ঢাকা কলেজের ইতিহাস

প্রকাশিত: ২০ নভেম্বর, ২০২৩ ০৪:২৬:১৭

ঢাকা কলেজের ইতিহাস

অনলাইন ডেস্ক: উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ ঢাকা কলেজের ১৮২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি ১৮৩ বছরে পদার্পণ করছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটিকে ঘিরে পূর্ববাংলার শিক্ষা বিস্তারের নতুন দিগন্তের সূচনা হয়। এটিই হয়ে ওঠে সে সময়ের শিক্ষা বিস্তারের মূল কেন্দ্রবিন্দু। ঢাকা শহর তো বটেই, এ অঞ্চলের অন্যতম প্রাচীন বিদ্যাপীঠ এটি।

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ১৭৬৫-তে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এরপর থেকেই এই অঞ্চলের শাসকে পরিণত হয় ইংরেজরা।

ইংরেজরা নিজেদের শাসক হিসেবে পরিচয় না দিলেও ১৭৭২ সালে গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস এ মুখোশ খুলে দিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে সরাসরি এ দেশের শাসনভার নেন। পরবর্তী সময় ৬২ বছর পর্যন্ত তারা এ অঞ্চলের অধিবাসীদের জন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা নেয়নি। এত দীর্ঘ সময়ে এ অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থা ঐতিহ্যগতভাবেই চলছিল।

প্রতিবেদনটিতে ইংরেজি সাহিত্য ও বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য যতগুলো সম্ভব বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়েছিল। এরই কাঁধে ভর করে ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই বুড়িগঙ্গার তীরে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় ‘ঢাকা ইংলিশ সেমিনারি’ যা বর্তমানে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল নামে পরিচিত। শিক্ষা-দীক্ষায় অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে থাকা এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে তৎকালীন সিভিল সার্জন ড. জেমস টেইলর ও ঢাকা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট মি. গ্রান্টের ভূমিকা ছিল অগ্রভাগের সৈনিকের মতো।

১৮৬৬ সালে ঢাকায় কর্মরত জয়েন্ট কালেক্টর আর্থার লয়েড ক্লে ‘Principal Heads of the History and statistics of the Dacca Division’ নামে একটি প্রতিবেদন লেখেন। প্রতিবেদনটি ১৮৬৮ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল।

প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠার তারিখ হিসেবে ২০ নভেম্বরের কথাই উল্লেখ আছে। ১৮৪১ সালের ২০ নভেম্বর কলকাতার বিশপ রেভারেন্ড ড্যানিয়েল ঢাকা কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেও ওই ভবনের নকশা করেছিলেন কর্নেল গ্যাসটিন। খাঁটি ব্রিটিশ ঢঙে, বিলাতি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির আদলে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানটি পালন করা হয় বলে প্রচলিত আছে।00

এরপর ঢাকা কলেজের জন্য নির্মাণ করা হয় কার্জন হল। ভিক্টোরীয় স্থাপত্যরীতি, মোগল স্থাপত্যশৈলী আর বাংলার স্বতন্ত্র সংবেদনশীল বৈশিষ্ট্য নিয়ে তৈরি ভবনটি ১৯০৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ভাইসরয় লর্ড কার্জন ঢাকায় এসে এর উদ্বোধন করেন। ১৯০৮ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ওই বছরই ঢাকা কলেজ কার্জন হলে স্থানান্তর হয়।

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার পর ঢাকা কলেজ তার সর্বস্ব দিয়ে ঠাঁই নেয় পুরাতন হাইকোর্টের লাট ভবনে (বর্তমান সুপ্রিম কোর্টে)। ১৯৩৯ সালে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সশস্ত্র সেনারা হাইকোর্ট ভবন দখল করে তাঁবু হিসেবে ব্যবহার করেন। ১৯৪৩ সালে ইসলামিয়া ইন্টারমিডিয়েট কলেজ বর্তমান কবি নজরুল কলেজের মূল ভবনে কিছুদিন অস্থায়ীভাবে কার্যক্রম চালায়। এর অল্পদিনেই ফুলবাড়িয়া স্টেশন সংলগ্ন সিদ্দিকবাজারে খান বাহাদুর আবদুল হাইয়ের পুরাতন ভবনে কার্যক্রম শুরু করে। এরপর ঢাকা কলেজ ১৯৫৫ সালে স্থায়ী জায়গা বন্দোবস্ত পায়।

