উপমহাদেশের রাজনীতিতে পলাশীর ঐতিহাসিক প্রভাব

প্রকাশিত: ২৭ জুন, ২০২০ ০৩:৫৩:২৫

উপমহাদেশের রাজনীতিতে পলাশীর ঐতিহাসিক প্রভাব

পলাশী যুদ্ধ ও উপমহাদেশের রাজনীতি দুটি বিষয়ই একটি অপরটির সাথে জড়িত। যে কোন যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পিছনে যেমন রাজনৈতিক ভূমিকা থাকে তেমনই যুদ্ধপরবর্তী রাজনীতিতে তার একটি বিশাল প্রভাব বিদ্যমান থাকে।ভারতীয় উপমহাদেশের পরাধীনতা ও পলাশী ট্রাজেডি পরস্পর ওতোপ্রোতভাবে জড়িত।

১৭৫৭ সালের ২৩ই জুন পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশীর প্রান্তরে আম্রকাননে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, তাই পলাশীর যুদ্ধ নামে অভিহিত। বাংলার অফুরন্ত সম্পদের প্রতি ইংরেজ বণিকদের লোলুপ দৃষ্টি,চিন্তা চেতনা তথা বাণিজ্য সম্প্রসারনে বাংলার নবাব সিরাজের সাথে ইংরেজ সরকারের ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে যে দ্বন্দ্বময় সংঘাত সৃষ্টি হয় তাই অত্যন্ত দ্রুতগতিতে পলাশীর যুদ্ধের পটভূমি রচনা করে।

রভার্ট ক্লাইভ দেশীয় বিশ্বাষঘাতকদের সাথে ষড়যন্ত্র পাকাপোক্ত করে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে সন্ধি ভঙ্গের অভিযোগ আনয়ন করে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। অন্যদিকে নবাব ও ইংরেজদের দূর্ভিসন্ধিমূলক কার্যকলাপ সম্পর্কে জ্ঞাত থাকায় তিনিও ইংরেজদের বিরুদ্ধে সমর প্রস্তুতি গ্রহণ করে সামনের দিকে অগ্রসর হন। দেশপ্রেমিক মোহনলাল , মীর মদন ও ফরাসি সেনাপতি সিনফ্রেঁ যুদ্ধ করে ইংরেজ বাহিনীর উপর কঠিন আঘাত হেনে বিপর্যস্ত করে তোলেন।

আকষ্মিকভাবে ইংরেজ সেনাদের নিক্ষিপ্ত গোলার আঘাতে মীর মদন নিহত হলে নবাব হতভম্ব হয়ে পড়েন। এবং পরবর্তীতে নিজের ঘরের শত্রু মীরজাফর পূর্ববর্তী ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্রের যে জাল বুনেছেন তার ফলস্বরুপ নবাবকে যুদ্ধ বন্ধের পরামর্শ দেন। নবাব তার ষড়যন্ত্র বুঝতে না পেরে যুদ্ধ বন্ধ করে দিলে ছত্রভঙ্গ অপ্রস্তুত সিরাজউদ্দৌলার বাহিনীর উপর উর্যপুরি আক্রমণ চালালে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে থেকেও নবাব বাহিনী শেষ পর্যন্ত পরাজয় বরণ করতে হয়।

যার ফলস্বরুপ এ উপমহাদেশে ১৯০ বছর মতান্তরে ২০০ বছর ইংরেজ বেনিয়াদের শাসনব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্থর রচিত হয়। ১৭৫৭ সালের যুদ্ধ কিংবা ঐতিহাসিকদের মতে বিচ্ছিন্ন ঘটনা প্রায় ২০০ বছরের জন্য বাংলাকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করার মাধ্যমে যুদ্ধ পরবর্তীতে উপমহাদেশের রাজনীতিতে এর বিরাট প্রভাব বিস্তার হয়। যার কয়েকটি দিক পর্যালোচনার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি কিভাবে তারা এ উপমহাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে।

 ইংরেজ কোম্পানির রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল সুদূরপ্রসারী তারা ছিল অভিজ্ঞ রাজনৈতিক খেলোয়াড়। তাই তারা প্রথমে মুসলিম প্রধান এলাকায় নিজেরা ক্ষমতা গ্রহণ না করে মুসলিম ব্যক্তিকেই ক্ষমতায় রাখেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরা যাতে বুঝতে না পারে ক্ষমতা হাতছাড়া হয়ে গেছে।

তাই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তারা প্রথমেই মীর জাফরকে ক্ষমতায় বসান এবং লোকজনকে বুঝাতে থাকেন তারা শুধু ব্যবসা করবে, রাজনৈতিক কোন উদ্দেশ্য তাদের নেই। কিন্তু পরবর্তীতে ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় রাজনৈতিক এজেন্ডা হিসেবে বাংলার মুসলমানদেরকে সামনে দিয়ে তারা পিছন থেকে অর্থনীতিকে শোষণ করে নেয়।

