সুদান সংকটের পিছনে যে কারণ দুটি দায়ী!

প্রকাশিত: ০১ মে, ২০২৩ ০১:২৭:০৬ || পরিবর্তিত: ০১ মে, ২০২৩ ০১:২৭:০৬

সুদান সংকটের পিছনে যে কারণ দুটি দায়ী!

সুদান উত্তর আফ্রিকার একটি মুসলিমপ্রধান দেশ। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে এটি একটি অনুন্নত দেশ মনে হয়। কিন্তু ২০১৭ সালের দিকেও সুদানের অর্থনীতি আমাদের টাকার তুলনায় বিশগুণ শক্তিশালী ছিল। ২০১৭ সালে সুদানি এক পাউন্ড সমান বাংলাদেশি বিশ টাকা ছিল। বর্তমানে সুদানি মুদ্রার মান অনেক নিচে নেমে গেছে। বিশ্ব রাজনীতিতে ভৌগোলিকভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ এই দেশে প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে মানুষ্য বসতির প্রমাণ প্রত্ন সূত্রে প্রমাণিত হয়েছে। এর নিদর্শন সুদানের জাতীয় জাদুঘরে আজও সংরক্ষিত আছে। ইসলামের জন্মস্থান সৌদি আরবের পশ্চিমে অবস্থিত এ দেশটির মুসলিমদের ইতিহাস অনেক পুরনো। উসমানীয় খেলাফতের অধীন এসে মুসলিম সংস্কৃতির বিকাশ ও শাসনকার্য দীর্ঘদিন পরিচালিত হয়েছিল। আজও রাজধানী খার্তুনে উসমানীয় শাসকদের মসজিদ ওই সাক্ষ্য বহন করছে। ১৯২৪ সালে উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন হলে ব্রিটিশরা দখল করে নিয়েছিল সুদান। এ দেশটি দীর্ঘদিন তাদের কলোনি হিসেবে শোষিত হয়। অনেক সংগ্রামের পর ১৯৫৬ সালে সুদান স্বাধীনতা লাভ করে এবং বিশ্বব্যাপী স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

স্বাধীনতার পর ধর্মনিরোপেক্ষ শাসকরাই সুদানের শাসনকার্য পরিচালনা করলেও বৈদেশিক অর্থায়ন এবং বিভিন্ন এনজিওর কার্যক্রম দক্ষিণ সুদান ও দারফুর অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে দেয়নি। বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বসবাসের এ দেশটিতে বৈদেশিক ষড়যন্ত্র সব সময় সক্রিয় ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালে দক্ষিণ অঞ্চলে দক্ষিণ সুদান নামে স্বাধীন খ্রিস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সুদানের রাজনৈতিক ইতিহাসে ইসলামিক রাজনীতি কখনো শক্তিশালী হয়নি। তবে ফ্রান্স ও ব্রিটেন থেকে পড়ালেখা শেষ করে ড. হাসান আল তোরাবি দেশে ফিরে সুদানের মুসলমানদের জন্য লেখালেখি ও রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি মুসলিমদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ও নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন। কিন্তু ১৯৮৯ সালে জেনারেল ওমর আল-বশির সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করলে হাসান তোরাবি তাকে সমর্থন করেছিলেন এবং সংসদের স্পিকার ও পরবর্তীকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বও গ্রহণ করেছিলেন। অথচ তাদের এই সম্পর্ক বেশিদিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। জেনারেল ওমর আল-বশির দীর্ঘ সময় সুদান শাসন করলেও কিছু মৌলিক নীতি গ্রহণ করেছিলেন।

আমার ওআইসির দাওয়াতে ২০১৭ সালে সুদানে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব আফ্রিকার সফরে অনেক শিক্ষক, গবেষক ও সুদান সরকারের উচ্চপদস্থ কয়েক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগে জানতে পেরেছিলাম তাদের পশ্চিমা শক্তির বিপরীতে কাজ করতে বেশি পছন্দ ছিল। মূলত আমেরিকা-ইসরায়েলের বৈদেশিক নীতির বিপরীতে তারা চলার চেষ্টা করত। সুদানে আমেরিকার কার্যকর কূটনৈতিক কার্যক্রম গত ২৫ বছর বন্ধ ছিল এবং তারা শত শত অবরোধ দিয়ে সুদানকে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ বানানোর সব চেষ্টাই করেছিল। তবে সুদানে ২০১৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ওমর আল-বশিরের ক্ষমতার সমাপ্তি ঘটে, পুরাপুরি বৈদেশিক নীতি পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং বর্তমান সংকটের মূল উৎস এখানেই। আমার দৃষ্টিতে সুদান সংকটের দুটি কারণ চিহ্নিত করা যায়।

