পেঁয়াজের চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি তবুও সংকট!

প্রকাশিত: ০৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ ১১:০৮:৩৩

পেঁয়াজের চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি তবুও সংকট!

২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৩ লাখ ৩৪ হাজার মেট্রিক টন। ১০ অক্টোবর পর্যন্ত আমদানি করা হয়েছে ৮ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন। গত ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত হুট করে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেওয়ায় বিভিন্ন দেশ থেকে ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত আরও আমদানি হয়েছে ৮২ হাজার মেট্রিক টন। এ সময় পর্যন্ত সব মিলিয়ে দেশে মোট পেঁয়াজের সরবরাহ হয়েছে ৩২ লাখ ২৬ হাজার মেট্রিক টন। বছরে দেশে পেঁয়াজের চাহিদা মাত্র ২৪ লাখ মেট্রিক টন। ফলে উদ্বৃত্ত থাকার কথা কমপক্ষে ৮ লাখ ২৬ হাজার মেট্রিক টন। পচনশীল এই পণ্যটির যদি ৩০ শতাংশ অর্থাৎ সাড়ে সাত লাখ টন পেঁয়াজ পচেও যায়, তার পরেও উদ্বৃত্ত থাকবে ৭৬ হাজার মেট্রিক টন।

অথচ বছর শেষ হওয়ার দুই মাস আগে নতুন মৌসুম শুরুর আগে দেশে চলছে পেঁয়াজের সংকট! আর এই সংকটকে ঘিরেই পেঁয়াজের দাম এখনও আকাশ ছোঁয়া যা সাধারণ মানুষকে দিশেহারা ও ক্ষুব্ধ করেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের দেওয়া তথ্য মতে, বাংলাদেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ মেট্রিক টন। ঘাটতি সর্বোচ্চ সাড়ে সাত লাখ মেট্রিক টন। ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৩ লাখ ৩৪ হাজার মেট্রিক টন। উৎপাদিত মোট পেঁয়াজের ৩০ শতাংশ স্বাভাবিক নিয়মেই পঁচে যায়, যার পরিমাণ সাড়ে ৭ লাখ মেট্রিক টন। এই সাড়ে ৭ লাখ টন পেঁয়াজই দেশে বরাবর ঘাটতি থাকে।

এই ঘাটতি মেটাতে পেঁয়াজের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বছরে আমদানি করা হয় ৮ থেকে ১০ লাখ মেট্রিক টন। যা ঘাটতির তুলনায় এক থেকে আড়াই লাখ টন বেশি। এই পরিমাণ পেঁয়াজ দিয়ে চলার কথা ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া হিসাব মতে চলতি ২০১৯ সালের ১০ অক্টোবর পর্যন্ত ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে ৮ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন। গত ২৫ নভেম্বর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের ঘোষণার পর মিয়ানমার ও মিসর থেকে আমদানি করা পেঁয়াজের পরিমাণ ৮২ হাজার মেট্রিক টন।

সরকারি আরেক সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-র বরাত দিয়ে ৩০ নভেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ বকসী জানিয়েছেন, মিসর থেকে সিটি গ্রুপের আনা সর্বশেষ ১৫ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজও দেশে এসেছে যা টিসিবিকে হস্তান্তর করা হয়েছে। এর পরও ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে পেঁয়াজ সংকটের কারণেই দাম বেড়েছে। তাহলে প্রশ্ন, এত পেঁয়াজ গেলো কোথায়? ব্যবসায়ীদের ভাষ্যমতে, দেশের পেঁয়াজের চাহিদা ও জোগানের কোনও সঠিক হিসাব নাই। ব্যবসায়ীদের ধারণা, প্রতিবছর চাহিদার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পেঁয়াজ দেশে উৎপাদন করা হয়। বাকিটা আমদানি হয়। আমদানির প্রায় সবটুকুই ভারত নির্ভর।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) হিসাবে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে প্রায় ১০ লাখ ৯২ হাজার টন। জানতে চাইলে শ্যামবাজারের পেঁয়াজ আমদানিকারক হাজি এম এ মাজেদ জানিয়েছেন, ভারত থেকে আমদানির জন্য এলসি খুললেও ২৯ সেপ্টেম্বর রফতানি বন্ধের পর ভারত পেঁয়াজ দেয়নি। ফলে যে পরিমাণ আমদানির কথা বলা হচ্ছে আসলে সে পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি হয়নি। অপরদিকে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী উৎপাদিত পেঁয়াজের ৩০ শতাংশ পচে যাওয়ার তথ্যটিও সঠিক নয়। তিনি বলেন, বছরে মোট পেঁয়াজের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশই পঁচে যায়।

