ইসলাম, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৪ নভেম্বর, ২০২১ ০১:০৭:৪৬

ইসলাম, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও বাংলাদেশ

ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির অনন্য উদাহরণ বাংলাদেশ। ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামল থেকে পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। একদিকে ভারতে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার দাবি, অপরদিকে দ্বিজাতি তত্ত্ব বা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক স্লোগান তোলে পাকিস্তান কায়েমের দাবি। পরিশেষে দ্বিখণ্ডিত উপমহাদেশ। তথাকথিত দ্বিজাতি তত্ত্বের নাগপাশ থেকে আমরা বাঙালিরা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করেছি।

১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকেরা পবিত্র ইসলামের নামে পাকিস্তানি শাসক চক্রের অন্যায়-অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়ায় এবং উল্লিখিত চারটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সম্মিলিত সংগ্রামের যৌথ চেতনা ও মূল্যবোধকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ নামে অভিহিত করি। আর সে মূল্যবোধ হচ্ছে, স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা হবে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক। তথাকথিত দ্বিজাতি তত্ত্বের আলোকে পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশে কোনো সম্প্রদায়ের ধর্মকে রাজনীতি ও শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হবে না। এটাই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নকালে রাষ্ট্রীয় মূল নীতিমালা নির্ধারণ করা হয়। সংবিধানের প্রস্তাবনায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে, ‘আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদগণকে প্রাণ উৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল...সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।’

মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ইতিহাসে ইসলাম ধর্ম একটি বিপ্লব। অন্যায়, অবিচার, শোষণ ও বঞ্চনায় জর্জরিত সমাজে এক বৈপ্লবিক জীবনব্যবস্থা নিয়ে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব। আমাদের মহানবী (সা.) অমুসলিমরা অসুস্থ বা বিপদগ্রস্ত হলে তাদের দেখতে যেতেন এবং যথাসাধ্য সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নিতেন। আনাস (রা.) এক প্রসঙ্গে বলেন, নবী করিম (সা.)-এর খেদমতে এক ইহুদি দাস কাজ করত। একদিন সেই ইহুদি দাস ভীষণ অসুস্থ হলে মহানবী (সা.) তাকে দেখতে তার বাড়িতে যান। মহানবী (সা.) তার মাথার দিকে বসে অসুখের খোঁজ-খবরের পাশাপাশি তাকে (দাসকে) ইসলামের দাওয়াত দেন। সে সময় দাস তার পিতার দিকে তাকালে পিতা তাকে বলেন, তুমি মুহাম্মদ (সা.)-কে অনুসরণ করো এবং দাস ইসলাম গ্রহণ করল। তখন মহানবী (সা.) বলেন, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি, যিনি তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিলেন। (বুখারি)

মহানবী (সা.) অমুসলিমদের প্রতি জীবিত অবস্থায় যেমন হক আদায় করেছেন, তেমনি তাদের মৃত্যুর পরও হক আদায়ে দৃঢ় সচেষ্ট ছিলেন। আমাদের মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘মানবজাতির সবাই আদম (আ.)-এর সন্তান এবং আরবদের ওপর অনারবদের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই, তেমনি কালোর ওপর সাদা, সাদার ওপর কালোর কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’

ধর্ম মানুষের হৃদয়-আত্মার সেই বিশ্বাস-শক্তি, যা তার মধ্যে বিশেষ জীবনবোধের জন্ম দেয়। মানুষের যাতে ইহজগৎ ও পরজগতের জীবন সুখময় হতে পারে, সে জন্যই ধর্মের আবির্ভাব। কোনো ধর্ম মানুষকে মিথ্যা বলতে, অন্যায় পথে পা বাড়াতে, অপরকে ঘৃণা করতে, কারো ক্ষতি করতে, অন্যের সুনাম নষ্ট করতে শিক্ষা দেয় না। জীবনে ধর্ম বিশ্বাসের মূর্ত প্রতিফলন ঘটে ন্যায়-অন্যায়ের বিবেচনা, অপরের কল্যাণ ও বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মাধ্যমে। হাদিসে বর্ণিত আছে, একদিন মহানবী (সা.)-এর পাশ দিয়ে এক ইহুদির লাশ নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি দাঁড়িয়ে যান, তখন সঙ্গে থাকা সাহাবি তাঁকে প্রশ্ন করেন, আপনি কেন দাঁড়ালেন? এটা তো ইহুদির লাশ! তখন মহানবী (সা.) বলেন, ‘সে কি মানুষ নয়?’ (বুখারি)

পবিত্র কোরআন মুসলমানদের পথনির্দেশক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তা সত্ত্বেও পবিত্র কোরআনের বহু প্রসঙ্গে গোটা মানবজাতিকে লক্ষ্য করে যেসব উপদেশ-নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেখানে ‘মানুষ’ শব্দটি ৬৫ বার, মানবকুল শব্দটি ২৪০ বার উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআনের সেসব প্রসঙ্গে মানুষে মানুষে কোনো পার্থক্য করা হয়নি।

