হঠাৎ পা ফুলে যায় কেন? চিকিৎসা

প্রকাশিত: ১৬ নভেম্বর, ২০২৩ ০৬:০০:৪৪

হঠাৎ পা ফুলে যায় কেন? চিকিৎসা

লাইফস্টাইল ডেস্ক: অনেক সময় হঠাৎ পা ফুলে যায়। এ নিয়ে রোগীর উদ্বেগ বেড়ে যায়। হঠাৎ হাত-পা ফোলা অবহেলার বিষয় নয়। বিশেষভাবে লক্ষ্য করার বিষয় হল দুই পা, নাকি এক পা ফোলা। দুই পা একসঙ্গে ফুলে যাওয়া দেখলে সাধারণত নিচের কারণগুলো বিবেচনায় নিতে হয়।

* হার্ট ফেইলিউর * কিডনি ফেইলিউর * লিভার ফেইলিউর * থাইরয়েড হরমোনের অভাব * কোনো ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া।

এদের প্রত্যেকটিরই নিজস্ব অনুসঙ্গ থাকবে। যেমন শ্বাসকষ্ট, মুখ ফোলা, পেট ফোলা, জন্ডিস, প্রস্রাব কম হওয়া বা না হওয়া, গলার স্বরে পরির্বতন ইত্যাদি। হার্ট, লিভার বা কিডনির কার্যক্ষমতায় উন্নতি হলে এসব ফোলাও কমে যায়।

হঠাৎ পা ফোলার কারণ ও চিকিৎসা নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবুল হাসান মুহম্মদ বাশার। 

ডিভিটি কী

যে পথগুলো দিয়ে রক্ত হৃৎপিণ্ডে ফিরে যায়, সেগুলোকে শিরা বলা হয়, ইংরেজিতে ভেইন (Vein)। শিরাগুলো দু’ স্তরে বিন্যস্ত; চামড়ার নিচে ও মাংসের বা দেহগহ্বরের ভেতরে। গভীরে অবস্থিত শিরাগুলোই রক্ত ফেরত নেওয়ার মূল কাজটা করে। এরা আকারেও অনেক বড়। কোনো কারণে যদি এসব মোটা শিরার মধ্যে রক্ত জমাট বেঁধে যায়, তাকে ‘ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস’ (Deep Vein Thrombosis) বা সংক্ষেপে ডিভিটি (DVT) বলে। এর ফলে রক্ত ফেরত যাওয়ার মূল পথটাই বন্ধ হয়ে যায়। ধমনীর মাধ্যমে রক্ত পায়ে আসছে কিন্তু ফেরত যেতে পারছে না, তাই পা ফুলে যায়। ফোলা যখন এক পায়ে হয়, তখন ডিভিটি’র কথা মাথায় আনতে হয়। প্রশ্ন উঠতে পারে ডিভিটি দুই পায়ে একসঙ্গে হতে পারে না? পারে। তবে সাধারণত হয় না।

লক্ষণ

হঠাৎ ব্যথার সঙ্গে পা ফুলে শক্ত হয়ে যাওয়া ডিভিটির মূল লক্ষণ। এর সঙ্গে কারণ সংক্রান্ত কিছু অনুসঙ্গ রোগ শনাক্তকরণে সাহায্য করতে পারে। যেমন রোগী দীর্ঘদিন বিছানা বন্দি ছিলেন কিনা, রোগী ক্যান্সারে ভুগছেন কিনা, পায়ে কোনো আঘাত পেয়েছেন কিনা, উড়োজাহাজ, ট্রেন বা বাসে লম্বা পথ ভ্রমণ করেছেন কিনা ইত্যাদি। অনেক সময় অবশ্য এসবের কিছুই থাকে না, বিশেষত অল্প বয়স্কদের হঠাৎ পা ফুলে যাওয়ার ক্ষেত্রে। এসব ক্ষেত্রে রক্তের উপাদানগত ক্রটির কথা ভাবতে হয়।