প্রথমত, সুদানের দারফুরে জাতিগত সংঘর্ষের সময় জেনারেল ওমর আল-বশির সরাসরি সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণে অভিযান পরিচালনা না করে আধা সামরিক বাহিনী গঠন করেছিলেন। তা আজ শক্তিশালী রাজনৈতিক ও সামরিক গ্রুপ হিসেবে বিবেচিত। এর নাম র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস বা (আরএসএফ)। এ গ্রুপটি সারাদেশে সামরিক বাহিনীর বিপরীতে যুদ্ধ করছে। বর্তমানে এ গ্রুপটিও আমেরিকা ও ইসরায়েলের সমর্থনপ্রাপ্ত একটি আধা সামরিক বাহিনি।

দ্বিতীয় কারণটি হলো ওমর আল-বশিরের ১৯৮৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত শাসনকালে সুদানের ফরেন পলিসি মুসলিম বিশ্বের কল্যাণকর হিসেবে বিবেচিত ছিল। আমেরিকা ও ইসরায়েলের আপত্তি সত্ত্বেও তার কূটনৈতিক রীতি-নীতি (ফরেন পলিসি) পরিবর্তন হয়নি। এ কারণে পশ্চিমা জোট অর্থনৈতিক অবরোধসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল আফ্রিকার শক্তিশালী অর্থনীতির এবং ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম দেশটিকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা। ইরাক, সিরিয়া, ইয়ামেনসহ অন্যান্য মুসলিম দেশের ওপর যেভাবে বিভিন্ন অজুহাতে গৃহযুদ্ধ বাঁধানো হয়ছে ঠিক সেভাবে এখানেও প্রচেষ্টা দৃশ্যমান ছিল। ২০১১ সালে সুদানের দক্ষিণ অঞ্চলে স্বাধীন খ্রিস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পশ্চিমা জোটের প্রচেষ্টা অনেকটা সফল হয়েছিল। তবে তৎকালীন শাসক ওমর আল-বশির দক্ষিণ সুদানের রাজধানীতে অনুষ্ঠিত ওই ঐতিহাসিক প্রোগ্রামে উপস্থিত ছিলেন। তা সমকালীন রাজনীতিতে বিরল দৃষ্টান্ত। কিন্তু ২০১৭ ও ১৯১৮ সালে গণতন্ত্রের দাবিতে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, গণআন্দোলন এবং ২০১৯ সালের জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ আবদুর রহমান আল বুরহানের সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে আমেরিকা ও ইসরায়েলের সরাসরি মদদ ছিল বলে অনেকেই মনে করেন। এর যথেষ্ট প্রমাণও রয়েছে। যেমন অভ্যুত্থানের পর এই সরকারের ওপর থেকে অবরোধ তুলে নেওয়া হয়, ট্রাম্পের দাবির কারণে আমেরিকাকে অর্থদণ্ড প্রদান করে সুদান এবং ২০২২ সালে ২৫ বছর পর সুদানে কার্যকর আমেরিকার কূটনৈতিক মিশন চালু হয়। সুদানের ক্ষমতা গ্রহণের পর এই জেনারেল মিসর ও আরব আমিরাত সফর করেন। এ দেশ দুটি মূলত মধ্যপ্রাচ্যের ইসরায়েল ঘনিষ্ঠ দেশ হিসেবে পরিচিত। অর্থাৎ অভ্যুত্থানের জন্য সুদানের ফরেন পলিসি পরিবর্তন হয়ে যায়। ফলে আজ সুদানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট প্রকট থেকে প্রকট হয়েছে। গত দুই মাস আগে ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুদান সফর ও জেনারেল বুরহানের সঙ্গে মিটিং করেন। এর মূল উদ্দেশ্য হলো ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে সুদানকে। আসলে ইসরায়েল দুই গ্রুপের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখছে যেন তার আসল উদ্দেশ্য হাসিল হয়।

বিগত বছরগুলোয় সুদানের সাধারণ মানুষ গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন দেখেছিল, তা আজ দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। শত্রুর শত্রু বন্ধু নীতিতে পশ্চিমা বিশ্ব আজ সুদানের রাজনীতিতে ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠছে। কিন্তু বর্তমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে এবং সৌদি-ইরান সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা হওয়ায় আমেরিকা-ইসরায়েলের বৈদেশিক পলিসি ও স্বার্থ কতটা বাস্তবায়িত হবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে আমাদের প্রত্যাশা সুদানের সাধারণ মানুষের জানমাল নিরাপত্তার জন্য সামরিক জান্তা ও আধা সামরিক বাহিনীর মধ্যে চলমান এই সংঘর্ষের সমাপ্তি ঘটুক এবং রাজধানী শহরসহ সারাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক।

লেখক: ড. একরাম উদ্দীন সুমন

এডজানক্ট ফ্যাকাল্টি, নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।

প্রজন্মনিউজ/এনএ

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