প্রশাসক আর প্রশাসক, নেই কোনো গবেষক

প্রকাশিত: ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০১:৩৪:৪৬ || পরিবর্তিত: ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০১:৩৪:৪৬

প্রশাসক আর প্রশাসক, নেই কোনো গবেষক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম পরিচিতি হল তার শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে উঠে আসা হাজার হাজার প্রশাসক। বেশ কয়েক বছর ধরেই বিসিএস পরীক্ষার দিকে ঝুঁকছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। নেটিজেনরা মজা করে বলেন বিসিএস ভার্সিটি অনেকে তো এটাও বলেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিকলেই বিসিএস চাকুরী কনফার্ম। অথচ একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমনটা হওয়ার কথা ছিল কিনা তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ আসলে কি গবেষক তৈরি করা নাকি দক্ষ প্রশাসক তৈরি করা? চলুন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজি। 

আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মানদণ্ড, - 
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সংজ্ঞায় বলছে, বিশ্ববিদ্যালয় বলতে এমন এক শিক্ষায়তনকে বোঝায়, যেখানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বিজ্ঞান এবং ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন ইত্যাদি মনের উদারতা বৃদ্ধিকারী জ্ঞানশিক্ষা দেয়া হয়। এছাড়া উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—ডাক্তার, প্রকৌশলী, উকিল-মোক্তার, হিসাবরক্ষক ইত্যাদি পেশায়ও ছাত্রছাত্রীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। 

সর্বোচ্চ এসব বিদ্যাপীঠ আরেকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় উপযুক্ত ছাত্রছাত্রীদের স্নাতক থেকে পিএইচডি সমমানের সনদ দেয়াও। 

আরেকটি ধারণা পাওয়া গেছে, যার ওপরও ভিত্তি করে তৈরি হতে পারে একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মানদণ্ড । এটি এসেছে খ্রিস্টান ধর্মযাজক ও বিখ্যাত ব্রিটিশ ধর্মতাত্ত্বিক কার্ডিন্যাল জন হেনরি নিউম্যানের (১৮০১-১৮৯০) মাথা থেকে। তার মূলকথা হলো, বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটি পরিবেশ, যেখানে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে নরনারী এক জায়গায় এসে জড়ো হবেন, এক জায়গায় থাকবেন, তাদের মধ্যে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির ভাবের দেয়া-নেয়া হবে। এখানে মনের সঙ্গে মনের দ্বন্দ্বে, জ্ঞানের সঙ্গে জ্ঞানের সংঘর্ষে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি হবে, পুরনো জ্ঞানের চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে, হবে পরিমার্জন-পরিবর্ধন ও পরিবর্তন।

এই মানদণ্ডের বিচারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান আসলে কোথায় তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই, এখানে না আছে গবেষণার সুযোগ, না আছে কোন সুযোগ সুবিধা। শিক্ষার অবাধ স্বাধীনতাও নেই, কোন বিদেশী শিক্ষার্থীও নেই। মোদ্দা কথা হল সংজ্ঞা অনুসারে কিংবা মানদন্ডের বিচারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আসলে একটি খোলস ব্যতীত আর কিছুই নয়। যার ভেতরটা অন্তঃসারশূন্য। এক কথায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আসলে বিশ্ববিদ্যালয় কাতারেই পড়ে না। যদিও এখনো পর্যন্ত এটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। 

কেন এমন হলো?  

