প্রকাশিত: ২৯ অক্টোবর, ২০১৮ ০২:৩৭:১৩ || পরিবর্তিত: ২৯ অক্টোবর, ২০১৮ ০২:৩৭:১৩
সব শ্রেণীর মানুষের কাছে সাবান একটি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য। অর্থ বিল-২০১৮ এর তথ্যমতে, পণ্যটির স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ধার্য রয়েছে।এ হিসাবে একটি কাপড় কাচার সাবানের বাজার মূল্য ২০ টাকা হলে তার ৭ টাকাই যাচ্ছে রাজকোষে।
কিন্তু এ কর ব্যবস্থাটি পরোক্ষ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত এর বাড়তি দামের দায়ভার ক্রেতাকেই নিতে হচ্ছে। অথচ করটি প্রত্যক্ষ হলে এটা ওই সাবান কোম্পানিরই দেয়ার কথা।এর ফলে একজন কোটিপতি এবং হতদরিদ্র উভয় ক্রেতাই সাবানের অভিন্ন মূল্য পরিশোধ করছেন।
অর্থাৎ গরিবকেও ধনীর সমপরিমাণ কর দিতে বাধ্য করা হচ্ছে, যা সাধারণের কাছে নিপীড়নমূলক করহিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে।এভাবে দ্রব্য কর, বিক্রয় কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক), আমদানি শুল্ক ও সম্পূরক শুল্ক নামে-আমদানি, উৎপাদন, বাজারজাত, ভোগ ও ব্যবহার পর্যায়ে এই পরোক্ষ কর আরোপ করা হচ্ছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আমদানিপর্যায়ের পণ্য ও কাঁচামাল বন্দরে খালাসের সময় আরোপিত শুল্ক আমদানিকারক পরিশোধ করলেও তা পরে পুষিয়ে নিচ্ছে ওই পণ্যের মূল্যের পরিবর্তন ঘটিয়ে। একইভাবে উৎপাদন, বাজারজাত ও বিক্রিপর্যায়ে ধার্যকৃত ভ্যাট উৎপাদক বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের দেয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তার দায়ভার এসে পড়ছে ক্রেতা-ভোক্তা ও ব্যবহারকারীর ওপরই।
এটি শুধু কোনো একটি পণ্য বা সেবার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বরং খাদ্য ও বস্ত্রসামগ্রী থেকে শুরু করে বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সব ধরনের পণ্য, ভোগ, সেবা এবং বিনোদনের মধ্যেই পরোক্ষ করজালের বিস্তার ঘটেছে। প্রতিবছর বাজেটে এর হ্রাস-বৃদ্ধিও হচ্ছে।
কিন্তু করহার কত বাড়ালে সংশ্লিষ্ট পণ্য ও সেবার দামস্তর কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে রাজস্ব ব্যবস্থায় কোনো নির্দেশনা রাখা হচ্ছে না।আবার লক্ষ্যমাত্রার রাজস্ব আদায়ে চাপাচাপি থাকলেও মুক্তবাজার অর্থনীতির কারণে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের হস্তক্ষেপের নৈতিক সুযোগও তেমন থাকছে না।
আর এর সুযোগ নিচ্ছে কর্পোরেট ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এ দৌড়ে মধ্যস্বত্বভোগী ট্রেডাররাও কম যাচ্ছে না।ফলে বাজেট ঘোষণার পরপরই পণ্য ও সেবার দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। অন্যদিকে দেশের বিদ্যমান অর্থনীতির নানাবিধ সীমাবদ্ধতার ফলে সবার জন্য কর্মসংস্থানও নিশ্চিত করতে পারছে না।
যারা কর্মসংস্থানে আছেন তাদের সবার আয়-উপার্জনও সুষম হারে বাড়ছে না। এ পরিস্থিতিতে দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নআয়ের এবং আড়াই কোটি হতদরিদ্রকে প্রতিনিয়ত পণ্য ও সেবা ভোগের জন্য ধনীদের মতো করে পরোক্ষ করের বোঝা বইতে হচ্ছে।
এতে ব্যক্তির আয় সংকুচিত হয়ে আসছে এবং বৈষম্যও প্রকট হয়ে উঠছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে সামাজিক শ্রেণী কাঠামোয়। এতে শুধু নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তকেই নয়, সমাজের সবচেয়ে নিরাপদ স্তর বলে পরিচিত মধ্য মধ্যবিত্ত শ্রেণীকেও ধাক্কা দিতে শুরু করেছে।যার প্রভাবে ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছে আর্থ-সামাজিক কাঠামো।
