‘দুর্নীতি করে পার পাওয়া যায়, বড় বড় দুর্নীতির শাস্তি হতে দেখা যায় না'

প্রকাশিত: ০২ ডিসেম্বর, ২০২০ ১১:৩১:৫০

‘দুর্নীতি করে পার পাওয়া যায়, বড় বড় দুর্নীতির শাস্তি হতে দেখা যায় না'

বাংলাদেশে উচ্চ মাত্রার দুর্নীতি আছে। তবে দুঃখজনক হচ্ছে দুর্নীতি দমনে প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় অগ্রগতির নজির নেই। বড় বড় দুর্নীতি এবং দুর্নীতিবাজদের নিয়ে আলোচনা হয় কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির কোনো ব্যবস্থা আমরা দেখি না।

রেডিও তেহরানকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে এসব কথা বললেন সিনিয়র সাংবাদিক, সাংবাদিক নেতা এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল।

তিনি বলেন, তবে একটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে সরকারি দলেরও যাদের নাম আসছে দুর্নীতিবাজ হিসেবে আসছে তাদেরকেও ছাড় দেয়া হচ্ছে না। বিশিষ্ট এ সংবাদিক বলেন, রাজনৈতিক শক্তি দুর্নীতিবাজদের বেড়ে ওঠার একটি বড় শক্তি।  তবে রাজনীতিকে যারা দুষিত করে তাদেরকে প্রশ্রয় দেয়া উচিত নয় বলে মন্তব্য করেন এই রাজনৈতিক ভাষ্যকার।

সাক্ষাৎকারটি উপস্থাপন করা হলো। এটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

রেডিও তেহরান: জনাব, মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, গত এক-দেড় বছর ধরে প্রায়ই মাঝে মাঝে রাজনীতিবিদদের বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের যুবলীগ/ছাত্রলীগ পর্যায়ের কোনো কোনো নেতার অবৈধভাবে ধন-সম্পদ আয়ের ঘটনা ফাঁস হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে,গ্রেফতার হচ্ছেন। সরকার বলছে এটি তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান, তবে বিরোধীরা বলছে- আইওয়াশ। আপনি কিভাবে দেখেন?
মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল: দেখুন, দেশে দুর্নীতি নেই তা নয়; উচ্চ মাত্রার দুর্নীতি আছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে দুর্নীতি দমনে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ধরনের কোনো অগ্রগতি দেখাতে পেরেছে এমন নজির নেই। বড় বড় দুর্নীতি এবং দুর্নীতিবাজদের নিয়ে আলোচনা হয় কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির কোনো ব্যবস্থা আমরা দেখি না। এটি হচ্ছে বড় বিষয় যে বাংলাদেশ দুর্নীতি করা যায় এবং দুর্নীতি করে পার পাওয়া যায়।

সাম্প্রতিক সময় আমরা দেখেছি ক্যাসিনো কাণ্ডে কয়েকজনের নাম আসল। নিকট সম্প্রতি গোল্ডেন মনির নামের একজনের নাম শুনলাম। আওয়ামী লীগের বর্তমান একজন সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের জমি দখলের বিষয়টি দেখলাম।

তবে এটি এক ধরনের ইতিবাচক দিক যে এরা সবাই দুর্নীতিবাজ। প্রাথমিক পর্যাযে তাদের সম্পদের যে হিসাব আমরা দেখছি সেটি অবিশ্বাস্য। ইতিবাচক  এই অর্থে বলছি যে সরকারি দলের হলেও তাদেরকে ধরা হচ্ছে। ফরিদপুরে ছাত্রলীগ নেতাদেরও ছাড় দেয়া হয় নি। ক্যাসিনো কাণ্ডে জড়িত যুবলীগের যাদের নাম এসেছে তাদেরকেও ছাড় দেয়া হয় নি। তারা সবাই জেলখানায়। কেউ কেউ জামিন পেয়েছেন। এদিকে সম্প্রতি সামনে আসা গোল্ডেন মনির- তিনি কোন দলের সেটা বলা মুশকিল। তবে সকল দলের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের এমপিদের সঙ্গে তার ভালো সক্ষ্যতা রয়েছে। রাজউকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। আবারও বলছি এটি এক অর্থে ইতিবাচক যে সরকারি দলের হলেও তাদেরকে ছাড় দেয়া হচ্ছে না।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে, মানুষের মাঝে প্রথম ধারণা হয় যে, দুর্নীতিবাজদের ধরা হয় না। দ্বিতীয় ধারণা হচ্ছে তাদেরকে যদি ধরাও হয়; তাদের কোনো বিচার হয় না।

কাজেই আমি মনে করি যে, ক্যাসিনো, ফরিদপুর, গোল্ডেন মনির কিংবা হাজী সেলিম- তাদের দুর্নীতিবাজ হয়ে ওঠার পেছনে বড় শক্তি হচ্ছে তাদের রাজনৈতিক শক্তি। কাজেই ক্ষমতাসীন দল যদি মনে করেন তারা তাদের রাজনীতিকে পরিচ্ছন্ন করবেন তাহলে দুর্নীতিবাজদের শুধু গ্রেফতারই যথেষ্ট নয়; দ্রুততম সময়ে তাদের শাস্তির বিধান করা, তাদের অবৈধ সম্পদকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা উচিত।

