রমজানের আগে ঊর্ধ্বমুখী বাজার, রোজার ভয়াবহ হওয়ার শঙ্কা

প্রকাশিত: ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪ ০৫:৩৫:১০

রমজানের আগে ঊর্ধ্বমুখী বাজার, রোজার ভয়াবহ হওয়ার শঙ্কা

রাজশাহী প্রতিনিধি: চালের বাজারে সরকারি অভিযান, কিছু পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়া, সবজির মৌসুমি সরবরাহ—প্রত্যাশা করা হয়েছিল যে, এসব কারণে বাজারদরে স্বস্তি ফিরে আসবে। কিন্তু বাজারে গিয়ে ভোক্তার স্বস্তি মিলছে না। বছরের শুরুতে চালের দাম বেড়ে যাওয়াকে অস্বাভাবিক হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলেও রাজশাহীর বাজারে চালের দামে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। উল্টো গত এক সপ্তাহে বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম।

শুক্রবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) রাজশাহী নগরীর কয়েকটি বাজার  ঘুরে দেখা যায় সেসব বাজারের শীতের কাচা সবজি, মাছ, মাংস, চাল প্রভৃতি নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য দ্রব্যের দাম শোনা হয়। এসব বাজারে দেখা গেছে, শীতের সবজির ভরা মৌসুমে পুইশাক, লাল শাক, টমেটো, করলা, পোটোলসহ বেশ কয়েকটি সবজির দাম গত এক সপ্তাহের তুলনায় বেড়েছে। পটোল ও করোলা ১৬০ টাকা কেজি দামে বিক্রি করতেছে দোকানদাররা। শশা ও বরবটি ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতেছে। পাশাপাশি বেড়েছে ফার্মের মুরগির ডিমের দামও। সাধারণত বছরের এ সময় সবজির দাম কম থাকে। কিন্তু এবার সবজি, মাছ, মাংস সবকিছুর দাম এখনো বাড়তি। 

দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার দীর্ঘদিন ধরে ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ গত ডিসেম্বর মাসের হিসাবে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ। এই মাসে গ্রাম-শহরনির্বিশেষে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ, অর্থাৎ এক বছর আগের চেয়ে অতিরিক্ত দামে মানুষকে খাদ্য কিনতে হচ্ছে। অন্যদিকে, মূল্যস্ফীতির তুলনায় সাধারণ মানুষের আয় তেমন বাড়েনি। উচ্চ মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তুলছে। তবে কোনো ব্যবস্থাই বেশির ভাগ পণ্যের মূল্য কমাতে পারছে না।

চালের দাম হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার পর খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার দাম কমাতে ব্যবসায়ীদের চার দিন সময় বেঁধে দেন।  গতমাসের ১৭ জানুয়ারি চালের দাম আগের পর্যায়ে নিয়ে আসার এই নির্দেশে সায় দিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরাও। এরপর চালের বিভিন্ন মোকামে ও বাজারে সরকারি অভিযান চলে, জরিমানা করা হয় অনেক ব্যবসায়ীকে। ফলে জেলাপর্যায়ে চালের দাম কিছুটা কমলেও ঢাকার বাজারে এর প্রভাব খুব একটা দেখা যাচ্ছে না।

দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে আলু, দেশি পেঁয়াজ ও ডিম—তিন পণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু বেঁধে দেওয়া দর কখনোই কার্যকর করা যায়নি। এর বাইরে দাম নির্ধারণ করে দেওয়া আছে চিনি, ভোজ্যতেল ও রান্নার গ্যাসের (এলপিজি)। কিন্তু এসব পণ্যের বেশির ভাগই বিক্রি হয় বাড়তি দামে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনার জন্য যাঁদের নিয়মিত বাজারে যেতে হয়, তাঁদের অনেকে বেশ কষ্টেই আছেন। বাজারে আাসা রফিকুল ইসলাম নামের এক ক্রেতা বলেন, ‘বাজারে এখন কোনো অভিভাবক নেই। যে যেভাবে পারছে, দাম বাড়াচ্ছে। আর এতে কষ্ট পাচ্ছে কেবল আমাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষেরা। বিশদিন পর রমজান মাস, এর আগে যেভাবে হুবহু করে সব দ্রব্যের দাম বাড়তেছে নাযানি রোজায় কি অবস্হায় দারাবে।’

দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার পর গত সেপ্টেম্বরে আলু, দেশি পেঁয়াজ ও ডিম—তিন পণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু বেঁধে দেওয়া দর কখনোই কার্যকর করা যায়নি।

শুক্রবার (২৩ ফেব্রুয়ারী)  রাজশাহী নগরীর চারটি বাজার ঘুরে এবং সেখানকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে যে বাজারে নির্দিষ্ট ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য স্বস্তির কোনো খবর নেই। এসব বাজারের বিক্রেতারা জানান, বছরের শুরুতে বাজারে চালের দাম যতটা বেড়েছে, তা এখনো খুব একটা কমেনি। খুচরা পর্যায়ে চালভেদে কেজিতে কেউ কেউ এক-দুই টাকা কম রাখছেন, তবে বেশির ভাগ বিক্রেতা আগের বাড়তি দামেই চাল বিক্রি করছেন।