অবশেষে ঢাকা কলেজের স্থান হয় মিরপুর রোড, ধানমন্ডি ঢাকা-১২০৫ এ। সেই সময়ে ঢাকা কলেজের আয়তন ছিল ২৪ একর। তবে এরশাদ সরকারের সময় প্রায় ৬ একর জমি ছেড়ে দিতে হয়। বর্তমানে ঢাকা কলেজের মোট জমির পরিমাণ ১৮.৬ একর।

১৮৪১ সালে ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠার পর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং হিন্দু কলেজের শিক্ষক জে. আয়ারল্যান্ডকে ঢাকা কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তিনি ১৮৪১ থেকে ১৮৪৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।

ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর এ তিন ধরনের শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। ইতিহাসের অন্যতম এ বিদ্যাপীঠে ১৯৭২ সালে ৬টি বিষয়ে স্নাতক কোর্স শুরু হলেও এখন ১৯টি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর বিষয়ে পাঠদান করা হয়। ১৮৪১ সালে পথচলা শুরুর পর ১৮৫৯-৬০ সালে কলেজের ছাত্র সংখ্যা ছিল ৫২ জন। ১৯১৭-১৮ সালে তা ৯৯৫ জনে গিয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৭ হাজার। ২৪০ জন শিক্ষক এবং ১৯০ এর মতো কর্মচারী রয়েছেন।

কলেজে প্রবেশের প্রধান ফটক, মন জুড়ানো ফুলের বাগান পেরিয়ে অধ্যক্ষের বাসভবন। এর একটু সামনে এগিয়ে গেলেই দেখা মিলে স্মৃতিরোমন্থনের ঝুড়ি নিয়ে বসে থাকা এক ক্যান্টিন। যেখানে আড্ডা, ভালোবাসায় মগ্ন হয়ে থাকেন শিক্ষার্থীরা। ক্যান্টিনের পাশেই রয়েছে বিস্তৃত এক পুকুর। পুকুর জলে শিক্ষার্থীদের দুরন্তপনা দেখলে যে কাউকেই ফিরে যেতে হবে শৈশবে। আর পুকুর পাড়ের কৃষ্ণচূড়া গাছের ফুল যেন অফুরন্ত মুগ্ধতা ছড়ায়। পাশেই বিশাল এক খেলার মাঠ। এর পাশেই রয়েছে দ্বিতল মসজিদ।

বর্তমানে ঢাকা কলেজের ছাত্রাবাসের সংখ্যা ৮টি। ‘দক্ষিণ ছাত্রাবাসের’ ২০৬ নম্বর রুম। এ রুমে থেকেই উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েছেন দেশ বরেণ্য খ্যাতিমান লেখক হুমায়ূন আহমেদ। বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান লেখক ‘চিলেকোঠার সেপাই’ খ্যাত আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ১৯৯২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৯৭ সালের ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। এ লেখকের স্মরণে নির্মিত হয়েছে ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছাত্রাবাস’।

‘পশ্চিম ছাত্রাবাস’ স্থাপিত হয় ১৯৬৪ সালে। এ ছাত্রাবাসে শুধু সনাতন ধর্মের শিক্ষার্থীদের বসতি। পাশেই রয়েছে ‘আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাস’। এ ছাত্রাবাস একটা বিশেষ কারণে বিখ্যাত। এ ছাত্রাবাসের দ্বিতীয় তলায় ২০৯ নম্বর কক্ষ। এ কক্ষেই নিজের শিক্ষা জীবন কাটিয়েছেন মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল কাইয়ুম।