কাজেই পেঁয়াজের উৎপাদন, পচে যাওয়ার পরিমাণ এবং মোট আমদানির পরিমাণে গলদ রয়েছে। আসলেই দেশে পেঁয়াজ সংকট রয়েছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় পণ্যটির ওপর চাপ পড়েছে বিধায় দাম বেড়েছে। অপরদিকে সরকারি মহলের সন্দেহ, দেশের কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা বেশি পরিমাণে মুনাফা লাভের আশায় পেঁয়াজের মজুত বাড়াচ্ছেন। পেঁয়াজের এই মজুত ঠেকাতে মাঠেও নেমেছে সরকার। ৩০ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ১০জন যুগ্মসচিবের নেতৃত্বে ১০টি টিম দেশের বিভিন্ন জেলায় গিয়েছিলেন মজুত বিরোধী অভিযান পরিচালনার জন্য। এই সময় যাতে পেঁয়াজের সরবরাহ ঠিক থাকে এবং কেউ যাতে এই সময় পেঁয়াজের মজুত গড়তে না পারে তা ঠেকাতেই মাঠে নামানো হয়েছিলো এই ১০টি টিম।

টিমগুলোর কাজের সঙ্গে জেলা প্রশাসনকে যুক্ত হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে টিমগুলো ঢাকায় ফিরে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিলেও তা গণমাধ্যমকে জানানো হয়নি। জানতে চাইলে রাজধানীর শ্যামবাজারের আমদানিকারক পেঁয়াজ রসুন ও আদা ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, একতরফা অভিযোগ সঠিক নয়। সব সময় বাজারে আমদানিকারকরা অস্থিরতা তৈরি করে না। কোনও কোনও সময় সুযোগ সন্ধানী মধ্যস্বত্বভোগী একটি চক্র নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে যে কোনও নিত্যপণ্যের বাজারকে অস্থির করে তোলে। তারাই বাজারে পণ্যের সরবরাহে সংকট তৈরি করে। অহেতুক দাম বাড়ানোর গুজব ছড়ায়। আর সব কিছু মিলিয়ে এর খেসারত বাবদ ক্রেতা বিক্রেতা উভয়কেই দিতে হয় বাড়তি মূল্য। এবারও তাই হয়েছে।

উল্লেখ্য, ২৯ সেপ্টেম্বর ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক বাণিজ্য শাখার বরাত দিয়ে জানানো হয়, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ থাকবে। এই সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়েছে দেশীয় পেঁয়াজের বাজারে। সহজে পরিবহনের কারণে সারা বছরই ভারত থেকে প্রয়োজনীয় পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। এর পরিমাণ মোট আমদানির ৯৫ শতাংশেরও বেশি। ভারতের মহারাষ্ট্র ও অন্য এলাকায় এ বছর বন্যার কারণে পেঁয়াজের ফলন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে কিছুদিন আগে রফতানির ক্ষেত্রে ভারত প্রতি মেট্রিক টন পেঁয়াজের মিনিমাম এক্সপোর্ট প্রাইস (এমইপি) নির্ধারন করে দিয়েছে। আগে প্রতি মেট্রিক টন পেঁয়াজের আমদানি মূল্য ছিল কম-বেশি ২৫০ মার্কিন ডলার।

