পর্তুগালে অভিবাসীদের কৃষিখাতে শোষণের হার বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৩ অক্টোবর, ২০২৩ ০৬:৩০:৪১

পর্তুগালে অভিবাসীদের কৃষিখাতে শোষণের হার বাড়ছে

অনলাইন ডেস্ক: পর্তুগালে অন্তত ৩৫ হাজার অভিবাসী পাচারকারী এবং অসাধু নিয়োগকর্তাদের শোষণের শিকার বলে ধারণা করা হচ্ছে। কৃষিখাতে অভিবাসীদের শোষিত হওয়ার ঘটনা স্বীকার করে দেশটির এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘এটি একটি উদ্বেগজনক ঘটনা।’

পর্তুগালের কৃষি উৎপাদনের সেন্ট্রাল জোন হিসেবে খ্যাত আলেনতেজোতে যতদূর চোখ যায় কৃষিক্ষেত আর খামার। আলু, স্ট্রবেরি, রাসবেরিসহ বিভিন্ন ক্ষেতে গ্রামীণ সৌন্দর্য ফুটে উঠলেও এসব অঞ্চলের বর্তমান উদ্বেগ অন্য একটি বিষয়। সেটি হলো, অভিবাসী শ্রমিকদের শোষণের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়া।

ক্ষেতগুলোর বাঁকা এবং দীর্ঘ আইলগুলো দৃশ্যমান। যেখানে অভিবাসীরা কঠোর পরিশ্রম করেন। পূর্ব ইউরোপের দেশ মোলদোভা ও রোমানিয়া ছাড়াও আফ্রিকার দেশ সেনেগাল, মরক্কো, আলজেরিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল এবং বাংলাদেশ থেকে আসা হাজারো অভিবাসীরা পর্তুগালজুড়ে বিভিন্ন কৃষি ক্ষেতে কাজ করেন।

স্থানীয় এসব সেক্টরের চাহিদা মেটাতে এই বিদেশি শ্রমিকরা দিন দিন পর্তুগিজ কৃষির জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

এই বিপুল সংখ্যক অভিবাসীদের মধ্যে বর্তমানে আনুমানিক ৩৫ হাজার অভিবাসী মানবপাচারকারীদের এবং কৃষি মালিকদের কাছে শোষণের শিকার হচ্ছে। বিশেষ করে, অনিয়মিত অভিবাসীদের প্রশাসনিক পরিস্থিতি এবং পর্তুগালে কাজে মাধ্যমে বৈধ হতে আসা ব্যক্তিদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে একদল অসাধু নিয়োগকর্তা দীর্ঘদিন ধরে আধুনিক দাসত্বের মতো অপরাধ করে আসছেন।

আন্তর্জাতিক মানবপাচার নেটওয়ার্ক এবং কৃষি খাতের নিয়োগকর্তাদের মধ্যে সংযোগ নিয়ে কাজ করেন বৃহত্তর লিসবনের বিচার বিভাগীয় পুলিশের পরিদর্শক জোসে এ। তিনি বলেন, ‘ঘটনাটি খুবই উদ্বেগজনক। এটি শুধুমাত্র অ্যালেন্তেজো নয়, অন্যান্য অঞ্চলেও ঘটছে।’

তিনি ব্যাখ্যা করেন, অনেক নিয়োগকর্তারা জানেন এসব লোকেরা পাচারকারীদের ঋণ পরিশোধ করতে কাজ করতে বাধ্য থাকবেন। যার ফলে অসাধু ব্যক্তিদের কথা মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। এই ধরনের শোষণ নিরাপদ এবং সহজ। আমাদের এই সমস্যা বন্ধ করতে হবে। অভিবাসীরা পর্তুগালে এসেছেন উন্নত জীবনের জন্য, আধুনিক দাস হওয়ার জন্য নয়।

পর্তুগালের টাগুস অঞ্চলের দক্ষিণে অবস্থিত সুসেল, ভিডিগুইরা এবং বেজা শহরের বাসিন্দারা এই ঘটনা মোকাবিলায় কর্তৃপক্ষকে সহায়তার চেষ্টা করে। তারা প্রশাসন ও গণমাধ্যমকে অভিবাসীদের শোষণের সম্ভাব্য ঘটনাগুলো জানাতে দ্বিধা করেন না।

বেজা অঞ্চলে সক্রিয় অভিবাসন সংস্থা কারিতাসের স্বেচ্ছাসেবী সান্দ্রা সুসা বলেন, ‘আমাদের অঞ্চলে আমরা যা দেখতে পাচ্ছি তার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা নীরব থাকতে পারি না। আমি প্রতি সপ্তাহে অভিবাসী শ্রমিকদের সাথে কথা বলি। তাদের অনেকেই আমাকে যারা আমাকে বলে যে তাদের কয়েক মাস ধরে বেতন না পাওয়া কথা জানান এবং সপ্তাহে একদিনও ছুটি না পাওয়ার অভিযোগ করেন। এটি দেখা অগ্রহণযোগ্য।’

