গাজার জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক অনাহারে থাকছে

প্রকাশিত: ২০ মার্চ, ২০২৪ ০৪:৫২:১৩

গাজার জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক অনাহারে থাকছে

অনলাইন ডেস্ক: গত সোমবার, ১১ই মার্চ ভোর থেকে আরব বিশ্বে যখন মুসলমানদের পবিত্র রমজান মাস শুরু হয়েছে, তখন গাজার বাসিন্দারা মুখোমুখি হয়েছেন এক নিষ্ঠুর বাস্তবতার।

যে রমজান মাসে মুসলমানরা সারা দিন রোজা রাখেন, অর্থাৎ খাবার-পানি খাওয়া থেকে বিরত থাকেন, সেটি গাজাবাসীর সামনে দুর্ভিক্ষ হয়ে এসেছে।

গত পাঁচ মাস ধরে যুদ্ধের মধ্যে রয়েছেন গাজার বাসিন্দারা। বাস্তবিক অর্থে এখনো সেখানকার সব মানুষ এখন খাদ্য সহায়তার ওপর নির্ভর করেই বেঁচে আছেন।

‘’এখানকার মানুষজন ইতোমধ্যেই মাসের পর মাস জুড়ে অনাহারে থাকছে,’’ বলছিলেন গাজা শহরের আল-শিফা হাসপাতালের জরুরি বিভাগের উপ-পরিচালক ড. আমজাদ ইলেইয়া।

‘’বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সারা শহর জুড়ে তারা খাবার খুঁজে বেড়ায়, কিন্তু কোথাও পায় না,’’ তিনি বলছেন।

গত বছরের ৭ই অক্টোবর হামাসের হামলার পাল্টা জবাব হিসাবে ইসরায়েলের বোমাবর্ষণের ফলে গাজার খাদ্যের সব অবকাঠামো আর ক্ষেতখামার ধ্বংস হয়ে গেছে।

সাহায্য সংস্থাগুলো বলছে, সরবরাহ ট্রাকগুলো ঘিরে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর অতিরিক্ত তদারকির কারণে জনগণের কাছে সাহায্য পৌঁছাতে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে ।

বিশ্বে যে সংস্থাটি দুর্ভিক্ষের বিষয়ে ঘোষণা দিয়ে থাকে, সেই ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) জানিয়েছে, এই সোমবার নাগাদ ১১ লাখ মানুষ - যা গাজার জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক - ইতোমধ্যেই অনাহারে থাকছে।

বাকি যারা আছে, তারাও জুলাই মাস নাগাদ দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়বে।

খাদ্যের এই সংকট সবচেয়ে বেশি গাজার উত্তরাঞ্চলে। গত বছরের রমজানের মতো এবার আর তারা সেহরিতে পেট ভরে খেতে পারছেন না বা ইফতার করে ক্ষুধা মেটাতে পারছেন না।

রমজানে যেখানে সড়কগুলো নানাভাবে সজ্জিত থাকত, ড্রাম বাজত বা উদযাপনের নানা আয়োজনে ভরে থাকত, সেখানে এখন ধ্বংস, মৃত্যু আর খাবার খোঁজার প্রতি দিনের লড়াই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। আটা বা গমের দাম পাঁচগুণ বেড়েছে।

‘’গত রমজানের কথা মনে আছে, অনেক ভালো ভালো খাবার ছিল ..শরবত, খেজুর, দুধ ..আপনি যা খেতে চান, সব কিছুই ছিল’’, বলছিলেন ৫৭ বছর বয়সী একজন মা নাদিয়া আবু নাহেল, যিনি ১০টি শিশু নিয়ে একটি যৌথ পরিবারের দায়িত্বে আছেন।

‘’এই বছরের সাথে তুলনা করলে এটা যেন বেহেস্ত আর দোজখের পার্থক্যের মতো’’, তিনি বলছেন।

‘’এখন শিশুরা রুটির একটা টুকরার জন্য আকাঙ্ক্ষা করে থাকে, এই খাবারটাও তাদের কাছে এখন স্বপ্নের মতো। তাদের হাড়গোড় দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। তাদের মাথা ঘোরে, হাঁটতে কষ্ট হয়, সবাই শুকিয়ে যাচ্ছে", বলছেন নাদিয়া আবু নাহেল।

