ফ্লাইওভার এখন গলার কাঁটা!

প্রকাশিত: ০৩ জানুয়ারী, ২০২০ ১২:২৮:২৪

ফ্লাইওভার এখন গলার কাঁটা!

নগরীর যোগাযোগ ব্যবস্থা  সহজতর ও যানজট এড়িয়ে নির্বিঘ্নে গন্তব্যে পৌঁছাতে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে ফ্লাইওভার। এতে ভোগান্তি সাময়িক উপশম হলেও নির্মাণ পরবর্তী অব্যবস্থাপনায় মুখ থুবড়ে পড়েছে ফ্লাইওভারের উপযোগিতা।ফ্লাইওভারগুলো  এখন নগরীর জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

রাজধানীর সবচেয়ে বড় গুলিস্তান-যাত্রবাড়ী মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের উপরেও যন্ত্রনার শেষ নেই। টাকা দিয়ে পারাপার হতে গিয়ে নানাভাবে হয়রানীর শিকার হচ্ছে যাত্রীরা।ফ্লাইওভারে উঠতে এবং নামতে গিয়ে যানজট। ফ্লাইওভারের ওপর প্রতিদিনের এমন যানজট যেন চলমান জীবনের স্থিরচিত্র। সকাল-সন্ধ্যা সময় করে গাড়ির জট ছাড়ায় কিলোমিটারের পথ।

ফলে নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো যাত্রীদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ছে।তাই সময় বাঁচাতে এবং যানজট এড়াতে গাঁটের পয়সা খরচ করে টোল দিয়ে ফ্লাইওভারে উঠেও যানজটে নাকাল যাত্রীরা, অধৈর্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবশেষে ফ্লাইওভারে নেমেই হেঁটে পাড়ি দেন ঝুঁকিপূর্ণ পথ। যাত্রাবাড়ী অংশ থেকে উঠে পুরো ফ্লাইওভার পাঁচ মিনিটে পার হয়ে এলেও গুলিস্তানে নামতে পার হয়ে যায় ঘণ্টার কাঁটা।

ওপরে যখন এই চিত্র তখন নিচের অবস্থা আরও করুণ। বিশাল বিশাল পিলার দিয়ে প্রশস্ত রাস্তাকে সরু করে ফেলা হয়েছে। যা আছে তাও ভাঙা। গাড়ি চালকদের অভিযোগ, ইচ্ছে করেই নিচের সড়ক অনুপযোগী করে রাখা হয়েছে।নিষিদ্ধ তবু ফ্লাইওভারের উপরে মোড়ে মোড়ে বাস স্টপেজ ও পথচারীদের এলোপাথারী চলাচলে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে।

ভুক্তভোগীরা জানান, যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার সরাসরি পারাপারের জন্য গুলিস্তান ও মতিঝিল থেকে বাস সার্ভিস চালু আছে। এসব বাসে ‘ডাইরেক্ট’ পারাপারের নামে যাত্রীদের কাছে থেকে ৫ টাকার স্থলে ১৫ টাকা ভাড়া আদায় করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাসগুলো ফ্লাইওভারের উপরেই দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করায়। শনিরআখড়া থেকে গুলিস্তান আসার পথে ফ্লাইওভারের মাথায় দাঁড়িয়ে বাসগুলো যাত্রী উঠায়।

এতে করে সেখানে যানজটের সৃষ্টি হয়। যাত্রীরা অভিযোগ করে বলেন, যেখানে সরাসরি ফ্লাইওভার পারাপারের জন্য যাত্রীদের কাছে থেকে দ্বিগুন-তিনগুন ভাড়া আদায় করা হলেও বাসগুলো ফ্লাইওভারের উপরে একাধিক স্থানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করে। এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কাও থাকে। কয়েকজন ভুক্তভোগী বলেছেন, এভাবে অনিয়ম চলতে থাকলে মানুষ ক্রমে ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে চলাচলের আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে।

ঢাকার দ্বিতীয় বৃহত্তম মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারেও একই দশা  যানজট-ভোগান্তিতে হতাশা জাগিয়েছে নগরবাসীর।যানজট কমাতে বহুল আলোচিত এই মগবাজার মৌচাক উড়ালসড়ক যান চলাচলের জন্য পুরোপুরি খুলে দেয়ার পর রাজারবাগ, মগবাজার, মৌচাক, রামপুরার দিকে নিত্যদিনের দুঃসহ যানজটের ভোগান্তির অবসান হয়নি। কমেনি যানজট। কোনো কোনো সময় ফ্লাইওভারের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত যানবাহনে ঠাসা থাকে। দেখে মনে হয় ফ্লাইওভারে গাড়িগুলো যেন প্রদর্শনের  জন্য সারিবদ্ধভাবে রেখে দেওয়া হয়েছে।