ধকল সইতে না পেরে সমাজের নিুমধ্যবিত্তরা দরিদ্রের মুখোমুখি হচ্ছে। আর দরিদ্ররা ধাবিত হচ্ছে হতদরিদ্রে।কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর রাজধানী ঢাকায় সংগৃহীত বাজার দর ও বিভিন্ন সেবা সার্ভিসের তথ্য থেকে দেখা যায়, ২০১৭ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ এবং পণ্যমূল্য ও সেবা-সার্ভিসের মূল্য বেড়েছে ৭ দশমিক ১৭ শতাংশ।
এর আগে ২০১৬ সালে এই বৃদ্ধি ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ। ২০১২ সালে জীবনযাত্রার এই ব্যয় বেড়েছিল শতকরা ৬.৪২ ভাগ এবং পণ্য ও সেবামূল্য বেড়েছিল শতকরা ১৩.০০ ভাগ।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফামের ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশে এই বৈষম্য চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে দাবি করা হয়েছে, বৈষম্য কমানোর প্রতিশ্রুতির সূচকে বিশ্বের ১৫৭ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৮তম।
আর এর নেপথ্যে রয়েছে বিদ্যমান পরোক্ষ কর ব্যবস্থা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, আয় বৈষম্যের কারণে সবচেয়ে গরিবের আয়ের ভাগ ২ থেকে অর্ধেক কমে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক শূন্য ১ শতাংশে। জনসংখ্যার ৯০ শতাংশের আয়ের ভাগই হয় কমেছে বা এক জায়গাতেই স্থির আছে।
বিপরীতে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ মানুষের আয়ের ভাগ বেড়েছে। এটা ২০১০ সালে ছিল ২৪ দশমিক ৬১, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৮৯ শতাংশে। শীর্ষ ১০ শতাংশ ব্যক্তির আয়ের ভাগ ৩৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ দশমিক ১৬ শতাংশে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো অনুযায়ী করের আওতা তথা কর রাজস্ব বাড়াতে হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
তবে এর জন্য পরোক্ষ করের তুলনায় প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর ওপরই মনোযোগী হতে হবে।কারণ জনকল্যাণকামী একটি গণতান্ত্রিক দেশে পরোক্ষ কর আদায়ের হার কোনোভাবেই ৫০ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। তাহলে সামাজিক কাঠামোয় এর একটা বিরূপ প্রভাব পড়ে।
জানা গেছে, দেশের মোট রাজস্ব আয়ের ৬৬ শতাংশ আয়ের উৎস হিসেবেই বেছে নেয়া হচ্ছে এই পরোক্ষ করের খাত। তবে আগের তুলনায় আয়কর, কর্পোরেট কর ও সম্পদ করের মতো প্রত্যক্ষ কর করের আওতা বাড়লেও সেটি বিদ্যমান অর্থনীতি ও কর প্রদানে ব্যক্তির সামর্থ্য অনুযায়ী এখনও কাক্সিক্ষত স্তরে পৌঁছেনি।
চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটেও লক্ষ্যমাত্রার রাজস্ব আয়ে প্রত্যক্ষ করের তুলনায় পরোক্ষ কর বেশি রাখা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ আগের ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে বর্তমানে ৩৪ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।