লিম্ফ ইডিমা বা সেলুলাইটিস নয় তো

এক পা ফুলে গেলেই ডিভিটি সব সময় হবে তা নয়। মাঝে মাঝে লসিকা নালীতে ব্লক (লিম্ফ ইডিমা), প্রদাহ বা জীবাণুর সংক্রমণে (Cellulitis) হাত-পা ফুলতে পারে।

ভারকো’স ট্রায়াড (Virchow's Triad)

ডিভিটির কারণ হিসেবে তিনটি বিষয়কে বিবেচনা করা হয়। এগুলোকে বিখ্যাত জার্মান চিকিৎসক রুডলফ ভারকো’র নামানুযায়ী ভারকো’স ট্রায়াড নামে অভিহিত করা হয় যদিও তিনি নিজে কখনও এগুলোকে বর্ণনা করেননি।

রক্তপ্রবাহে স্থবিরতা (Stasis of blood flow)

রক্ত চলাচল স্থবির হয়ে পড়লে ডিভিটি’র আশঙ্কা বেড়ে যায়। অসুস্থতা, অপারেশন বা অন্য যে কোনো কারণে দীর্ঘদিন বিছানায় শুয়ে আছেন এমন ব্যক্তি এবং বিমান বা সড়ক পথে দীর্ঘ ভ্রমণেও এমন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।

ইকোনমি ক্লাস সিনড্রোম (Economy Class Syndrome)

বিমানে দীর্ঘপথ ভ্রমণে অনেক সময় ডিভিটি হয়। এক্ষেত্রেও কারণ ওইটাই। পায়ের নড়াচাড়া দীর্ঘক্ষণ বন্ধ থাকার কারণে রক্ত চলাচল স্থরির হয়ে পড়ে। ইকোনমি ক্লাসে ভ্রমণে হাত-পা নড়াচাড়ার সুযোগ তুলনামূলকভাবে কম হওয়াতে এদের ডিভিটি বেশি হয়। বিজিনেস ক্লাসে জায়গা বেশি, নড়াচাড়ার সুযোগও বেশি, ডিভিটিও তাই কম হওয়ার কথা।

শিরার ভেতরের দেয়ালে ক্ষত (Endothelial Injury)

শিরার ভেতরের দেয়ালে এক বিশেষ ধরনের আস্তরণ (Endothelium) থাকে যা স্বাভাবিক অবস্থায় শিরার ভেতরে রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করে। কোনো কারণে এই আস্তরণে ক্ষত সৃষ্টি হলে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। আঘাত, রক্তচাপ, জীবাণু, রক্তবাহিত বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বা রক্তপ্রবাহে কোনো কৃত্রিম পদার্থের উপস্থিতি এ ধরনের ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে।

রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার প্রবণতা (Hypercoa-gulability)

উপাদানগত ত্রুটির কারণে অনেক সময় রক্তের জমাট বেঁধে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। প্রোটিন সি, প্রোটিস এস, অ্যান্টি থ্রম্বিন-৩, ফ্যাক্টর-৫ লিডেন এসব উপাদান রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করে। জন্মগত তথা জিনের ত্রুটি বিচ্যুতির কারণে এরকম হয়ে থাকে। রক্তের ঘনত্ব বৃদ্ধিও এর জমাট বেঁধে যাবার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। পানিশূন্যতা থেকেও এমনটা হতে পারে।

পরীক্ষা-নিরীক্ষা

রক্তনালীর আল্ট্রাসনোগ্রাম বা ভাস্কুলার ডুপ্লেক্স স্টাডির (Vascular Duplex Study) মাধ্যমে প্রায় ৯৯% ক্ষেত্রে এই রোগ নিরুপণ করা সম্ভব। ’ডি ডাইমার’ নামের এক ধরনের রক্ত পরীক্ষাও এ সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে।

