উপকূলীয় তিন জেলায় তীব্র হচ্ছে সুপেয় পানির সংকট

প্রকাশিত: ০৭ মে, ২০২৪ ০৩:৫৭:৫৩ || পরিবর্তিত: ০৭ মে, ২০২৪ ০৩:৫৭:৫৩

উপকূলীয় তিন জেলায় তীব্র হচ্ছে সুপেয় পানির সংকট

খুলনা প্রতিনিধি: জলবায়ু পরিবর্তনে খুলনায় রেকর্ড তাপমাত্রা। সাথে অব্যাহত রয়েছে তীব্র তাপদাহ। দিনদিন তীব্র হচ্ছে সুপেয় পানির সংকট। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকা (খুলনা-বাগেরহাট-সাতক্ষীরা) পানযোগ্য পানি সংগ্রহে রীতিমতো লড়াই করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দেশে যখন বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে তখনও উপেক্ষিত দেশের দক্ষিনাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার মানুষেরা। এ নিয়ে ক্ষোভ নাগরিক নেতাদের।

মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রায় পুড়ছে গোটা খুলনা বিভাগ। গত এক সপ্তাহ ধরে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে এ বিভাগের চুয়াডাঙ্গা জেলায়।  শনিবার খুলনা ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল আর বিভাগের যশোর জেলায় ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল খুলনা বিভাগের ১০ জেলার ওপর দিয়ে গত এক সপ্তাহ ধরে মাঝারি থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। আর তা থাকছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে।

এদিকে উপকূলীয় জনপদের কষ্ট লাঘবে ২০২২ সালে শুরু হয় উপকূলীয়‘জেলাসমূহে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে পানি সরবরাহ’ প্রকল্প। হাজার কোটি টাকার সেই প্রকল্পর ২০২৫ সালে মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবায়নে হারিয়েছে গতি। প্রকল্পের অগ্রগতির হার ৩৫ শতাংশ। দুর্যোগপ্রবণ উপকূলীয় এলাকায় বিভিন্ন প্রকল্পে গতি ফিরিয়ে আনা না গেলে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যহত হবে বলছে উপকূলীয় অঞ্চলে কাজ করা বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা গুলি। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সিসিডিবির গবেষনা বলছে দেশের খুলনা-সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার উপকূলীয় উপজেলার ৮৭ ভাগ মানুষ চরম দুর্যোগ ঝুঁকিতে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝুঁকিতে থাকা উপকূলীয় এসব মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত না হলে এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশ।

জলবায়ু নিয়ে কাজ করা অ্যাওসেড এর নির্বাহী পরিচালক মোঃ শামিম বলেন, উপকূলীয় এলাকায় পানির যে আঁধার ছিলো, তা আমরা বন্ধ করে অবকাঠামো নির্মাণ করেছি। পুকুরগুলো সব বন্ধ করে দিয়েছি। এ অঞ্চলের বৃষ্টির পানি ভূগর্ভস্থ হতে পারে না। পাশাপাশি নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় তা ধারণ ক্ষমতা হারিয়েছে।  গত ত্রিশ বছরে নদীগুলো নাব্যতা হারিয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় বাধ থাকার কারণে নদী ও খালের মধ্যে ধাবিত হয়েছে। সরকারি  খালগুলো উদ্ধার করতে হবে। এরপর পূনর্খনন করে তার যর্থাথ ব্যাবহার করতে হবে। মিঠা পানির প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। যেভাবেই হোক বৃষ্টির পানি সংরক্ষনের উদ্যোগ নিতে হবে।