প্রথমেই দায়ী করতে হবে গবেষণায় বরাদ্দহীনতাকে, যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১০৩ বছর পর প্রথম তার গবেষণার জন্য নিজস্ব ফান্ড তৈরি করেছে। অদূর ভবিষ্যতে গবেষণায় উন্নতি করবে এনিয়ে আপাতত আশাবাদী হওয়া  গেলেও  বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা পদ্ধতি গবেষণাধর্মী নয় এমনটাই বলতে হচ্ছে। 

শিক্ষা পদ্ধতির বেহাল দশা, একাধিক শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানা গিয়েছে তাদের ক্লাসে কি পড়ানো হয় তা তারা বোঝেই না , অনেক শিক্ষার্থী বিশেষত কলা অনুষদের বিভাগগুলোতেই প্রবণতা প্রবল। কেবল নোট শিট কিংবা ক্লাসের লেকচারের হুবহু কপি তুলে দিতে পারলেই মিলছে নাম্বার, পাওয়া যাচ্ছে ফার্স্ট ক্লাস। 

ফলে একেবারে শুরুতেই গবেষণা হীন একটা শিক্ষা পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এরপরেও হাতে গোনা যে দু চারজন চান যে গবেষণা করবেন তারা ফান্ডিং এর অভাবে গবেষণাকর্মে  ক্ষ্যামা দেন। 

একেবারে অদম্য গবেষণায় আগ্রহী শিক্ষার্থীরা কেউ কেউ শেষতক গবেষণায় ব্রতী হন। সেখানেও নানারকম ভোগান্তিতে  পড়তে হয় শিক্ষার্থীদের। যেখানে গবেষণা কর্মের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সবকিছু করে দেওয়ার কথা সেখানে উল্টো শিক্ষার্থীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। 

ফলশ্রুতিতে সব শেষ ঝুঁকতে হচ্ছে নিশ্চিত নিরাপদ তথাকথিত আয়ের উৎস সরকারি চাকরিতে।  অমানুষিক পরিশ্রম করে দিতে হচ্ছে বিসিএস। যে শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ে পদচারনা হয়েছিল নতুন জ্ঞান সৃষ্টির লক্ষ্যে,সে শিক্ষার্থী এখন প্রবল দেশপ্রেমের তাগিদে সরকারি চাকরিতে ঝুঁকছে। এভাবেই প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে গবেষণার দ্বার, ভুরি ভুরি প্রশাসক তৈরি হচ্ছে, কিন্তু নেই কোন গবেষক। এখানেই একটি বিশ্ববিদ্যালয়  হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্থকতা মুখ থুবড়ে পড়ছে। 

গবেষণার পরিবেশের অভাব মুখ্য কারণ, এছাড়াও রয়েছে অসংখ্য গৌণ কারণ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, আবাসন সংকট, নিন্নমানের শিক্ষা, পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবসহ আনুষঙ্গিক আরো অনেক কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গবেষণায় পিছিয়ে পড়ছে। পৃথিবীর প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ধারে কাছে যেতে পারছে না,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তৈরি হচ্ছেনা নতুন জ্ঞান অথচ এ কারণেই একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। 

নৈতিক মানদন্ড হীনতা 

বলা হয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হলো নতুন নতুন নৈতিক মানদন্ড সৃষ্টি করা, ভালো খারাপের নতুন নতুন সংজ্ঞা সৃষ্টি করা কিংবা যুগোপযোগী ভালো মন্দের মানদন্ড নিরূপণ করা। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কে একটি নতুন মানদণ্ড দিয়েছে। তা হলো বিসিএস ক্যাডার হওয়া। এবং আশ্চর্যজনকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তা নিয়ে প্রচণ্ড রকম গর্ববোধও করে। 

একে তো বিশ্ববিদ্যালয়টি নৈতিক কোন মানদন্ড তৈরি করতে পারছে না,

সামাজিকতার খাতিরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেটুকু নৈতিকতা  রয়েছে  শিক্ষার্থীরা প্রশাসনে গিয়ে সেটুকুও হারিয়ে ফেলছে। 

এক বেসরকারি বার্তা সংস্থার প্রতিবেদনে দেখা যায়,সরকার প্রদত্ত বেতনে সরকারি কর্মকর্তাদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরও বাড়ি গাড়ি করতে হলে, কমপক্ষে  ১০০ বছরেরও বেশি সময় প্রয়োজন। অথচ চাকরির কয়েক বছরের মধ্যেই বিশাল সম্পত্তির মালিক বনে যান প্রশাসকেরা। 