আরেক ছাত্রাবাসের নাম ‘শহীদ ফরহাদ হোসেন ছাত্রাবাস’। শহীদ ফরহাদ সম্পর্কে জানা যায়, তিনি ছিলেন ১৯৯১-৯২ সেশনে দ্বাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। ১৯৯২ সালের ২৫ আগস্ট নীলক্ষেতের বাকুশাহ মার্কেটে ঘাতকরা নির্মমভাবে ফরহাদকে হত্যা করে। তারই স্মরণে নামকরণ হয় এ ছাত্রাবাসের। এছাড়া উত্তর ছাত্রাবাস, দক্ষিণায়ন ছাত্রাবাস ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে শেখ কামাল ছাত্রাবাস। বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামাল ঢাকা কলেজেরই ছাত্র ছিলেন।

এক সময়কার ছাত্র রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু, জাতীয় রাজনীতিতে অনেক ছাত্রনেতা উপহার দেওয়া একটি ব্র্যান্ড ছিল ‘ঢাকা কলেজ ছাত্রসংসদ’। ১৮৪১ সালে ২০ নভেম্বর বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা কলেজের ছাত্রসংসদের রয়েছে একটি অনন্য ইতিহাস ও ঐতিহ্য। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের অনেক উজ্জ্বল নেতা কিংবা প্রয়াত অনেক জাতীয় নেতা ঢাকা কলেজ থেকে তাদের সোনালী রাজনৈতিক জীবনের সূচনা করেছিলেন।

ঢাকা কলেজ ছাত্রসংসদ সম্পর্কে সবচেয়ে পুরনো যে তথ্য পাওয়া যায় তা হলো, ১৯৩২–৩৩ সালের ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নুরুল হুদা, তখন সাধারণ সম্পাদকের পদটিই ছিল সর্বোচ্চ পদ। বর্তমানে সহ-সভাপতি বা ভিপি হলো নির্বাচিত সর্বোচ্চ পদ। এরপর ৫০ এর দশকে ৮টি, ৬০ এর দশকে ৭টি, ৭০ এর দশকে ৩টি, ৮০ এর দশকে মাত্র একটি এবং সর্বশেষ ৯০ এর দশকে ৪টি ছাত্রসংসদ গঠিত হয়। সর্বশেষ ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয় ১৯৯৩-৯৪ সালে।

এখানে আছে, ঢাকা কলেজ সাংবাদিক সমিতি, বিএনসিসি, রেড ক্রিসেন্ট, রোভার স্কাউট, বাঁধন, ঢাকা কলেজ অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব, বিজনেস ক্লাব, ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, ডিবেটিং সোসাইটি, আবৃত্তি সংসদ, সায়েন্স ক্লাবসহ আরও অনেক সংগঠন।

১৯৩৯-৪৫ সালের বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪১ সালের দোল দাঙ্গা, ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তথা শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনে এ কলেজের ছাত্রদের অংশগ্রহণ ছিল অগ্রভাগে।

১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ঢাকা কলেজের ৮ জন ছাত্র শহীদ হয়েছিলেন। শহীদ হওয়া এসব বীর সেনানীদের জীবনের সঠিক ইতিহাস ও প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণে বর্তমানে কাজ করছে ঢাকা কলেজ সাংবাদিক সমিতি। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া এ ৮ বীরকে শ্রদ্ধায় জড়িয়ে রাখতে মূল ভবনের প্রবেশদ্বারের বাম পাশে দেওয়ালে পাথরে খচিত স্মৃতিফলক রাখা আছে।

এছাড়া মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদ আ ন ম নজীব উদ্দিন খান খুররামের নামে ঢাকা কলেজের মূল অডিটোরিয়ামের নামকরণ করা হয়। শহীদদের প্রতি সম্মান ও তাদের স্মৃতি অমলিন রাখতে পর্যায়ক্রমে আবাসিক হলসমূহের নাম এ বীর শহীদদের নামে করা হবে বলেও জানিয়েছে কলেজ প্রশাসন।


প্রজন্মনিউজ২৪/এফএ

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