খুলনা জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শেখ হারুনুর রশীদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে বিরুপ প্রভাব পড়েছে খুলনায়। যা মোকাবিলায় পুকুর খননসহ একাধিক প্রকল্পের পরিকল্পনা রয়েছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, উপকূলীয় জেলাসমূহে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে পানি সরবরাহ প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ১ কোটি টাকা। ২০২২ সালের জুলাই মাসে শুরু হওয়া প্রকল্পটি ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা। খুলনার  উপকূলীয় তিন জেলার ২০টি উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। প্রকল্পের আওতাভুক্ত এলাকাগুলো হলো, খুলনা জেলার ডুমুরিয়া, রূপসা, তেরখাদা, বটিয়াঘাটা, দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছা। বাগেরহাট জেলার কচুয়া, চিতলমারী, মোংলা, মোরেলগঞ্জ, রামপাল ও শরণখোলা। সাতক্ষীরা জেলার সদর, আশাশুনি, কলারোয়া, কালীগঞ্জ, তালা, দেবহাটা ও শ্যামনগর। এই প্রকল্পের আওতায় বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য প্রতিটি ট্যাঙ্কের পানি ধারণক্ষমতা তিন হাজার লিটার। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্যমতে, প্রতিটি পানি সংরক্ষণ ইউনিট নির্মাণে ৪৫ হাজার টাকা এবং ক্যাচমেন্ট এরিয়া নির্মাণে ৬ হাজার ৯৮০ টাকা ব্যয় হবে। এরই মধ্যে ৫০ হাজার পানি সংরক্ষণ ইউনিট নির্মাণ এবং ৩ হাজার ৮০০ ক্যাচমেন্ট এরিয়া নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকল্পভুক্ত এলাকাগুলোয় সেফলি ম্যানেজড পানি সরবরাহের কাভারেজ ২০৩০ সাল নাগাদ ৬০ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত করা হবে।

খুলনা 
সুপেয় পানির তীব্র সংকটে ভুগছেন খুলনা জেলার উপকূলীয় উপজেলা সমুহ। শুকিয়ে গেছে পুকুর, নলকুপে উঠছেনা পানি। সমস্যা সমাধানে সরকারি প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হরছে ঠিকই, কিন্তু তদারকি করার মতো  কেউ নেই। ফলে এ প্রকল্পের অধিকাংশ ট্যাংকি নামমাত্র পড়ে আছে। জনপ্রতিনিধির লোক ছাড়া পাচ্ছে না পানির ট্যাংকি। অভিযোগ রয়েছে পানির ট্যাংকি বসাতে নেওয়া হয়েছে অতিরিক্ত টাকা।

বটিয়াঘাটার সুরখালি ইউনিয়ন চেয়ারম্যান বলেন, প্রকল্পের কাজ চলমান। আমি ইউনিয়নবাসির মধ্যে বন্টন করি। তবে অন্য জনপ্রতিনিধিরা কে কি করলো তা আমি বলতে পারবো না।
পাইকগাছার বাজুয়া চেয়ারম্যান মানস কুমার সাহা বলেন, প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। পানি ট্যাংকিতে সংরক্ষিত পানি দুই থেকে তিন মাস যায় একটি পরিবারের। যা উপক‚লবাসির চাহিদা পূরন করতে পারছে না।

কয়রা উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ শফিকুল ইসলাম বলেন, চলমান এ প্রকল্পের দায়িত্বে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্য। তাই এ প্রকল্প সম্পর্কে আমার জানা নেই।
খুলনা-১ আসনের এমপি ননি গোপাল মন্ডল বলেন, আমি নির্বাচিত হওয়ার পরে এ প্রকল্পের কোন কাজ পাইনি।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানের তীব্র তাপদাহে তরমুজ চাষের ফলে কোথাও সুপেয় পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এ অঞ্চলের অন্যতম আয়ের উৎস তরমুজ চাষ। পানির কারণে যা ব্যাহত হচ্ছে। সমস্যা নিরসনে তিনি সরকারি পুকুরগুলো থননের কথা ভাবছেন বলে জানান।