পুলিশ পরিদর্শক জোসে এ বলেন, শোষণের শিকার অভিবাসীদের পক্ষ থেকে বেনামী কল বা সাক্ষ্যের ঘটনা বেড়েছে। এছাড়া স্থানীয় বাসিন্দারাও সম্ভাব্য শোষণের ব্যাপারে আমাদের তথ্য দিয়ে থাকেন। এগুলো আমাদের মামলা এগিয়ে নিতে সহায়তা করে। তবে একটি ব্যাপার মনে রাখতে হবে, আমাদের জনবল ও কারিগরি রিসোর্স সীমিত। পাচার ও শোষণ নেটওয়ার্কগুলো সর্বদা পুলিশের থেকে এক ধাপ এগিয়ে থাকার চেষ্টা করে।

দেড় বছর আগে পর্তুগালে আসা তরুণ পাকিস্তানি মাহমুদের মতো দেশজুড়ে অভিবাসীদের পক্ষ থেকে অভিযোগের ঘটনা বাড়ছে। তিনি পর্তুগালের উত্তরের শহর বেইরা আলতায় তার নিয়োগকর্তা থেকে বেতন না পেয়ে বহু মাস কাটিয়েছেন।

তার নিয়োগকর্তা তাকে জাম, নাশপাতি এবং আপেল ক্ষেতে কাজ করতে বাধ্য করেছিল। দৈনিক কোন বিরতি ছাড়াই ১২ ঘণ্টা কাজ করতেন তিনি। প্রতি দুই সপ্তাহে তাকে মাত্র এক দিন বিশ্রাম দেওয়া হতো।

জার্মানি পেরিয়ে আসা এই ২৮ বছর বয়সী অভিবাসী ভেবেছিলেন যে তিনি দক্ষিণ ইউরোপে গেলে উন্নত জীবনের সুযোগ পাবেন। কিন্তু পর্তুগালের এই অভিজ্ঞতা দ্রুত তার জন্য একটি ফাঁদে পরিণত হয়েছিল।

তিনি বলেন, আমি একটি চাকরির প্রতিশ্রুতি নিয়ে এখানে এসেছি। আমার পরিচিতরা আমাকে বলেছিলেন যে পর্তুগাল শ্রমিকদের কাজের মান ও শর্ত ভালো। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পরে আমি বুঝতে পারি যে আমি প্রতারিত হয়েছি। যারা আমাকে নিয়ে এসেছিল তারা দূরে সরে গিয়েছিল। আমি এক প্রকার নিয়োগকর্তা ব্যক্তির করুণাতে বসবাস করছিলাম।

মাহমুদ বলেন, আমি কাজ শুরুর অনেকদিন পরও মজুরি পাইনি। বেতন চাইলে আমার নিয়োগকর্তা আমাকে হুমকি দিয়ে বলেন তিনি পুলিশকে জানিয়ে দেবেন আমি অনিয়মিত অভিবাসী। এটি শুনে আমি ভয় পেয়েছিলাম! পরবর্তীতে একদিন আমি জোয়াওয়ের সাথে কথা বলেছিলাম। তিনি মূলত আমাজকে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছিলেন।

জোয়াও নেভেস। মাহমুদ তার ব্যাখ্যায় যার সম্পর্কে কথা বলেছেন। তিনি পোর্তো শহরে অবস্থিত একটি এনজিওতে কাজ করেন। তিনি জানেন যে পর্তুগাল মানবপাচারকারীদের জন্য দিন দিন পছন্দের ভূখণ্ড হয়ে উঠছে। পুলিশের জনবলের অভাবের সাথে সাথে বেশ কিছু অসাধু মালিকের আত্মতুষ্টির সুযোগে এসব কাজ পরিচালিত হয়।

জোয়াও নেভেস ব্যাখ্যা করেন, সমস্যাটি গভীর এবং সম্প্রতি এটির অপব্যবহার বাড়ছে। সারাদেশের আদালতগুলোতে অভিবাসী শোষণের অনেক মামলার বিচার চলছে। কিন্তু আমি মনে করি এটি কেবল একটি অংশ। এখনও অনেক লোক বিপদে আছেন এবং পাচারকারীরা অভিবাসীদের সাধারণ বাসিন্দাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করে। অনেকেই সকলের দৃষ্টি থেকে দূরে কৃষি জমিতে অস্বাস্থ্যকর কুঁড়েঘরে বাস করে শোষিত হচ্ছেন।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পরিলক্ষিত আরেকটি ঘটনা হল পর্তুগাল এবং স্পেনের মধ্যে অভিবাসীদের বেআইনী পারাপার। উভয় দেশের কৃষকদের হাতে শোষিত অভিবাসীদের দুই দেশের মধ্যে পাচার করা হয়। যা পুলিশের কাজকে আরও কঠিন করে তোলে।

তিনি ব্যাখ্যা করেন, উদাহরণস্বরূপ, এমন শ্রমিক আছে যারা পর্তুগালের আলেন্তেজো বা অ্যালগারভ থেকে বহু সপ্তাহ ধরে ‘নিখোঁজ’ হয়েছেন। তাদের এক সময় হঠাৎ করে স্পেনের দক্ষিণে আবির্ভূত হতে দেখা যায়। পাচারকারী এবং শোষকদের নেটওয়ার্ক শ্রমিকদের শ্রম চাহিদা ও আবহাওয়া অনুযায়ী স্থানান্তর করে। এটি মোকাবিলা করতে পর্তুগিজ ও স্প্যানিশ পুলিশের সাথে অভিবাসন সংস্থাগুলোর মধ্যে সহযোগিতা যত দ্রুত সম্ভব বাড়াতে হবে।

সূত্র: ইনফোমাইগ্রেন্টস


প্রজন্মনিউজ ২৪/এফএ

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