রমজানের শেষ দশ দিনের আমল, তাৎপর্য ও বিধান- হাফিজ মাছুম

প্রকাশিত: ৩১ মার্চ, ২০২৪ ১১:০৮:৫২

রমজানের শেষ দশ দিনের আমল, তাৎপর্য ও বিধান- হাফিজ মাছুম

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ হযরত মোহাম্মদ (সঃ) রমজান মাসের শেষ দশ দিন যে ভাবে কাঠাতেন। পবিত্র মাহে রমজান। এ মাস হলো মুসলিমদের সৌভাগ্যের মাস। এতে রয়েছে তাদের মুক্তি, রয়েছে রহমত প্রাপ্তি, সর্বোপরি জাহান্নাম থেকে বাচার গ্যারান্টি। রমজান মাস পুরোটাই ফজিলতে ভরপুর, তবে ইহার শেষ দশকের ফজিলতটা অনেক বেশি। কারণ তাতে রয়েছে হাজার মাসের চেয়েও উত্তম ফজিলতপূর্ণ একটি রজনী এবং আছে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য ও বিশেষ আমল।

নিম্নে এ বিষয়ে কিছু আলোকপাত করা হলো: ১ রমজানের শেষ দশকে রয়েছে লাইলাতুল কদর নামের একটি রাত যা হাজার মাস থেকেও শ্রেষ্ঠ। যে এ রাতে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে ইবাদত-বন্দেগী করবে তার অতীতের পাপগুলো ক্ষমা করে দেয়া হবে।

আল্লাহ তা আলা বলেন : নিশ্চয় আমি এটি (কুরআন) নাযিল করেছি লাইলাতুল কদরে। তোমাকে কিসে জানাবে  লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদর হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। [সূরা কদর : ১-৩]

লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব: আল্লাহ তা আলা এ রাতকে সকল রাত্রের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিয়েছেন। তিনি তার কালামে এ রাতকে প্রশংসার সাথে উল্লেখ করেছেন। তিনি তাঁর কালাম সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইরশাদ করেছেন : নিশ্চয় আমি এটি নাযিল করেছি বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। সে রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়, [সূরা আদ-দুখান : ২-৩]

বরকতময় রজনী হল, লাইলাতুল কদর আল্লাহ তা আলা একে বরকতময় বলে অভিহিত করেছেন। কারণ, এ রাতে রয়েছে যেমন বরকত তেমনি কল্যাণ ও তাৎপর্য।

বরকতের প্রধান কারণ হল : (ক) এ রাতে আল-কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। (খ) এ রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত লওহে মাহফুজ থেকে ফেরেশতাদের হাতে অর্পণ করা হয় বাস্তবায়নের জন্য। (গ) এ রাতের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হল আল্লাহ তা’আলা এ রাত সম্পর্কে একটি পূর্ণ সূরা (সূরা কদর) অবতীর্ণ করেছেন। যা কিয়ামত পর্যন্ত পঠিত হতে থাকবে। (ঘ) এ রাত হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। অর্থাৎ তিরাশি (৮৩) বছরের চেয়েও এর মূল্য বেশি। (ঙ) এ রজনীতে ফেরেশতাগণ রহমত, বরকত ও কল্যাণ নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করে থাকে। (চ) গুনাহ ও পাপ থেকে ক্ষমা লাভ। এই রাতের ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে: নবী করীম সা. বলেছেন, যে লাইলাতুল কদরে ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে সালাত আদায় ও ইবাদত-বন্দেগি করবে তার অতীতের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। [বুখারী ও মুসলিম]