বাগেরহাট
বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলায় তিন হাজার পানির ট্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। তবে আরও তিন হাজার স্থাপন করা হবে। তবে কোনটি ট্যাংকিতে-ই পানি নাই। এ উপজেলায় চলছে পানির জন্য হাহাকার।
উপজেলার হোগলাবুনিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আকরাম হোসেন বলেন, প্রায় পাঁচশত পানি ট্যাংক স্থাপন করা হইছে। তবে কোনটায়ই এখন পানি নেই। পানির জন্য হাহাকার চলছে।
এ ইউনিয়নের স্কুল শিক্ষক মোঃ আলামিন হোসেন বলেন, আমাদের  বাড়িতে একটা ট্যাংকি স্থাপন করা হইছে। যা তিন মাসের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। এখন আমরা প্রায় আট কিলোমিটার দূর থেকে পানি কিনে খাই।
মোরেলগঞ্জ উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী মোঃ মনিরুল ইসলাম বলেন, উপজেলায় মোট তিন হাজার ট্যাংকি স্থাপন করা হয়েছে। আরও তিন হাজার স্থাপন করা হবে। যার কাজ চলমান রয়েছে। তিনি আরও বলেন, প্রতিটি ট্যাংকির জন্য বাজেট ৪৫ হাজার টাকা। এছাড়া স্থাপনের জন্য ১৫০০ টাকা নেওয়া হয়।

সাতক্ষীরা
লবণাক্ততার কারণে সুপেয় পানির তীব্র সংকটে ভুগছেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কয়েক হাজার পরিবার। সমস্যা সমাধানে সরকারি প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তদারকি করার মতো  কেউ নেই। ফলে এ প্রকল্পের অধিকাংশ ট্যাংকি নামমাত্র পড়ে আছে। এ এলাকায় পানির ট্যাংকি বসাতে নেওয়া হয়েছে অতিরিক্ত টাকা। ১৫০০ থেকে শুরু করে ১৫ হাজার পর্যন্ত টাকা নেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গ্রাহক জানান, ‘শুরু থেকেই নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। সরকারি প্রকল্পগুলো যদি ঠিকমতো কার্যকর হতো তাহলে পানির সমস্যা অনেকাংশে লাঘব হতো।’ এসব প্রকল্প আসল অর্থে কোনো কাজের নয়।

শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মাছুদুল আলম বলেন, উপকূলীয় এ ইউনিয়নে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পানির বৃষ্টির পানি সংরক্ষন প্রকল্পের কাজ চলমান। অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের ব্যাপারে তিনি বলেন, পানির ট্যাংকি বিভিন্ন জন-প্রতিনিধির মাধ্যমে বন্টন হয়েছে।  কে কত নিছে বলতে পারবো না। তবে আমি ১৭৫০ টাকা নিয়েছি।

সাতক্ষীরা-৪ (শ্যামনগর- কালিগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য আতাউল হক দোলন বলেন, আমার নির্বাচনি এলাকা সাতক্ষীরা-৪ (শ্যামনগর- কালিগঞ্জ) তে ২০ টি ইউনিয়নের ১৬ টিতে  কাজ চলমান রয়েছে। বাকি চার ইউনিয়নের জন্য প্রস্তাব করেছি।
অর্থ নেয়ার অভিযোগ তিনি স্বীকার করে বলেন, আমার কাছে অভিযোগ এসেছে, আগের এমপি থাকাবস্থায় টাকা  নেয়া হয়েছে। তবে আমি নির্বাচিত হওয়ার পরে নতুন কোন কাজই শুরু হয়নি।
খুলনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আকমল হোসেন বলেন, এই প্রকল্পে উপকারভোগী কারা হবেন, তা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ঠিক করেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য ৫০ শতাংশ, উপজেলা  চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন পরিষদ  চেয়ারম্যানরা বাকি ৫০ শতাংশ নির্ধারণ করেন। প্রকল্পের যা যা আছে,  সেভাবে যেন কাজগুলো হয়  সে বিষয়ে নজর রাখা হচ্ছে। তার পরও যদি কোথাও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায়,  সেগুলো স্বচ্ছভাবে করতে নির্দেশনা দেওয়া হবে।


প্রজন্মনিউজ২৪/এফএইচ

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