সংলাপ ও সমঝোতা কেন জরুরি

প্রকাশিত: ২৪ জুলাই, ২০২৩ ০৭:৫৯:৪০

সংলাপ ও সমঝোতা কেন জরুরি

মনিরুল ইসলাম রোহান: এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আমাদের দেশে একটি রাজনৈতিক সংকট চলছে। আর এই সংকটটি হলো নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। এরআগের দুই টার্মও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নির্বাচন নিয়ে ছোটখাটো কিছু বিতর্ক থাকলেও সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না কোনো মহলেই।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাগ্রহণের পর ২০১১ সালের ১০ মে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট তত্তাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় দেয়। এছাড়াও বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ সরকার ব্যবস্থাকে বাতিল করা হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের সংশোধনী অনুসারে দুই নির্বাচনের মধ্যকার সময়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৩ মাসের জন্য ক্ষমতা গ্রহণ করতো। তাদের কাজ ছিল, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়া।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হওয়ার পর ওই সময়কার সংসদের প্রধানবিরোধী দল বিএনপি-জামায়াত জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে তীব্র আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু সরকার তাদের দাবি উপেক্ষা করে সংশোধিত সংবিধানের আলোকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। মাঝখানে দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুটি নির্বাচনই দেশের মানুষের কাছে যেমন বিতর্কমুক্ত হয়নি, তেমনি আন্তর্জাতিক মহলের কাছেও মোটাদাগে প্রশ্ন রয়েছে।

সামনে আরেকটি জাতীয় নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে। কিন্তু সরকার ও বিরোধী জোটের মধ্যে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে যে টানাপড়েন চলছিল তা রয়েই গেছে। সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দলীয় সরকারের অধীনে প্রথমবারের মতো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে বিএনপি ও তার মিত্ররা অংশগ্রহণ করেনি।

উপরন্তু নির্বাচনটা যাতে না হয় সেজন্য ওই সময় তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিল বিএনপি ও তার মিত্ররা। তাদের শঙ্কা ছিল, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান ঠেকানোর জন্য তীব্র আন্দোলন গড়ে তুললেও কোনো সুবিধা করতে পারেনি বিএনপি ও তার মিত্ররা।

এরপরেও টানা তিনমাস আন্দোলন চলছিল। ওই আন্দোলন চলাকালে প্রায়ই বাসে আগুন পেট্রোল বোমা নিক্ষেপসহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতো, যা সাধারণ মানুষ নির্বিঘে চলাচলে অসুবিধা হতো। অনেকেই পুড়েছে পেট্রোলবোমায়। দেখতে দেখতে কেটে গেছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও। দলীয় সরকারের অধীনে এটা ছিল দ্বিতীয় নির্বাচন। বিএনপি অংশ নিলেও ভোট বর্জনে শেষ করেছিল তারা। ওই সময়ও সুবিধা করতে পারেনি বিএনপি।

আওয়ামী লীগ একচেটিয়া জয় পেয়ে টানা তিনবারের মতো সরকার গঠন করে। কিন্তু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে বিতর্ক রয়েই যায়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের  নির্বাচন নিয়ে দেশীয়-আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্ন ও বিতর্ক রয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত সেই বিতর্ক চলছে।

তবে সেই বাসে আগুন, পেট্রল বোমা নেই ঠিকই তবে এদেশের মানুষের মধ্যে অস্বস্তির নতুন নতুন মাত্রা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে। দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গের মানুষের রাজধানী ঢাকার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে স্বপ্নের পদ্মাসেতু নির্মাণের মাধ্যমে।

