ঢাকা হারিয়েছে সকল আবাসিক চরিত্র

প্রকাশিত: ২৯ নভেম্বর, ২০২২ ১০:৩৩:১০

ঢাকা হারিয়েছে সকল আবাসিক চরিত্র

ঢাকা এক অদ্ভুত শহর! অভিযোগের শেষ নেই নাগরিকদের। যানজট, জলজট, মশা, ঘনবসতি, যান্ত্রিকতা, নোংরা আরও কত কী! কিন্তু কেউই ছেড়ে যেতে চায় না এ শহর! দিন যাচ্ছে, আর এ শহরের কারিশমায় সবাই থিতু হচ্ছে। ফলে আবাসিক হিসেবে গড়ে উঠা এক সময়ের বড় এলাকাগুলো ক্রমেই তার সৌন্দর্য হারাচ্ছে। বাণিজ্যিক আগ্রাসনে বদলে গেছে পুরো ঢাকার চেহারা।

বিশেষত্ব হারিয়েছে ঢাকার অভিজাত ও আবাসিক এলাকা হিসেবে পরিচিত ধানমন্ডি, গুলশান ও বনানী। ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুর আবাসিক এলাকা এখন হয়ে গেছে স্কুলপাড়া আর হাসপাতালপাড়া। এছাড়া চায়নিজ ও ফাস্টফুডের দোকান, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের শো-রুম ও অন্যান্য দোকানের কোনো হিসেব কারও কাছে নেই।

আবাসিক এলাকা বলে পরিচিত ধানমন্ডির ৪৮ শতাংশ ভবনেই রয়েছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। পুরোপুরি আবাসিক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে মাত্র ৫২ শতাংশ ভবন। ২০১৬ সালের মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ইংরেজি সাপ্তাহিক প্রোব নিউজ ম্যাগাজিন পরিচালিত এক জরিপে এ তথ্য উঠে আসে। পরে ছয় বছরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।

ওই জরিপে বলা হয়, ১৯৫২ সালে আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে ওঠে ধানমন্ডি। এ এলাকার ১ নম্বর সড়ক থেকে ২৭ নম্বর পর্যন্ত রয়েছে মোট ৩১টি সড়ক। এ ৩১টি সড়কে মোট ১ হাজার ৫৯২টি ভবন রয়েছে; এর মধ্যে ১২০টি নির্মাণাধীন। এক হাজার ৫৯২টি ভবনের মধ্যে আবাসিক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে ৮২৩টি ভবন। আবাসিক কাম বাণিজ্যিক ৫৩২টি এবং শুধু বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে ২৩৭টি ভবন।

এক সময় কূটনৈতিকপাড়া হিসেবে পরিচিত ছিল গুলশান। বেসরকারি কর্পোরেট অফিসগুলোর পদচারণায় গুলশান হয়ে গেছে অফিসপাড়া। আর বনানী হয়ে গেছে রেস্টুরেন্ট পাড়া। পাশাপাশি হারিয়েছে অভিজাত আবাসিক এলাকার জৌলুসও। সারি সারি সুউচ্চ ভবনে শপিং মল, কারখানা, রেস্টুরেন্ট - সব মিলিয়ে একসময়ের শান্ত-স্নিগ্ধ সবুজ অভিজাত আবাসিক এলাকা হারিয়েছে তার স্বকীয়তা।

নতুন আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে উঠা রামপুরা-বনশ্রীর বুকেও দাগ পড়তে সময় লাগেনি। ওই এলাকার রাস্তার দুই পাশে শত শত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আবাসিক থেকে বাণিজ্যিক ভাড়া বেশি; তাই অলিগলি ও বাসাবাড়ির বেশিরভাগ ফ্ল্যাটই এখন ছোটখাটো কোন না কোন কোম্পানির অফিস বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি অলিগলিতে রেস্টুরেন্ট তো আছেই।

মিরপুরের অবস্থা আরও ভয়াবহ। আবাসিক ভবনের ফ্ল্যাটগুলোতে চলছে কারখানাও। এমনিতেই ওই এলাকায় কিছু বড় পোশাক কারখানা আছে, এর মধ্যে ছোট কারখানাগুলো গড়ে উঠছে আবাসিক ভবনে।

ঢাকার আবাসিক এলাকার ছোট গলি থেকে শুরু করে বড় সড়ক - খুব কম ভবনই আছে যেটি শুধু আবাসিক। অধিকাংশ আবাসিক কাম বাণিজ্যিক। অর্থাৎ, নিচ তলা থেকে তিন বা চার তলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক স্পেস রেখে এর পরই ওপরের দিকে আবাসিক ফ্ল্যাটগুলো তৈরি করা হয়েছে। এমনকি আবাসিক হিসেবে ঘোষণা দিয়ে গড়ে উঠা এলাকাগুলোতেও এর ব্যতিক্রম চোখে পড়েনি।

মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদিয়া হাউজিং সোসাইটি, বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটি, কাদেরাবাদ হাউজিং, চান মিয়া হাউজিং - এগুলোর সবার চেহারা একই। শুধু নামের পার্থক্য। এ অঞ্চলটিতে বাণিজ্যিক স্থাপনা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সহজলভ্যতা, ধানমন্ডির সান্নিধ্যতা, বাকি শহরের সাথে চমৎকার যোগাযোগে ব্যবস্থা এবং তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী - এ জন্য মোহাম্মদপুর স্টার্টআপ ব্যবসা শুরু করেছেন এমন উদ্যোক্তারা জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন।

মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে গড়ে উঠা আবাসিক এলাকা জাপান গার্ডেন সিটি কম বেশি সবার কাছেই পরিচিত। এ আবাসিক এলাকার মধ্যেই তারা তৈরি করেছে ‘টোকিও স্কয়ার মার্কেট’। এর চারপাশে অলিগলিতে আছে হোটেল, চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, সুপার শপ, শো-রুম, বাস স্ট্যান্ড, টেম্পু স্ট্যান্ড, রিকশা স্ট্যান্ড, স্কুল, কোচিং সেন্টার ইত্যাদি।

মোহাম্মদপুরের মতো বাণিজ্যিক ছোঁয়া লেগেছে এ এলাকার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা আদাবর ও শ্যামলীর মতো আবাসিক এলাকাগুলোতে। আদাবরের প্রবাল হাউজিং বা শেখেরটেক ঘুরে এমন চিত্রই দেখা মেলে। শেখেরটেক-১২ নম্বর রোডের মূল সড়কের দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভবনগুলো বছর পাঁচেক আগেও আবাসিক চেহারাতেই ছিল। কিন্তু এরপর থেকেই রেস্টুরেন্ট ব্যবসা জমজমাট হতে থাকে বলে জানালেন ওই এলাকার বাসিন্দা পিযুষ ভৌমিক।

আলাপকালে তিনি জানান, আগে শুধু সড়কের প্রবেশমুখে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরসহ দু’চারটি দোকান ছিল। কিন্তু এখন সব ভবনের নিচতলাতেই রেস্টুরেন্ট হয়ে গেছে, আর অল্প সময়ে বেশ জনপ্রিয়তাও পেয়েছে।

শুধু যে রেস্টুরেন্ট তা নয়, ওই এলাকার আবাসিক ভবনগুলোর বেশ কয়েকটিতে স্কুল ও ছোট ছোট অফিসও চোখে পড়েছে। যদিও প্রতিটি সোসাইটির একটি করে কল্যাণ সমিতি থাকলেও তারা কোনো ভূমিকাই রাখতে পারে না।

পরিকল্পিত নগরী গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ তথা রাজউক, তাদের নাকের ডগায় অবাঞ্ছিত এ রূপান্তর ঘটছে জোরেশোরে। তবুও তারা চোখ খুলে কিছু দেখছে বলে মনে হয় না।

রাজউকের চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা বলেন, রাজউক এরিয়ায় অবস্থিত আবাসিক প্লটকে বাণিজ্যিক প্লটে রূপান্তরের সুযোগ রয়েছে। তবে চাইলেই বাণিজ্যিক প্লটে রূপান্তরের সুযোগ নেই, এজন্য মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি রয়েছে। সেই কমিটি যথেষ্ট যাচাই-বাছাই করে তবেই বাণিজ্যিক প্লটের বৈধতা দেয়।

যদিও ওই কথায় পুরোপুরি একমত নন নগরবিদরা। তাদের মতে, অভিজাত এলাকাগুলোতে অর্থের বিনিময়ে বা বিভিন্ন রাজনৈতিক চাপে অনকে সময় বাণিজ্যিক ভবনের অনুমোদন দেয়া হয়। রাজউক থেকেই সেই অনুমোদনগুলো দেয়া হয়।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, অনেক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে একটি শহরের পরিকল্পনা করা হয়। আবাসিক প্লট গড়ে তোলার সময় সেখানে যেসব বিষয় বিবেচনায় রাখা হয়েছিল, সেই একই জায়গায় বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে উঠলে সেখানের বিবেচ্য বিষয়গুলো আলাদা হয়। বাণিজ্যিক স্থাপনায় মানুষজনের চলাচল বেড়ে যায়, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও সীমিত হয়ে পড়ে। ফলে একটি অঞ্চল তার বাসযোগ্যতা হারায়।

তিনি বলেন, কখনো কখনো অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন চাপে নত হয়ে বাণিজ্যিক ভবনের অনুমোদন দেয় নীতিনির্ধারা। যেখানে নগরবিদদের কোন মতামত নেয়া হয় না বা মতামত নিলেও তা বাস্তবায়ন হয় না।

নগরবিদদের মতে, রাজধানীর আবাসিক এলাকাকে বাণিজ্যিক এলাকায় পরিণত করার এ প্রবণতা দুই দশক আগে থেকে বড় আকারে শুরু হয়। ৯০-এর দশকেও ঢাকার অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত ধানমন্ডি, গুলশান, বনানীতে চার থেকে ছয় তলার ওপরে খুব কম বাড়িই ছিল। এখন ইচ্ছামতো উচ্চতায় দালানকোঠা তৈরি হচ্ছে। ভাড়া দেয়া হচ্ছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে।


প্রজন্মনিউজ২৪/এ কে

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