বিভিন্ন খুচরা বাজারে শুক্রবার মাঝারি মোটা চাল (বিআর-২৮) বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৬০-৬২ টাকায়। এ ছাড়া মাঝারি সরু চাল (মিনিকেট) ৬৮ টাকা, নাজিরশাইল ৮০ টাকা, কাঁটারিভোগ ৮০ টাকা,  বাসমতী ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। 

চালের বাজারের যখন এই অবস্থা, তখন এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে মুরগির ডিম ও দেশি পেঁয়াজের দাম। বাজারে এখন দেশি পেঁয়াজই বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে ৮০ থেকে ১০০ টাকা হয়েছে। আর ডিম বিক্রি হচ্ছে প্রতি ডজন ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায়। সপ্তাহখানেক আগে ডিমের দাম ছিল ১৩০ টাকা।

সাধারণত ফেব্রুয়ারী মাসে দেশে শীতের সব সবজির দাম একবারে নিচে নেমে আসে। কিন্তু এই ভরা মৌসুমেও ব্রকলি, লাউ, টমেটো, করোলা, পটোল, বরবটি ও পেঁপেসহ বেশ কিছু সবজির দাম উল্টো বেড়েছে। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এসব সবজির দাম ১০ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তবে স্থিতিশীল রয়েছে মুলা, গাজর, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, শিম ইত্যাদি সবজির দাম। সবজির মধ্যে নতুন আলু ও গোল বেগুনের দাম কেজিতে ১০ টাকার মতো কমেছে। রাজশাহীর বাজারগুলোতে আলু ২০ থেকে ৩০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।

নগরীতে মাছের দাম নিয়ন্ত্রণের বাহিরে। শুক্রবার বাজারে কেজি প্রতি ইলিশ ১৮০০ টাকা, দেশি কই মাছ ৬০০ টাকা, দেশি মাগুর ৬০০ টাকা, চিংড়ি ৮০০ টাকা, শিং মাছ ৫০০ টাকা, দেশি টেংরা ৩৫০ টাকা, গড়াই মাছ ৩২০ টাকা, বোয়াল ৪০০ টাকা, ছোট- বড় তেলাপিয়া ২২০ টাকা, পুঁটি মাছ ৪০০ টাকা, রুই প্রতি কেজি ২০০ টাকা পাঙাশ ২২০ থেকে ২৫০ টাকা এবং বড় মাছ ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। 

এক মাস আগে মাংস বিক্রেতা ও খামারিরা মিলে গরুর মাংসের দাম নির্ধারণ করেন প্রতি কেজি ৬৫০ টাকা। বছরের শুরুতেও বাজারে এই দাম ছিল। অধিকাংশ বাজারে এখন প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকায়। এ ছাড়া বকরি ১ হাজার টাকা এবং খাসির মাংস ১ হাজার ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।

বাজারে ব্রয়লার মুরগী গত সপ্তাহের চেয়ে ২০ টাকা বেশি দামে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি মুরগী ৫০০ টাকা, সোনালী ৩১০ টাকা করে কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে। যা গত সপ্তাহের চাইতে বেশি।

পবিত্র রমজান মাসে ভোজ্যতেল, চিনি ও খেজুরের ওপর আরোপিত শুল্ক-কর কমানোর অনুরোধ জানিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি পাঠিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

রাজশাহীর বাজারে গতকাল পর্যন্ত বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১৬৮-১৭২ টাকা এবং খোলা চিনি প্রতি কেজি ১৩০-১৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অন্যদিকে রমজানের পণ্য হিসেবে পরিচিত ছোলার কেজি ১০০-১১০ টাকা ও ছোলার ডাল ১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া ছোট দানার মসুর ১৩০ টাকা, মোটা দানা মসুর ডাল ১১০ টাকা ও মুগ ডাল ১৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গত এক মাসের মধ্যে এসব পণ্যের দাম ১০-২০ টাকা বেড়েছে। অন্যান্য পণ্যের মধ্যে খোলা আটা ৫০-৫৫, প্যাকেট আটা ৬০-৬৬, খোলা ময়দা ৬৫-৭০ এবং প্যাকেট ময়দা ৭০-৮০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।

বাজারের বর্তমান অবস্থায় উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে উচ্চ ‘লোভস্ফীতি’ চলছে বলে মন্তব্য করেছেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। তিনি বলেন, ‘সরবরাহ না থাকলে দাম বাড়ে। কিন্তু বর্তমানে উৎপাদন বৃদ্ধি ও সরবরাহ ঠিক থাকলেও অনেক পণ্যের দাম বাড়ছে। সুতরাং পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির এই অস্বাভাবিক কারণ আগে থামাতে হবে। তা না হলে পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়া, বাজারে অভিযান চালানো কিংবা ট্রাকে পণ্য বিক্রি করে পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হবে না।


প্রজন্মনিউজ২৪/এফএইচ

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