লাইলাতুল কদরে করণীয়: লাইলাতুল কদরে আমাদের করণীয় হল বেশি করে দোয়া করা, জিকির আযকার করা, নামাজ পড়া, ইবাদত-বন্দেগী করা। হযরত আয়েশা নবী করীম (সা.) কে জিজ্ঞেস করলেন, লাইলাতুল কদরে আমি কি দোয়া করতে পারি? তিনি প্রত্যুত্তরে বললেন, তুমি বলবে : হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালোবাসেন, অতএব আমাকে ক্ষমা করুন। [তিরমিযী]
২ হযরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রমজানের শেষ দশক আসলে রাসূলুল্লাহ সা. পরনের লুঙ্গি শক্ত করে নিতেন। রাত্রি জাগরণ করতেন এবং পরিবারের সকলকে জাগিয়ে দিতেন। [বুখারী ও মুসলিম রাসূলুল্লাহ সা. পরনের লুঙ্গি শক্ত করে নিতেন -এর অর্থ হলো, তিনি এ দিনগুলোতে স্ত্রীদের থেকে আলাদা হয়ে যেতেন। ৩ নবী করীম সা. এ রাতগুলোতে বেশি সময় ও শ্রম দিতেন, যা অন্য কোন রাতে দেখা যেত না। যেমন হযরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি এ রাতে কোরআন তিলাওয়াত, জিকির, সালাত ও দোয়ার মাধ্যমে জাগ্রত থাকতেন এরপর সেহেরি গ্রহণ করতেন। [মুসলিম] ৪ এ দশ দিনের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, রাসূল সা. এ দশ দিনে মসজিদে এতেকাফ করতেন। প্রয়োজন ছাড়া তিনি মসজিদ থেকে বের হতেন না।

এতেকাফ পালন, এতেকাফের সংজ্ঞা: বিশেষ নিয়তে বিশেষ অবস্থায় আল্লাহ তা আলার আনুগত্যের উদ্দেশ্যে মসজিদে অথবা নির্জন স্থানে (মেয়েদের জন্য) অবস্থান করাকে এতেকাফ বলে। এতেকাফ কেন করা হয়? রমজানের শেষ দশ দিন মসজিদে এতেকাফ করা অনেক বড় ইবাদত। হযরত আয়েশা রা. বলেন, নবী করীম (সা.) রমজানের শেষ দশ দিন এতেকাফ করতেন। [বুখারী ও মুসলিম]

তাই আল্লাহ তা আলা যেন আমাদেরকে তাওফিক দান করেন রাসূল সা. -এর এই মূল্যবান সুন্নাত থেকে উপকার লাভ করার। মসজিদ হল আল্লাহর ঘর, আর মালিকের ঘরে তাঁরই কাছে সওয়ালকারী হিসেবে বসে যাওয়া এটা অত্যন্ত সৌভাগ্যের ব্যাপার।

এতেকাফের ফজিলত: এতেকাফ একটি মহান ইবাদত, মদিনায় অবস্থানকালীন সময়ে রাসূলুল্লাহ সা. প্রতি বছরই এতেকাফ পালন করেছেন। দাওয়াত, তাযকিয়া, জিহাদ ও শিক্ষার কাজে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বে-ও প্রতি রমজানে তিনি এতেকাফ করতেন। এতেকাফ আত্মশুদ্ধি ও ঈমানি তরবিয়তের একটি শিক্ষালয় যা রাসূলুল্লাহ সা.-এর হিদায়াতী আলোর মূর্ত প্রতীক। এতেকাফরত অবস্থায় বান্দা নিজেকে আল্লাহর ইবাদতের জন্য দুনিয়ার অন্যান্য সকল বিষয় থেকে আলাদা করে নেয়। ঐকান্তিকভাবে মশগুল হয়ে পড়ে আল্লাহর নেকট্য অর্জনের নিরন্তর সাধানায়। এতেকাফ ঈমান বৃদ্ধির একটি মুখ্য সুযোগ। সকলের উচিত এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজের ঈমানি চেতনাকে শাণিত করে তোলা ও উন্নততর পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করা।

পবিত্র কুরআনে করীমে বিভিন্নভাবে এতেকাফ সম্পর্কে বলা হয়েছে, হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈল আ. -এর কথা উল্লেখ করে ইরশাদ হয়েছে- এবং আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, এতেকাফকারী ও রুকু-সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র করো। [সূরা বাকারা : ১২৫]