গত ১৩ সেপ্টেম্বর ভারত তা বাড়িয়ে ৮৫০ মার্কিন ডলার নির্ধারণ করে দেয়। এর দু’ সপ্তাহ পর গত ২৯ সেপ্টেম্বর বিকেলে ভারত কর্তৃপক্ষ পেঁয়াজ রফতানি পুরোপুরি বন্ধের ঘোষণা দেয়। বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশ মিয়ানমার থেকে এলসি এবং বর্ডার ট্রেডের মাধ্যমে এবং জাহাজযোগে মিসর ও তুরস্ক থেকেও এলসি’র মাধ্যমে পেঁয়াজ আমদানি শুরু করে। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দ্রুততম সময়ে বিমানে করে পেয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সেই পেঁয়াজও মিসর থেকে দেশে পৌঁছাতে শুরু করেছে। তবে ভারতের পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের সিদ্ধান্ত যেন শাপেবর হয়ে দেখা দেয় সুযোগ সন্ধানী পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের জন্য। আমদানিকারক, পাইকারি, খুচরা ব্যবসায়ীদের সব পক্ষই এর সুযোগ নেয় ইচ্ছেমতো।

বাদ যায়নি দেশি পেঁয়াজের আড়তদার ও বিক্রেতারাও। আমদানির পেঁয়াজের চেয়েও লাফিয়ে বাড়তে থাকে দেশি পেঁয়াজের দাম। ২৯ সেপ্টেম্বর ভারতের দেওয়া ওই সিদ্ধান্তের মাত্র ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে কোনও ধরনের আমদানি ছাড়াই পেঁয়াজের দাম ৫০ টাকা কেজি থেকে বেড়ে ১০০ টাকায় উঠে যায়। এরপর তা লাফিয়ে ১১০ টাকা, ১২০ টাকা, ১৫০ টাকা ওঠে। এরপর পেঁয়াজ আমদানি শুরু হলেও এবং টিসিবি রাজধানীতে ৪৫ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করলেও এর কেজি ২৫০ টাকায় ওঠে। এই দরবৃদ্ধি এখনও অব্যাহত রয়েছে। ২ ডিসেম্বর সোমবারও রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে আমদানি করা মিসরের পেঁয়াজ ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা এবং দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২৩০ টাকা কেজি দরে।

এ প্রসঙ্গ জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. জাফর উদ্দিন জানিয়েছেন, ভারতের পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের সিদ্ধান্ত জানার পর ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেয়ে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন, কেউ কেউ মজুত করার চেষ্টা করছেন- এমন তথ্যও মন্ত্রণালয়ে এসেছে। দাম সহনীয় রাখতে টিসিবি ৪৫ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করেছে। তবে, বাস্তবতা হলো বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে নানামুখী তৎপরতার কথা বলা হলেও এবং বিভিন্ন সময়ে সরকারের উদ্যোগে অভিযানের কথা বলা হলেও পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা এর কিছুই পাত্তা দিচ্ছেন না।

দেশি পেঁয়াজ আমদানি না হলেও এর দাম লাগামহীনভাবে কেন বাড়ছে সে বিষয়টি জানার ব্যাপারে ও নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়ে সরকারের কোনও উদ্যোগ নেই। চাহিদার চেয়ে বেশি আমদানির পরেও পেঁয়াজের দাম না কমার রহস্য কবে উদঘাটন হবে তা এখন সরকারেরই অজানা। ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষের কেবল অপেক্ষা পেঁয়াজের নতুন মৌসুমের জন্য যদি প্রাকৃতিক নিয়মে তাতে পেঁয়াজের দামের ঝাঁজ কিছুটা কমে।

প্রজন্মনিউজ২৪/ মামুন

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