ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি সেকালে না উঠলেও একালে উঠছে কেন?

প্রকাশিত: ০৩ এপ্রিল, ২০২৪ ১০:৫৯:২২

ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি সেকালে না উঠলেও একালে উঠছে কেন?


রাফিউল হুদা প্রতিনিধিঃ ছাত্রদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে কোনো ন্যায্য দাবি বা অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চা করাই হলো ছাত্ররাজনীতি। ছাত্ররাজনীতি আগামী দিনের নেতৃত্ব তৈরিতে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করে। ছাত্ররাজনীতির সুষ্ঠু চর্চা ব্যতীত আগামী দিনের সুযোগ্য, নৈতিকতা ও আদর্শিক গুণাবলী সমৃদ্ধ নেতৃত্ব তৈরি অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

বর্তমান ছাত্ররাজনীতির সাথে যদি আমরা সেকালের ছাত্ররাজনীতির পার্থক্য করতে যাই তাহলে আমাদের চোখে পড়বে সেকালের ছাত্ররাজনীতির সোনালী ও গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। সেকালে তথা ১৯৪৭ এ দেশভাগের পর থেকে ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে জিন্নাহর ঘোষণার পর গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম স্টুডেন্টস লীগ। একই বছরে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন যার নেতৃত্ব দেয় এই ছাত্রলীগ।

সর্বশেষ ১৯৫২ সালে সালাম, রফিক, বরকতের রক্তের বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায় বাংলা। এরপর ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন থেকে শুরু করে ১৯৬৬ এর ৬ দফা, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, ১৯৭১ এর স্বাধীনতা আন্দোলনসহ প্রতিটি ঐতিহাসিক ও গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসে ছাত্র-ছাত্রীদের অবদান ছিলো সুজ্ঞাত ও সর্বজনস্বীকৃত। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীনের পর এক পর্যায়ে এসে বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির গতিপথ পাল্টাতে শুরু করে এমন সময় ১৯৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে  তৎকালীন স্বৈরাচার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনে ছাত্র ও জনতা।

অতীতে ছাত্ররাজনীতির এতো এতো গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস থাকলেও বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির বেহাল দশা ও বিভিন্নভাবে এই রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে দিন দিন শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে ছাত্ররাজনীতি বিমুখতা।

রাজনৈতিক সহাবস্থান, এক ছাত্রসংগঠনের প্রতি আরেক ছাত্রসংগঠনের শ্রদ্ধাবোধ, যৌক্তিক দাবী আদায়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার মানসিকতা ছিলো সেকালের ছাত্ররাজনীতিতে। সেকালে ছাত্ররাজনীতিতে জড়িত ছাত্র- ছাত্রীদেরকে কোনো রাজনৈতিক দল তাদের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করতে পারতেন না। সেকালে ছাত্রনেতারা যেমন ছিলেন মেধাবী তেমনি নিয়মিত ক্লাশ পরীক্ষা দিয়ে ভালো রেজাল্ট করতেন, পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডেও অংশ নিতেন। ছাত্ররাজনীতির কাজ হলো বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা। ছাত্রসংগঠনের কাজ এটি নয় যে, অন্য কোনো ছাত্রসংগঠনকে ক্যাম্পাস ছাড়া করে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। বরং ছাত্রসংগঠনের উচিত অন্য ছাত্রসংগঠনের সাথে আদর্শিক লড়াইয়ের মাধ্যমে নিজের সংগঠনকে এগিয়ে নেয়া।

কিন্তু বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির অবস্হা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, অতীতে ছাত্রসংগঠনগুলোর স্বকীয়তা বজায় থাকলেও বর্তমানে ছাত্রসংগঠনগুলো তাদের অভিভাবক রাজনৈতিক দলের ম্যানপাওয়ার সাপ্লায়ারে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে ছাত্ররাজনীতির সংজ্ঞা হলো ছাত্রদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা তোলা, এজেন্ডা হিসাবে গ্রহণ করানো এবং সেই এজেন্ডার পক্ষে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে কর্তৃপক্ষকে চাপ দেয়াই হলো ছাত্ররাজনীতি। আর বর্তমান ছাত্ররাজনীতির প্রেক্ষাপটে সংজ্ঞাটি হবে এমন, জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় কোনো রাজনৈতিক দলের ছাত্র শাখা হিসেবে ছাত্রদের মধ্যে সেই দলের সমর্থন তৈরি করা, নেতৃত্ব তৈরি করা এবং সেই দলের স্বার্থে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করা। বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতিতে দ্বিতীয় এই সংজ্ঞাটিই যেন প্রতিফলিত হচ্ছে।

বর্তমানে ছাত্ররাজনীতিকে ব্যবহার করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রসংগঠনগুলো সিট দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদেরকে অভিভাবক রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ডে ব্যবহার করে নিজের প্রভাব জানান দেয়ার চেষ্টা করে অভিভাবক রাজনৈতিক দলের কাছে। কোনো শিক্ষার্থী যদি কথিত ছাত্রনেতা বা বড় ভাইদের কথায় না চলে তাহলে তার ওপর নেমে আসে পাশবিক নির্যাতন। এমনকি অনেককেই হল ছাড়তে বাধ্য করা হয়। অনেক শিক্ষার্থীর কাছে আমরা শুনতে পারি, যদি হলে থাকতে হয় সেই রাজনীতির মতাদর্শে বিশ্বাসী না হলেও সেই দলের রাজনৈতিক মিছিলে যেতে হয়।

বর্তমানে ছাত্রসংগঠনগুলো ছাত্ররাজনীতির মূল আদর্শ  থেকে দূরে সরে গেছে, ছাত্ররাজনীতির ক্ষমতাকে ব্যবহার করে টেন্ডারবাজি, ধর্ষণে সেঞ্চুরি করছে বর্তমানের অনেক ছাত্রনেতাই। ছাত্ররাজনীতিতে যেখানে মেধাবীদের জায়গা করে নেয়ার কথা ছিলো, ছাত্ররাজনীতি থেকে যেখানে দেশপ্রেমিক ও নৈতিকতা সমৃদ্ধ নেতৃত্ব বের হওয়ার কথা ছিলো সেখানে আমরা দেখতে পাই ছাত্ররাজনীতি করা অবস্হায় দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন অনেক ছাত্রনেতা।

বর্তমানে ছাত্ররাজনীতিকে ব্যবহার করে কতিপয় শিক্ষার্থীর এসব অপকর্মের জন্যই সেকালে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবী না উঠলেও বর্তমানে দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদের বিদ্যাপীঠ বুয়েটের মতো জায়গায় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবী উঠছে।

ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের এই দাবী অন্যত্র ছড়িয়ে পরার আগেই ছাত্ররাজনীতির এমন বেহাল দশা থেকে আমাদের বেড়িয়ে আসতে হবে। আর এজন্য প্রয়োজন হবে লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করা। এক্ষেত্রে সবার প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে। সেই সাথে সকল ছাত্রসংগঠনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে আর ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রথা অব্যাহতভাবে চালু রাখতে হবে। পরিশেষে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অতীতের ছাত্ররাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আবার ফিরে আসুক সেই প্রত্যাশা রইলো।


  প্রজন্মনিউজ২৪/আরা 
 

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