এতেকাফ অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে কি আচরণ করতে হবে তা বলতে গিয়ে আল্লাহ তা আলা বলেন- আর তোমরা মসজিদে এতেকাফকালে স্ত্রীদের সাথে মেলামেশা করো না। [সূরা বাকারা : ১৮৭] রাসূল সা. -এর অসংখ্য হাদিসে এতেকাফ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, তার মধ্যে।

ফজিলত সম্পর্কিত কিছু হাদিস নিচে উল্লেখ করা হল: ১ আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা. রমজানের শেষের দশকে এতেকাফ করেছেন, ইন্তেকাল পর্যন্ত। এরপর তাঁর স্ত্রীগণ এতেকাফ করেছেন। [বুখারী ও মুসলিম] ২- য়শা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল সা. প্রত্যেক রমজানে এতেকাফ করতেন। [বুখারী, হা. ২০৪১]
অন্য এক হাদিসে আছে। ৩- নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেন: আমি (প্রথমে) এ রাতের (লাইলাতুল কদর) সন্ধানে প্রথম দশকে এতেকাফ পালন করি। অতঃপর এতেকাফ পালন করি মাঝের দশকে। পরবর্তীতে ওহির মাধ্যমে আমাকে জানানো হয় যে, এ রাত শেষ দশকে রয়েছে। সুতরাং তোমাদের মাঝে যে (এ দশকে) এতেকাফ পালনে আগ্রহী, সে যেন তা পালন করে। লোকেরা তার সাথে এতেকাফ পালন করল। রাসূল সা. বলেন, আমাকে তা (লাইলাতুল কদর) এক বেজোড় রাতে দেখানো হয়েছে এবং দেখানো হয়েছে যে, আমি সে ভোরে কাদা ও মাটিতে সেজদা দিচ্ছি। অতঃপর রাসূল সা. একুশের রাতের ভোর যাপন করলেন, ফজর পর্যন্ত তিনি কিয়ামুল্লাইল করেছিলেন। তিনি ফজর আদায়ের জন্য দ-ায়মান হয়েছিলেন। তখন আকাশ চেপে বৃষ্টি নেমে এল, এবং মসজিদে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি পড়ল। আমি কাদা ও পানি দেখতে পেলাম। ফজর সালাত শেষে যখন তিনি বের হলেন, তখন তার কপাল ও নাকের পাশে ছিল পানি ও কাদা। সেটি ছিল একুশের রাত। [মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ : হা. ১১৭৪ মুসলিম]

৪- হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত হাদিসে উভয়টির (দশ দিন, বিশ দিন) উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. প্রতি রমজানে দশ দিন এতেকাফ করতেন, তবে যে বছর তিনি পরলোকগত হন সে বছর তিনি বিশ দিন এতেকাফে কাটান। [সহীহ বুখারী] ৫- হযরত আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. -এর সাথে তাঁর জনৈকা স্ত্রী-ও এতেকাফ করলেন। তখন তিনি ছিলেন এস্তেহাজা অবস্থায়। রক্ত দেখছেন। রক্তের কারণে কখনো তাঁর নীচে গামলা রাখা হতো। [বুখারী] ৬- রাসূল সা. বলেন, আমি কদরের রাত্রির সন্ধানে প্রথম দশ দিন এতেকাফ করলাম। এরপর এতেকাফ করলাম মধ্যবর্তী দশদিন। অতঃপর ওহি প্রেরণ করে আমাকে জানানো হল যে তা শেষ দশদিন। সুতরাং যে এতেকাফ পছন্দ করবে, সে যেন এতেকাফ করে। ফলে, মানুষ তাঁর সাথে এতেকাফ যাপন করল। [মুসলিম]