অথচ প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা প্রচলনের উদ্দেশ্যে মালয়েশিয়া মোট রাজস্বের ৭৫ শতাংশ ও ভারত ৫৬ শতাংশ প্রত্যক্ষ কর খাত থেকে আহরণ করছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ১১০০ ধরনের পণ্য আমদানি হয়। যেখানে ভ্যাট দিতে হয়। এর বাইরে দেশীয় উৎপাদিত ও বাজারজাত করা সিংহভাগ পণ্যেই ভ্যাট ধার্য রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির (বিইএ) সভাপতি ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত জানান, শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) হ্রাস অথবা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকারের বিবেচ্য হওয়া উচিত অর্থনৈতিক বৈষম্য ও অসমতা হ্রাস, ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য নিরসন ও জনকল্যাণ নিশ্চিত করা।
সেটি প্রত্যক্ষ কর ব্যবস্থার মাধ্যমেই সম্ভব। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভ্যাট ও ট্যাক্স আদায়ের বর্তমান কাঠামো অর্থনীতির পরিবর্তিত কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।জয়েন্ট স্টক কোম্পানির নিবন্ধন থেকে জানা যায়, দেশে বর্তমানে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির সংখ্যা এক লাখ দুই হাজার ৪১১টি এবং পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির সংখ্যা এক হাজার ৭২৭টি।
এছাড়া বৈদেশিক কোম্পানি রয়েছে ১৬২টি। অপরদিকে এফবিসিসিআই তথ্যানুযায়ী সারাদেশে বড় বিনিয়োগের ট্রেডার ও ডিলার প্রতিষ্ঠান রয়েছে এমন সংখ্যা হবে আরও কয়েক লাখ।এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, এসব পাবলিক লিমিটেড, প্রাইভেট লিমিটেড (ক্ষুদ্র ও মাঝারিসহ) এবং বৈদেশিক কোম্পানির মধ্য থেকে করজালের আওতায় রয়েছে মাত্র ৬০ হাজার ১৫৮টি প্রতিষ্ঠান।
আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, দেশে ভ্যাট লাইসেন্সধারীর সংখ্যা ৮ লাখ ৪০ হাজারের কাছাকাছি। এর থেকে যদি ২ লাখ ডুপ্লিকেট লাইসেন্সও বাদ দেয়া হয় তাহলেও এর ন্যূনতম সংখ্যা দাঁড়াবে ৬ লাখ ৪০ হাজার। কিন্তু সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে কাক্সিক্ষত কর মিলছে না।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা এর থেকে উত্তরণে বিদ্যমান কর ব্যবস্থার সংস্কার আনার পরামর্শ দিয়েছেন। বলছেন, প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা প্রচলন করে যদি বেশি হারে সক্ষম মানুষকে করের আওতায় আনা যেত।ধনী শ্রেণীর কর ফাঁকি রোধ করা যেত কিংবা যাদের আয়কর দেয়ার কথা তাদের করজালে আনা যেত- তাহলে রাজস্ব আদায়ে নিুআয়ের মানুষের ওপর চাপ কমত।
ফলে দেশে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে যে বিশাল বৈষম্য রয়েছে তা অনেকাংশেই কমে আসত। কারণ প্রত্যক্ষ করই প্রগতিশীল কর, যা ব্যক্তি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের আয়ের ওপর, ঘরবাড়ি-জমিজমার ওপর ধার্য হয়। শুধু সামর্থ্যবানরাই এর ভার বহন করেন।
প্রজন্মনিউজ২৪/ওসমান
ইউএসএ বাংলা সাহিত্য সম্মেলন-২৪
এলাকার রেজান আলীর প্রতারণার ফাঁদে ফারুক মিয়া
কাশ্মীর উপত্যকায় উত্তেজনা, সেনা অভিযানে একজন নিহত
বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবায় থাইল্যান্ডের বিনিয়োগ চান প্রধানমন্ত্রী
চুয়াডাঙ্গায় আজ দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২.৭ ডিগ্রি
এক মিনিটেই তাদের বিসিএসের স্বপ্নভঙ্গ
উপজেলা নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রীরা প্রভাব ফেলতে পারেন