দাতব্য সংস্থা পভার্টি চ্যারিটি কেয়ারের তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে উত্তর গাজা এলাকায় অপুষ্টি বা পানিশূন্যতায় অন্তত ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে ২৩টি শিশু রয়েছে।

যদিও উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি হাসপাতালের চিকিৎসকদের মতে, এই সংখ্যা আরও বেশি বেশি হবে।

আল-শিফা হাসপাতালে অপুষ্টিতে ভোগা যে শিশুদের এই রমজান মাসে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে একটি শিশু ছিল ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে।

আরেকটি দুগ্ধপোষ্য শিশুর বয়স ছিল মাত্র চার মাস, যার মা কিছুদিন আগে মারা গেছে, কিন্তু এখন তাকে দুধ কিনে দেওয়ার মতো কেউ নেই। ১৮ বছর বয়সী আরেকটি মেয়ে রয়েছে, যে এর মধ্যেই মৃগী রোগে ভুগতে শুরু করেছে।

‘’সে এর মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তার জন্য দরকারি কোনও ওষুধই আর খুব বেশিদিন পাওয়া যাবে না। আর তার পরিবারের খাবারও নেই’’, ড. ইলেইয়া বলছেন।

‘’শেষ দিকে তার শরীর খুব ক্ষীণ হয়ে পড়েছে, শুধুমাত্র তার হাড় আর চামড়া দেখা যাচ্ছে, সেখানে কোন চর্বি নেই।’’

আল-শিফা হাসপাতালে তার তত্ত্বাবধানে বিছানায় শুয়ে রয়েছে ১৬ বছর বয়সী রাফিক দোঘমাউশ। তার শরীরের হাড় দেখা যাচ্ছে আর তার একটি পা হাঁটু থেকে কেটে ফেলা হয়েছে। তার শরীরের সাথে একটি কোলোস্টমি ব্যাগ লাগানো ছিল।

‘’আমার সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে’’, বলছিল রাফিক।

প্রতিটি শব্দের মাঝে শ্বাস নেওয়ার জন্য ধীরে ধীরে সে কথা বলছিল।

"আমি এতটাই দুর্বল যে আমি আমার শরীরকে একপাশ থেকে অন্য দিকে সরাতে পারি না। আমার চাচাকে এটা করে দিতে হয়!", জানায় রাফিক।

রাফিক দোঘমাউশকে সহায়তা করছেন তার চাচা। ইসরায়েলি বিমান হামলায় আহত হওয়ার পর রাফিকের একটি পা হাঁটু থেকে কেটে ফেলা হয়েছে।

তার চাচা মাহমুদ জানিয়েছেন, তাদের বাড়িতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় রাফিক এবং তার ১৫ বছর বয়সী বোন রাফিফ মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিল।

ওই হামলায় তাদের পরিবারের ১১ জন সদস্য মারা গেছে। নিহতদের মধ্যে আছে তাদের মা, চার ভাই-বোন এবং ভাগ্নে-ভাগ্নি।

তিনি জানালেন, বিমান হামলায় আহত হওয়ার আগে থেকেই রাফিক অপুষ্টিতে ভুগছিল।

‘’খাওয়ার জন্য আমরা কোনও ধরনের ফলমূলই পাই না। না আপেল, না পেয়ারা ... কোনও মাংসও পাওয়া যায় না। বাজারে যে সব খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যায়, সব কিছুর দাম অনেক চড়া’’, তিনি বলেছেন।

বিমান হামলায় রাফিফের পা ভেঙ্গে যায়, যা এখন এক সাথে জোড়া দিয়ে রাখা হয়েছে।

সে বলছিল হাসপাতালের কর্মীদের কাছে খাওয়ার মতো কোনও ফল বা সবজি চেয়েছিল সে, কিন্তু ‘’তারা কোনও কিছু দিতে পারেনি’’।

অথচ আগে রমজান একটি বিশুদ্ধ আনন্দের সময় ছিল, রাফিফ বলছিল, "এখনকার তুলনায় স্বর্গ!""এটি সত্যিই সুন্দর সময়

ছিল। কিন্তু সেই সময়গুলো আর ফিরে আসবে না। আমাদের জীবনের সেরা সময়গুলো হারিয়ে গেছে!"


প্রজন্মনিউজ২৪/এমএম

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