চিকিৎসা

আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত ডিভিটির চিকিৎসা মূলত ওষুধের মাধ্যমে করা হয়। হেপারিন নামে এক ধরনের ওষুধ আছে যা রক্তকে জমাট বঁাঁধতে বাঁধা দেয়। শুরুতে ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়। সময়মতো চিকিৎসা শুরু করা গেলে এই ওষুধের ফলাফল বেশ ভালো। সম্প্রতি এই ইনজেকশনের বিকল্প মুখে খাবার ওষুধ বাজারে এসেছে। এর কার্যকারিতা ইনজেকশনের মতোই। আরও এক ধরনের ওষুধ ডিভিটি’র চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। ওয়ারফারিন নামের এই ওষুধও যথেষ্ট কার্যকর, দামও কম। কিন্তু ওষুধটি শরীরে দীর্ঘমেয়াদে কাজ করে এবং অন্য অনেক ওষুধের সঙ্গে এর বিক্রিয়া রয়েছে যার ফলে নির্দিষ্ট মাত্রার ওষুধ নিয়মিত খাওয়া সত্ত্বেও রক্তে এর মাত্রা কমে বা বেড়ে যেতে পারে। তাই মাঝে মাঝে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে শরীরে এর মাত্রা দেখে নিতে হয়। অন্যথায় মাত্রা বেশি হয়ে গেলে শরীর থেকে রক্তক্ষরণের আশঙ্কা থাকে।

ডিভিটি’র আধুনিক চিকিৎসা

থ্রম্বোলাইসিস

আধুনিক চিকিৎসায় শিরাতে স্যালাইনের মাধ্যেমে বা ডিভিটি আক্রান্ত শিরার মধ্যে ক্যাথেটার ঢুকিয়ে তার মাধ্যমে এমন ওষুধ প্রয়োগ করা হয় যার কাজ জমাট রক্তকে তরলায়িত করা। অনেক সময় আবার জমাট রক্তকে যন্ত্রের মাধ্যমে চূর্ণ করে বাইরে বের করে নিয়ে আসা হয়। ডিভিটি শুরু হওয়ার সর্বোচ্চ ৩ সপ্তাহের মধ্যে এসব চিকিৎসা শুরু করার সুযোগ থাকে। এসব চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়াতে বাংলাদেশে এখনও সহজলভ্য ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি।

ডিভিটি থেকে পালমোনারি এম্বোলিজম

ডিভিটি মূলত পায়ের সমস্যা হলেও কখনও কখনও এটা প্রাণঘাতি হয়ে উঠতে পারে। পায়ের শিরা থেকে জমাট রক্তের বড় চাকা ছুটে গিয়ে রক্ত স্রোতের সঙ্গে ভেসে ফুসফুসের রক্তনালীতে গিয়ে আটকে যেতে পারে। তাতে হঠাৎ শ্বাস বন্ধ হয়ে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। ডিভিটি’র অর্ধেকেরও বেশি রোগী পালমোনারি এম্বোলিজম (Pulmonary Embolism) নামে পরিচিত এই জটিলতায় আক্রান্ত হন, তবে সব সময় তা প্রাণঘাতি হয় না। এই জটিলতা প্রতিরোধের উপায় আছে। পালমোনারি এম্বোলিজম প্রতিরোধে ধাতুর জাল দিয়ে তৈরি ছাতা জাতীয় এক ধরনের ফিল্টার (Vena Cava Filter) পেটের মধ্যে শিরার প্রবাহপথে (Inferior Vena Cava) স্থাপন করা হয়। পায়ের শিরা থেকে জমাট রক্ত ছুটে গেলেও ফুসফুসে পৌঁছানোর আগেই এই ফিল্টারে আটকে যায়। বেশ খরচসাপেক্ষ হওয়াতে আমাদের দেশে খুব একটা ব্যবহৃত হয় না।

পোস্ট থ্রম্বোটিক সিনড্রোম

এক সময় পা ফোলা ছিল এখন ফোলা খুব একটা নেই তবে পা আস্তে আস্তে কালো হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ঘা হচ্ছে, শুকাচ্ছে, আবার হচ্ছে। ডিভিটি’র পরে এরকম ঘটনা ঘটতে পারে। মূলত ডিভিটি রোগীদের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ এই পোস্ট থ্রম্বোটিক সিনড্রোম নামক জটিলতায় ভুগে থাকেন। এর চিকিৎসা সহজ নয়।