কিন্তু দেশজুড়ে বিদ্যুতের ভয়াবহ লোডশেডিং, হঠাৎ রাতের আধারে জ্বালানী তেলের মূল্য বৃদ্ধি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিসহ নানামুখী সংকটে দেশের মানুষ ভেতরে ভেতরে দুমড়ে মুষড়ে পড়ছে। কাটছাট করে সংসার চালাতে গিয়েও নিন্ম আয়ের মানুষের ত্রাহি অবস্থা। এসব ইস্যুকে ঘিরে গুমোট বাধা রাজনীতির মাঠ প্রায়ই সরব হয়ে উঠে। রাজনৈতিক ময়দানে সরকারী দল ও বিরোধী দলের কর্মসূচি ঘিরে কখনো কখনো উত্তাপও দেখা যায়।

এদিকে আরেকটি জাতীয় নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে শাসক দল আওযামী লীগ ও মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির পাল্টাপাল্টি রাজনীতির মাঠ দখলের হুমকি ধামকি দেশে সংকটময় পরিস্থিতি আরো ঘণিভূত হচ্ছে। এসবের পেছনে মূল একটা কারণ কিন্তু রয়ে গেছে। সেটা হলো রাজনৈতিক সংকট। এদিকে বিএনপি ও তার মিত্ররা যুগপৎ সরকার পতনের এক দফা ফাইনাল রাউন্ড ঘোষণা করেছে। তাদের দাবি, সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্ত, তত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল ও রাজবন্দীদের মুক্তি প্রভৃতি। যদি দাবি না মানা হয় তাহলে সরকারের পতন ঘটিয়ে দাবি আদায় করা হবে।

আওয়ামী লীগও পাল্টা এক দফা ঘোষণা করেছে। তাদের দাবি, সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনার অধীনেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান। সরকারি দল এটাও বলেছে, সংবিধান থেকে তারা একচুলও নড়বে না। দুদুলই তাদের দাবিতে অনড় অবস্থানে থাকায় রাজপথে একই দিনে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করছে। তারা শক্তির মহড়া দিচ্ছে। সরকার ও বিরোধী দলের কর্মসূচিতে মাঝে মাঝে স্থবির হয়ে যায় রাজধানী। সাধারণ মানুষের জীবন এমনিতে ওষ্ঠাগত, তারপর সুষ্ঠু স্বাভাবিকভাবে জীবন পরিচালনায় বিঘ্ন সৃষ্টি। দেশের বিবদমান বড় দু’দলের মধ্যে সংলাপ, সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত সেই সংকট থেকে উত্তোরণের কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। আবার দুদলই এখন নো রিটার্ন পয়েন্টে অবস্থান করায় সংলাপের আশা নিরাশার দিকে ধাবিত হচ্ছে।

দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের অনড় অবস্থান রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়াচ্ছে, এভাবে চলতে থাকলে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার বড় ধরণের আশঙ্কা রয়েছে। সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্থ হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষমতার রদবদল না হলে দেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার জোরালো আশংকা রয়েছে, যা মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। আমাদের যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও উন্নয়ন সাধিত হয়েছে তা আবারো  পিছিয়ে পড়বে।

দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা এই রাজনৈতিক সংকটের অবসান হওয়া জরুরি। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বিবদমান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে অবিলম্বে সংলাপ সমঝোতা হওয়া প্রয়োজন। আলাপ-আলোচনা বা সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই। এজন্য দেশের উন্নয়নের স্বার্থে সংকটের অবসানের কথা জোরালোভাবে ভাবা দরকার। উভয় রাজনৈতিক দলকে বৃহত্তর স্বার্থে কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিভাবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে করা যায় তা নিয়ে এখনই চিন্তা করতে হবে এবং সমাধানে পৌছানো জরুরি। বিশেষ করে নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের যে দাগ আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর লেগেছে তা কিন্তু সরকারকেই নিরসন করতে হবে। যদি মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় তাহলে দেশের যে উন্নয়ন ও অগ্রগতি শুরু হয়েছে সেটা অব্যাহত রাখতে বড় ধরণের সহায়ক হিসেবে কাজ করবে।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।


প্রজন্মনিউজ২৪/একে

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