আমরা দেখেছি-রাজনীতি-দুর্নীতিবাজদের একটি বড় ধরনের সহায়তা দেয়। এতক্ষণ আমি বর্তমান সরকারের আমলের কথা বল্লাম। আমরা যদি খালেদা জিয়ার সরকারের দিকে তাকাই তাহলে দেখব তাঁর দ্বিতীয় পুত্রের পাচার করা অর্থ সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত আনা হল। তিনি তো রাজনীতি করতেন না। কিন্তু রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য বলেই দুর্নীতির সঙ্গে তার সম্পর্কের প্রমাণ আমরা পেলাম।   

কাজেই আমি মনে করি রাজনৈতিক শক্তি দুর্নীতিবাজদের বেড়ে ওঠার একটি বড় শক্তি। যদি রাজনীতিবিদরা তাদের ওপর থেকে হাত গুটিয়ে নেয় শাস্তির বিধান করে তাহলে দেশও দুর্নীতি থেকে রেহাই পায় এবং যেদল ক্ষমতায় থাকে বা যাদের নাম করে দুর্নীতিবাজরা দুর্নীতি করে সে দলটিও অবমাননাকর অবস্থান থেকে মুক্তি পায়। 

রেডিও তেহরান: জনাব, বুলবুল আপনি চমৎকার করে বললেন যারা দুর্নীতিবাজ তাদের যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করা। তো এখানে আলোচনার মধ্যে একটি বিষয় চলে আসে যে, ছাত্রলীগ/যুবলীগ পর্যায়ের নেতারা এইরকম ঘটনায় গ্রেপ্তার হলেও শীর্ষ পর্যায়ের কোনো মন্ত্রী বা এমপি কিন্তু গ্রেপ্তার হন নি। তার মানে কি এ কথা বলা যায় যে, আওয়ামী লীগের বা সরকারি দলের কিংবা যখন যারা ক্ষমতায় থাকেন তাদের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্ব এমন দুর্নীতি থেকে মুক্ত?

মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল: না, দেখুন এর সরল সমীকরণ করা যাবে না। যেহেতু আমাদের হাতে কোনো প্রমাণ নেই। আমাদের হাতে যখন কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ থাকবে তখনই কেবল বিষয়টি বলা যাবে। সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া আমরা ধারনা করতে পারি। যেমন ধরুন যারা বিদেশে বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত কানাডাতে যারা  টাকা পাচার করেন; এতদিন আমরা মনে করতাম রাজনীতি বিদরাই সম্ভবত ঐ পাচারের সঙ্গে জড়িত। তারাই টাকা পাচার করেছে। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে দেখা গেল প্রাথমিক যে তথ্য আছে তার ভিত্তিতে টাকা পাচার করার ক্ষেত্রে শীর্ষে আছে আমলারা।
কাজেই আমাদের ধারনার সাথে বাস্তবতার মিল নাও হতে পারে। কারণ আমরা ঢালাওভাবে রাজনীতিবিদদের দিকে আঙ্গুল তুলতে পছন্দ করি। কিন্তু রাজনীতিবিদরা নিজেরা সম্পৃক্ত না থাকলেও তাদের রাজনৈতিক পরিচয় কেউ না কেউ ব্যবহার করে। যেমন ধরুন গোল্ডেন মনির সম্পর্কে দেখা গেল তার গ্যারেজের মধ্যে একজন সাবেক এমপির গাড়ি পাওয়া গেল। গোল্ডেন মনিরকে ধরার মধ্য দিয়ে যে যাত্রাটি শুরু হলো সেই যাত্রায় যদি দুর্নীতি দমন সংস্থা  যদি খুঁজে বের করে আনতে পারে- কোন মন্ত্রীকে তিনি গাড়ি উপহার দিয়েছেন-তাহলে সেটি খুব বড় কাজ হয়।  আর এটিই হওয়া উচিত কিন্তু সেটি না হওয়া পর্যন্ত আমরা ঢালাওভাবে বলতে গেলে সেটি হবে একধরনের আনুমানিক অভিযোগ। আমাদের অপেক্ষা করা উচিত সঠিক তদন্তের মধ্য দিয়ে নেপথ্যের দুর্নীতিবাজদেরকেও ধরা উচিত।

রেডিও তেহরান: আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যখন এরকম বিপুল ধন সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায় তখন অনেকেই বলে থাকেন যে, দেশের উন্নয়ন হয় নি বরং আওয়ামী লীগের নেতাদের উন্নয়ন হয়েছে। এই বক্তব্যকে আপনি কিভাবে 

মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল: দেখুন, পারসেপশন তৈরি হয় ব্যবহার থেকে। যখন একটা বড় প্রজেক্ট শুরু হয় এবং যথাসময়ে শেষ না হয় তখন বলা হয় ঐ প্রজেক্টের ঠিকাদার কে, তিনি কিভাবে কাজ পেলেন, কেন শেষ হলো না যথাসময়ে- এ সব প্রশ্ন ওঠে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন,কোনো ঠিকাদার যদি আগের কাজ শেষ না করেন তাহলে তিনি আর কাজ পাবেন না। তারমানে এতদিন ঠিকাদাররা অনেকগুলো কাজ পেতেন এবং কাজগুলো তারা অর্ধেক অর্ধেক করে রাখতেন। তারমানে রাজনীতির সঙ্গে দুর্নীতির একটি অনুষঙ্গ রয়েছে। যারা ক্ষমতায় থাকেন তাদের নাম ব্যবহার করে যেহেতু দুর্নীতি করে পার পাওয়া যায় বা দুর্নীতি করা সহজ হয় কাজেই দুর্নীতিবাজরা এটিকে ব্যবহার করেন।

আমি মনে করি একটি দেশের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে রাজনীতি। কাজেই রাজনীতির ভেতর থেকে কিংবা বাইরে থেকে, ক্ষমতাসীন কিংবা ক্ষমতার বাইরে থেকে,এই সরকার হোক বা আগের সরকার-রাজনীতিকে যারা দুষিত করে তাদেরকে প্রশ্রয় দেয়া উচিত নয়। আমাদের রাজনীতিবিদদের যদি আমরা পরিশুদ্ধভাবে দেখতে চাই তাহলে রাজনীতিবিদদের এসব দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় দেয়া উচিত হবে না। চূড়ান্ত বিচারে আমি মনে করি যে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই রাষ্ট্র ক্ষমতার নেতৃত্ব দিতে হবে। রাজনীতির কোনো বিকল্প থাকবে না। এখানে রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের যদি  সংহত করতে হয় তাহলে যে দুর্বৃত্তরা রাজনীতির নাম ব্যবহার করে রাজনীতিকে কলুষিত করছে কি ক্ষমতাসীন দল কি বিরোধী দল- সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে দিক নির্দেশনা দিতে হবে। আর এক্ষেত্রে সরকারি দল বা ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্ব অনেক বেশি।

রেডিও তেহরান: রাজনৈতিক নেতাদের এই অবৈধভাবে অর্থবিত্ত উপার্জনের ঘটনা থেকে সাধারণ মানুষের ভেতরে একটা অভিন্ন ধারণা তৈরি হয়েছে যে,বাংলাদেশের রাজনীতি তার পথ হারিয়েছে, রাজনীতি এখন  আর জনকল্যাণে নেই? আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল: আপনি ঠিকই বলেছেন। সাধারণ মানুষ মনে করে যে রাজনীতি এখন শুধুমাত্র ভোট। ভোট করে ক্ষমতায় যাওয়া এটিই রাজনীতির একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু আসলে রাজনীতি তো তা নয়। আমি পছন্দ করি বা না করি একটি নির্ধারিত আদর্শের ভিত্তিতে রাজনীতিকে পথ চলতে হবে। আর যদি সঠিক পথে বা আদর্শের ভিত্তিতে না চলে তাহলে কখনও না কখনও সেই রাজনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে।
আপনারা লক্ষ্য করলে দেখবেন যে, আমাদের পাশে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যখন বামে'রা ক্ষমতায় আসল তখন তাদের সততা, রাজনৈতিক আদর্শ এবং নৈতিকতা তুঙ্গে ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার মধ্য দিয়ে তারা নানা অপকর্ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন তখন কিন্তু মানুষ তাদের প্রত্যাখ্যান করল। কাজেই এটা একটি বড় শিক্ষা যে –ক্ষমতায় থাকা মানেই চিরস্থায়ী নয়। আমার রাজনীতি যদি মানুষের মধ্যে এমন ধারনা দেয় যে আমি দুর্নীতিবাজদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেই-তাহলে সেটি শুভ নয়। মানুষের এই ধারনা পরিবর্তনের জন্য রাজনীতিবিদদের যা করণীয় সেটা করা উচিত।

প্রজন্মনিউজ২৪/নাজমুল

 

এ সম্পর্কিত খবর

তীব্র গরমে ঢাকার বাতাসের কী খবর

হাবিপ্রবি সংশ্লিষ্ট এলাকায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযান

তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে বাঁচবে হাজারও কোটি টাকার সম্পদ

সরদার পাড়া দারুল কোরআন মডেল মাদ্রাসার পরিক্ষার ফল প্রকাশ

৭ দাবিতে কুবি’র তিন দপ্তরে শিক্ষক সমিতির তালা

চলতি বছর পবিত্র হজ্জ পালনের অনুমতি দেওয়া শুরু করেছে সৌদি আরব

ইসরায়েল থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের দাবিতে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন

অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ চুয়েট, শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ

রোববার থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ

বশেমুরবিপ্রবিতে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