মানুষের সঙ্গে সদাচরণকে ইসলামে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। হিংসা-বিদ্বেষ, পরনিন্দা, পরচর্চা, পরশ্রীকাতরতা, রেষারেষি, কুৎসা রটানো এবং সহিংসতা ছড়ানো ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত গর্হিত কাজ। অন্য ধর্মেও এগুলোর কোনোও সমর্থন নেই। এগুলো মানুষের হক নষ্টের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আর ইসলাম ধর্মে মানুষের হক পালনের বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কেউ কোনো ব্যক্তির হক নষ্ট করলে, ওই ব্যক্তির জীবদ্দশায় তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেওয়াই বিধান, এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে ইসলামধর্মে। মহানবী (সা.) অমুসলিম প্রত্যেক নাগরিককে তাদের ন্যায্য অধিকার প্রদান করেছেন এবং সাহাবিদের এ বিষয়ে কঠিন নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি তাদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘জেনে রাখো, কোনো মুসলিম যদি অমুসলিম নাগরিকদের ওপর নির্যাতন ও নিপীড়ন করে, কোনো অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করে, তার কোনো ধন-সম্পদ জোরপূর্বক কেড়ে নেয়, তবে কিয়ামতের দিন বিচারের কাঠগড়ায় আমি অমুসলিমদের পক্ষে অবস্থান করব (আবু দাউদ)।

মহানবী (সা.) অন্য এক হাদিসে বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করবে, সে জান্নাতের কোনো গন্ধও পাবে না। অথচ জান্নাতের সুগন্ধ ৪০ বছরের দূরত্ব থেকে পাওয়া যাবে।’ (বুখারি)

হিজরতের পর মহানবী (সা.) মদিনায় বসবাসরত সব ধর্মের অনুসারীদের সমন্বয়ে মদিনা সনদ তৈরি করেন। মুসলমান ছাড়া সে সময় মদিনায় বাস করত ইহুদি, পৌত্তলিক, মূর্তিপূজক ও অগ্নিপূজক। মহানবী (সা.) এ সনদের (৬২২-৬৩০ খ্রি.) মাধ্যমে মদিনা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। দীর্ঘ আট বছরের ইতিহাসে অন্য ধর্মের একটি লোকও এ অভিযোগ করেনি যে সে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

পরমতসহিষ্ণুতাও পবিত্র ইসলামের মহান শিক্ষা। ইসলামের এ মর্মবাণীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তখন অনেক লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ষষ্ঠ হিজরিতে যখন মহানবী (সা.) মক্কায় হজব্রত পালন করতে এসে মক্কার কাফিরদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে মদিনা প্রত্যাবর্তন করেন তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন এক হাজার ৪০০ সাহাবি। অন্যদিকে অষ্টম হিজরিতে মহানবী (সা.) ১০ হাজার সাহাবি নিয়ে মক্কা বিজয় করেন এবং কাফিরদের বিনা বাধায় মক্কা নগরীতে প্রবেশ করেন।

ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়োগ যদি জনগণের উদ্দেশ্যে হয়, তাহলে তার প্রয়োগ হবে পরমতসহিষ্ণুতা। এ জন্যই পরমতের প্রতি সহিষ্ণু হওয়ার জন্য মুসলমানদের আদেশ প্রদান প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, মুসলমানরা যেন কাফিরদের মূর্তিগুলোকে গালি না দেয়। কারণ যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে মিথ্যা প্রভুকে ডাকে, তোমরা তাদের প্রভুকে গালি দিয়ো না। তাহলে তারাও শত্রুতাবশত বা অজ্ঞানতাবশত তোমার আল্লাহকেও গালি দেবে। এভাবেই আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য তাদের কর্ম শোভিত করে দিয়েছি। তারপর তাদের রবের কাছে তাদের প্রত্যাবর্তন।’ (সুরা আনআম)

মহানবী (সা.) ইসলামকে রক্ষার জন্য কাফিরদের সঙ্গে যুদ্ধ করলেও কখনো তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করেননি; বরং যুদ্ধ-প্রাক্কালে তিনি যোদ্ধাদের উদ্দেশে বলতেন, ‘তোমরা শত্রুবাহিনীর ঘরবাড়ি ধ্বংস করবে না, গাছপালা কর্তন করবে না, নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের অত্যাচার করবে না।’

ইসলাম মানবতার ধর্ম। সবাইকে মানবিক করার জন্যই আল্লাহ তাঁর নবীকে পাঠিয়েছেন। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন অনুকরণীয় সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাজব্যবস্থা। আমরা তাঁর উম্মত। সাম্প্রদায়িক চেতনা ভুলে গিয়ে নবীর আদর্শ বাস্তবায়ন করা এবং মুসলিম-অমুসলিম ভাই ভাই হয়ে সমাজে বাস করা একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য। এটা যেন ভুলে না যাই।

লেখক : জাতীয় সংসদ সদস্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া ৫
প্রজন্মনিউজ২৪/কে.জামান

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন





ব্রেকিং নিউজ