 ইংরেজগণই বাংলার প্রভু-ভাগ্যবিধাতা হয়ে উঠে। এ দেশের কোম্পানিই শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। নতুন নবাব কোম্পানির হাতের ক্রীড়নকেই পরিণত হয়। বাংলার সিংহাসনে কে আসে কিংবা কে আসীন হবে তা কোম্পানিই নির্ধারণের অধিকারী হয়ে উঠে। অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তি বাংলার ভূখন্ড থেকে সম্পন্ন নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

 ইংরেজ বেনিয়াদের নির্মম অর্থনৈতিক শোষণের অন্যতম প্রমান ১৭৭০ খিষ্টাব্দে এক ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ, যাকে ইতিহাসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বলা হয়। এ দুর্ভিক্ষে তিন কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় এক কোটির বেশি মানুষ মারা যায়। যার মধ্যে ছিল পঁচাত্তর লাখ মুসলিম এবং বাকিরা নিম্নবর্ণের হিন্দু। যা বাংলার অর্থনীতি ও রাজনীতিতে বিরাট প্রভাব ফেলে।

 এ যুদ্ধে বিজয় লাভের পর ইংরেজ বণিকরা রাজনৈতিক শক্তির মর্যাদায়উন্নীত হয়। তারা বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতাও একচেটিয়াভাবে দখল করার লক্ষ্যে অগ্রসর হয়।

 পলাশী যুদ্ধের রাজনৈতিক প্রভাব হচ্ছে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের জন্ম এবং মুসলিম লীগের জন্মের সাথে সাথে পাক-ভারতে রাজনৈতিক দলের সুচনা হয়। যা এ উপমহাদেশের রাজনীতিতে পরবর্তীতে বিরাট প্রভাব ফেলে।

 ইংরেজ কোম্পানি এতটাই রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দেয় যে প্রায় একশত বছর পিছন থেকে প্রশাসন চালিয়ে এত বেশি ক্ষমতাবান হয়ে যায় যে, তারা প্রশাসন পরিচালনার ভাষা কি হবে তা নির্ধারণ করে দেয়। ১৮৩৫ খ্রিষ্টব্দে ফার্সি ভাষার পরিবর্তে প্রশাসনের ভাষা ইংরেজি করার সিদ্বান্ত বাস্তবায়ন করে। যা তাদের দূরদর্শী রাজনৈতিক পরিচয় বহন করে।

 এ ছাড়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপটগুলো যুদ্ধপরবর্তী বিশ্লেষন করলে প্রতীয়মান হয়, মুলত রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল এবং রাজনৈতিকভাবে পুরো বাংলায় একচেটিয়া শাসন ব্যবস্থা কায়েম করাই একমাত্র তাদের উদ্দেশ্য ছিল। পরিশেষে,পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের ক্ষমতায় আরোহণের মাধ্যমে তাদের যে বিরাট রাজনৈতিক প্রভাব পরিলক্ষিত হয় তার পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একচেটিয়া শোষণ এবং শিক্ষাক্ষেত্রে এ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের পিছিয়ে রাখার জন্য শিক্ষাব্যবস্থাতে মুসলমানদের সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত করার মাধ্যমে তাদের একচেটিয়া স্বার্থ হাসিল হয়।

যার প্রমাণ পাওয়া যায় ডব্লিউ হান্টারের একটি মন্তব্যে- ”১৭৫৭ সালের পূর্বে একটি মুসলিম পরিবারও পাওয়া যয়নি যারা অশিক্ষিত ছিল কিন্তু ১৮৫৮ সালের পর একটি মুসলিম পরিবারও পাওয়া যায়নি যারা শিক্ষিত ছিল’’। উপমহাদেশের রাজনীতিতে পলাশীর রাজনৈতিক প্রভাবকে বিবেচনা করে এমন আরেকটি পলাশী যাতে সৃষ্টি না হয় তার দিকে আমাদের সবার সতর্ক থাকা দরকার।

মোঃ জাহিদুল ইসলাম।

শিক্ষার্থী – চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



A PHP Error was encountered

Severity: Notice

Message: Undefined index: category

Filename: blog/details.php

Line Number: 417

Backtrace:

File: /home/projonmonews24/public_html/application/views/blog/details.php
Line: 417
Function: _error_handler

File: /home/projonmonews24/public_html/application/views/template.php
Line: 199
Function: view

File: /home/projonmonews24/public_html/application/controllers/Article.php
Line: 87
Function: view

File: /home/projonmonews24/public_html/index.php
Line: 315
Function: require_once

বিভাগের সর্বাধিক পঠিত



ব্রেকিং নিউজ