এতেকাফের উপকারিতা: ১. এতেকাফকারী এক নামাজের পর আর এক নামাজের জন্য অপেক্ষা করে থাকে, আর এ অপেক্ষার অনেক ফজিলত রয়েছে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূল সা. বলেছেন, নিশ্চয় ফেরেশতারা তোমাদের একজনের জন্য দোয়া করতে থাকেন যতক্ষণ সে কথা না বলে, নামাজের স্থানে অবস্থান করে। তারা বলতে থাকে- হে আল্লাহ! তাকে ক্ষমা করে দিন। আল্লাহ তার প্রতি দয়া করুন, যতক্ষণ তোমাদের কেউ নামাজের স্থানে থাকবে, ঐ নামাজ তাকে আটকিয়ে রাখবে, তার পরিবারের নিকট যেতে নামাজ ছাড়া আর কিছু বিরত রাখবে না, ফেরেশতারা তার জন্য এভাবে দোয়া করতে থাকবে। [বুখারী ও মুসলিম]

২ এতেকাফকারী কদরের রাতের তালাশে থাকে, যে রাত অনির্দিষ্টভাবে রমজানের যে কোন রাত হতে পারে। এই রহস্যের কারণে আল্লাহ তাআলা সেটিকে বান্দাদের থেকে গোপন রেখেছেন, যেন তারা মাস জুড়ে তাকে তালাশ করতে থাকে।

৩ এতেকাফের ফলে আল্লাহ তা আলার সাথে সম্পর্ক দৃঢ় হয়, এবং আল্লাহ তা আলার জন্য মস্তক অবনত করার প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠে। কেননা আল্লাহ তা বলেন-  আমি মানুষ এবং জিন জাতিকে একমাত্র আমারই এবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি। [সূরা আজ-জারিয়াত : ৫৬]

আর এ এবাদতের বিবিধ প্রতিফলন ঘটে এতেকাফ অবস্থায়। কেননা এতেকাফ অবস্থায একজন মানুষ নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহর ইবাদতের সীমানায় বেঁেধ নেয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির কামনায় ব্যাকুল হয়ে পড়ে। আল্লাহ তা’আলাও তাঁর বান্দাদেরকে নিরাশ করেন না, বরং তিনি বান্দাদেরকে নিরাশ হতে নিষেধ করে দিয়ে বলেছেন- ‘(হে নবী আপনি) বলুন, আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের উপর জুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন। তিনি ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। [সুরা ঝুমার : ৫৩]প্রিয় পাঠক! আসুন আমরা রমজান মাসকে যথাযথ কাজে লাগাই এবং এর শেষ দশককে এতেকাফের মাধ্যমে অতিবাহিত করি।

এতেই আমাদের দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা আমাদের তাওফিক দান করুন। আল্লাহুম্মা আমিন।



প্রজন্মনিউজ২৪/আরা

এ সম্পর্কিত খবর

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এপ্রিল ২০২৪ এইচআরএসএস এর মাসিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন।

খালে ভাসছে বাঘের দেহ! 

সম্মানহানির বিচার চেয়ে জবি শিক্ষকের বিরুদ্ধে ডীনের অভিযোগ

ধুনটে সেচ্ছাসেবী সংগঠন স্বপ্নসেবার কমিটি গঠন 

শিক্ষামন্ত্রীসহ সরকারের পদত্যাগের দাবি জানালেন জয়নুল আবদিন ফারুক

ফরিদপুর জেলা পুলিশের উদ্যোগে খাবার পানি, স্যালাইন এবং গামছা বিতরণ অনুষ্ঠিত

সময় তিন অক্ষরের এক ছোট নাম কত মূল্যবান

সিলেট অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা

সিলেট নগরীর সুরমা টাওয়ার থেকে পড়ে সিসিকের এক কর্মচারির মৃত্যু

পিরোজপুরে সড়ক দূর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী ইঞ্জিনিয়ার নিহত

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন





ব্রেকিং নিউজ