বিশেষ করে অফিস সময় শুরুর আগের এবং অফিস সময় শেষের সময় যানজট বাঁধছে প্রতিদিন। আর এটা ছড়িয়ে পড়ছে গোটা ফ্লাইওভারে। তাই এখন যাত্রী দুর্ভোগের আরেক নাম রাজধানীর মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভার।এ দিকে ফ্লাইওভারটি ব্যবহার নিয়েও জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।ফ্লাইওভারে ওঠার মুখে নির্দেশকগুলো আকারে ছোট হওয়ায় অনেকেরই পথ বুঝে নিতে বেগ পেতে হচ্ছে। অনেকে গাড়ি নিয়ে ভুল র্যা ম্প দিয়ে উঠে বিপাকে পড়ছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফ্লাইওভারে ওঠার রাস্তা বেশি ঢালু হয়, যাতে স্বাভাবিক গতিতে গাড়ি চালিয়েই ওঠা যায়। আর নামার রাস্তাটি হয় তুলনামূলক খাড়া। ফলে গতি কমিয়ে দ্রুত নামা যায়। এতে ফ্লাইওভারে ওঠার র্যা ম্পটির দৈর্ঘ্য বেশি ও নামার র্যাম্পের দৈর্ঘ্য কম থাকে। কিন্তু মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নকশা এর বিপরীত। এছাড়া শান্তিনগর, রাজারবাগ থেকে একবারে সাতরাস্তা বা সোনারগাঁও হোটেল পর্যন্ত যাওয়ার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি ফ্লাইওভার দিয়ে।

একইভাবে মালিবাগ চৌধুরীপাড়া থেকেও মগবাজারে নামার সুযোগ নেই। বাংলামটর প্রান্ত থেকে উঠে ওয়্যারলেস মোড়ে নামার পর আবার নতুন করে ফ্লাইওভারে উঠে তারপর রাজারবাগ বা শান্তিনগরে যাওয়া যাচ্ছে। ফ্লাইওভারে উঠেও মৌচাক ও মালিবাগে দু’টি ক্রসিংয়ের শিকার হতে হচ্ছে। এ দু’টি স্থানে সিগন্যাল বাতি স্থাপন করা হয়েছে। ট্রাফিক পুলিশকেও রাত-দিন এ দু’টি স্থানে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। দেশের অন্য কোনো ফ্লাইওভারে এভাবে সিগন্যাল বাতি স্থাপন করা হয়নি। এমনকি বিদেশেও এ রকম সিস্টেম নেই বলে জানিয়েছেন নগরবিদেরা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, ফ্লাইওভারগুলোর সুফল পাচ্ছে মূলত ছোট এবং ব্যাক্তিগত গাড়ি। গণপরিবহণগুলো ফ্লাইওভার কমই ব্যবহার করে এবং ফ্লাইওভারগুলোর কারণে নিচের রাস্তাগুলো সঙ্কুচিত হয়ে যাওয়ায় সেখানেও যানজটের পরিমাণ কম নয়। তার মতে, শহরের কেন্দ্রস্থলে ফ্লাইওভার নির্মাণ যানজট নিরসনের স্বীকৃত পদ্ধতি নয়। যার ফলে ব্যস্ততম সময়গুলোতে যানজট নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ঢাকার গণপরিবহনের কৌশলগত পরিকল্পনায় যেসব রুট ঠিক করা হয়েছিল তার কয়েকটির মাঝে ফ্লাইওভার পড়ে যাওয়ায় সেগুলো আর বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।

নগরপরিকল্পনাবিদ সোহরাব হোসেন বলেন, ফ্লাইওভার যানজট নিরসনে খুব একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারবে না। ফ্লাইওভার যেমন অনেক গাড়িকে রাস্তা থেকে ওপরে নিয়ে যাবে, তেমনি প্রতিবছর আরও হাজার হাজার নতুন গাড়ি রাস্তায় নামবে। কাজেই ফ্লাইওভার যানজট নিরসনে বড় ভূমিকা পালন করবে না।নগর ও অঞ্চল

পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. সরওয়ার জাহান বলেন, জনঘনত্বের এ শহরে ফ্লাইওভার আসলে কোনো কাজে আসে না। এগুলো আমরা বহু আগ থেকে বলে আসছি। কারণ এই শহরটা পরিকল্পনামাফিক গড়ে তোলা হয়নি। এমনকি এই শহরের রাস্তাঘাটও পরিকল্পনামাফিক না। শহরের ভেতর যদি কোনো রাস্তা বা ফ্লাইওভার তৈরি করা হয় তবে এর দায়িত্ব সাধারণত সিটি করপোরেশনকে দেয়া হয়। সেজন্য মগবাজার-মৌচাক-মালিবাগ ফ্লাইওভারের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনকে নিতে হবে।

প্রজন্মনিউজ২৪/ মামুন

 

 

 

 

   

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