অল্প বয়সে ডিভিটি

অল্প বয়সীদের ডিভিটি রোগ হলে উপরে বর্ণিত রক্তের উপাদানগত ক্রটির (যেমন প্রোটিন সি, প্রোটিন এস, অ্যান্টি থ্রম্বিন-৩ ইত্যাদির ঘাটতি) কথা মাথায় রাখতে হয়। এসব রোগীদের সারাজীবন রক্ত তরল রাখার ওষুধ সেবন করতে হতে পারে।

একিউট ডিভিটি, ক্রনিক ডিভিটি

প্রথম দু’সপ্তাহের ভেতরে ডিভিটিকে একিউট ডিভিটি বলা হয় এর পর এটা ক্রনিক পর্যায়ে চলে যায়। একিউট ডিভিটির চিকিৎসা যতটা সন্তোষজনক, ক্রনিক ডিভিটি ততটা নয়। থ্রম্বোলাইসিস জাতীয় আধুনিক চিকিৎসা ক্রনিক ডিভিটিতে কাজ করে না। আধুনিক চিকিৎসায় অনেক সময় ক্রনিক ডিভিটিতে আক্রান্ত পায়ের উপরের দিকে বন্ধ শিরা বেলুন/রিং ব্যবহার করে খুলে দেয়া হয় তাতে রক্ত উপরিবহনের উন্নতি হয়ে পা ফোলাসহ অন্যান্য লক্ষণগুলোর উন্নতি হয়। ব্যয়বহুল হওয়াতে এই চিকিৎসার প্রয়োগ আমাদের দেশে খুবই কম।

হাতের ডিভিটি

পায়ের তুলনায় হাতের ডিভিটি তুলনামূলকভাবে অনেক অনেক কম। বিশেষ কিছু পরিস্থিতিতে হাতেও ডিভিটি হতে পারে। যেমন, কোনো কারণে যদি ঘাড়ের কাছে হাত থেকে রক্ত নিয়ে যাওয়া শিরায় বাঁধার সৃষ্টি হয়। এরকম বাঁধার সৃষ্টি হতে পারে যদি জন্মগতভাবে ঘাড়ের কোনো পাশে সারভাইকাল রিব নামের বাড়তি হাড় থাকে। ফুসফুসের উপরের দিকে বড় ধরনের টিউমার থাকলে সেটাও শিরার উপর চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে হাতের ডিভিটির কারণ হতে পারে।


প্রজন্মনিউজ২৪/এসআই
 

এ সম্পর্কিত খবর

তাপপ্রবাহে করনীয় সম্পর্কে জাতীয় নির্দেশিকা প্রকাশ

কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসরায়েল বিরোধী বিক্ষোভে পুলিশের গুলি

স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার দাবিতে সারা দেশে সমাবেশ করবে ছাত্রলীগ

শুক্রবার ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়নি, ভুলে ফেসবুকে পোস্ট: মন্ত্রণালয়  

ফিরে দেখা সেই ৫ মে রাতে শাপলা চত্বরে ঘিরে কী ঘটেছিল

বেরোবিতে বিভাগীয় প্রধান নিয়োগে আইনি জটিলতা,আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা

চাঁদাবাজির অভিযোগে জবি ছাত্রলীগ সিনিয়র সহ-সভাপতির বিরুদ্ধে মামলা

চবিতে বসুন্ধরা শুভসংঘের সভাপতি রুপক, সম্পাদক রবিউল

আবারও মিয়ানমারের ৮৮ সীমান্তরক্ষীর বাংলাদেশে প্রবেশ

চাঁদাবাজির অভিযোগে জবি ছাত্রলীগ সিনিয়র সহ-সভাপতির বিরুদ্ধে মামলা

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন





ব্রেকিং নিউজ