকরা কি নিয়ে আলোচনা করবেন, সেমিনার করবেন? একটু বলেন তো? তারা কি ফিজিক্স, ক্যামেস্ট্রি বা বায়োলজির বিষয় নিয়ে সেমিনার করবেন? 

বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবী, ইসলামিক স্টাডিজ ডিপার্টমেন্ট চালু করবেন, ছেলেমেয়েদের তা পড়াবেন, প্রতি বছর এই বিষয়ে গাদা গাদা ডিগ্রি দিবেন, এমফিল দিবেন, পিএইচডি দিবেন, কিন্তু এই বিষয়ক কোন অনুষ্ঠান করতে দেবেন না, ওতে জাত যাবে! তাইলে এই বিষয়গুলি পড়ানো হয় কেন? আর বটতলা! এটা কি কোন টোটেম না ট্যাবু? বটতলার নিশ্চয়ই একটা লিগ্যাসি আছে। কিন্তু সেই লিগ্যাসির সাথে ধর্মের কি কোন বিরোধ আছে? মুক্তিযুদ্ধের সাথে ধর্মের কোন বিরোধ ছিল না। ধর্মের স্লোগান দিয়েই এ দেশের অধিকাংশ মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছে। ধর্মকে শোষণের হাতিয়ার মনে করা সমাজতান্ত্রিক মননের অল্প সংখ্যক মানুষই কেবল মুক্তিযুদ্ধ করেনি, নিশ্চয়ই এই অল্প সংখ্যক মানুষের অবদান স্বীকার্য, কিন্তু বৃহত জনগোষ্ঠীর চিন্তা ও বিশ্বাসকে আমলে না এনে বরং উল্টো তাকে মুক্তিযুদ্ধের সাথে সাংঘর্ষিক হিসাবে দেখানোটা বুদ্ধিবৃত্তিক জোচচুরি ও কপটতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের থিমের সাথে তা কোন ভাবেই যায় না।

কেবল আরবী বা ইসলামিক স্টাডিজ নয়, কেবল কোরআন তেলাওয়াতের অনুষ্ঠান নয়, সংস্কৃত, পালি বা বাইবেলের তেলাওয়াত যদি এই বটতলায় হয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কি হতে পারে? হয়ত বটতলার এক পাশে কেউ একজন গীতা পাঠ করবে, আর এক পাশে কেউ একজন কোরআন,বাইবেল বা ত্রিপিটক পাঠ করবে এবং ঠিক তার উল্টো পাশেই কেউ একজন মার্কস, লেনিন বা গ্রামসির উদৃতি দিয়ে ধর্মের সমালোচনা করবে। এটিই বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃশ্য। এটিই বিশ্ববিদ্যালয়। এই ধারণা যার মধ্যে নেই, এই ধারণা যে লালন করে না, সে যে-ই হোক বিশ্ববিদ্যালয় কী তা বোঝে না, বিশ্ববিদ্যালয় তার বোঝা হয়ে ওঠেনি। এই দেশের বিশ্ববিদ্যালয় যে কেন হাত, পা মেলে দাড়াতে পারছে না এইসব ঘটনায় তা কিছুটা হলেও আন্দাজ করা যায়। সংকীর্ণতার উপর ভর করে বাঁচা গেলেও বড় হওয়া যায় না। 

মোঃ নজরুল ইসলাম
অধ্যাপক,রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়


প্রজন্মনিউজ২৪/এফএইচ

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন





ব্রেকিং নিউজ