অর্থাৎ এই অর্থে ধরতে গেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গঠনমূলক একটি ফলাফল দেওয়ার বদলে ধ্বংসাত্মক কাজ করছে পরোক্ষভাবে। গবেষণায় বরাদ্দ না দিয়ে শিক্ষার্থীদের কে সরকারি চাকরির দিকে ঠেলে দিয়ে নৈতিক অধঃপতনে বাধ্য করে একটি দুর্নীতিপরায়ণ রাষ্ট্র গঠনে সহায়তা করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ভাবনা- 

আশরাফুল ইসলাম নামে ২২-২৩ সেশনে অধ্যায়নরত আইন বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় জানতে চাওয়া হয় সমস্যার কারণ কি এ থেকে উত্তরণের উপায় কি, তিনি বলেন - 

"এর পিছনে কারণ হলো একটাই অদক্ষ নেতৃত্ব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ সময় যাবত একটি অদক্ষ নেতৃত্ব একটি অদক্ষ প্রশাসনের কাঠামোর ভেতর পরিচালিত হয়েছে ফলে দীর্ঘদিন নেতৃত্বের অভাবে একটু একটু করে গবেষণা বা মূল চেতনা থেকে হারিয়ে গিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পিজে হার্টগ,আর সি মজুমদার কিংবা স্যারের এ এফ রহমানের মতো উপাচার্যরা থাকাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের মান অনন্য উচ্চতা ছিল, প্রকৃতপক্ষে তা ছিল প্রাচ্যের অক্সফোর্ড, এটা হাল আমলের নেতৃত্বের এমন বেহাল দশা যে, একটি বিশ্ববিদ্যালয় কে তা আরো নির্মতের পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। 

দ্বিতীয় যে সমস্যা সেটি আমি মনে করি প্রচারের অভাবের কারণে দেখুন আমাদের বিভাগে কিন্তু অনেক ভালো ভালো গবেষণা হচ্ছে, এত স্বল্পতা এত ফান্ডিং এর অভাবের পরেও অদম্য কিছু মেধাবীরা কিন্তু গবেষণায় আসছেন সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়। অথচ তাদের গবেষণাগুলোর কোন প্রচার নেই, ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীরাও আর ভাবছে না যে গবেষণা একটিভ ভালো ক্যারিয়ার ফিল্ড হতে পারে। আর বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে অর্থ উপার্জন একটি বড় ইসু

যদি গবেষণায় কেউরত হয়   তাহলে তার সংসার চালানো বেশ কঠিন হয়ে যাবে বিদেশে এর জন্য আর্থিক সহায়তা দেয়া হলেও বাংলাদেশের তা একেবারে আকাশ কুসুম কল্পনা তাই কেউই যাচ্ছে না গবেষণার এই ফিল্ডে। বেছে নিচ্ছে বিসিএস বিজেএস হচ্ছে প্রশাসক কিংবা আমলা।" 

শরফুদ্দীন সাকিব নামে প্রিন্টিং এন্ড পাবলিকেশন ডিপার্টমেন্টের আরেক শিক্ষার্থী জানান, 

"বাঙালির তেমন কোন লেগাসী নাই, যার কারণে আউট অফ বক্স চিন্তা করতে পারে না। অতি নৃতাত্ত্বিক কারণেই বাঙালি রিস্ক নিতে চায় না। আবহমান কাল ধরে বাঙালি একটি আলস্য প্রিয় জাতি, তাই সরকারি চাকরি বাঙালির প্রথম পছন্দ হওয়াটা অতি স্বাভাবিক। 

তাছাড়া এই এই বাংলা রিজিয়নে ১৯৪৭ এর পরে যে সমস্ত শাসকেরা এসেছেন তারা কখনোই জনবান্ধব কোন শাসক ছিলেন না সব সময় ভয়ের একটি রাজনীতি একটি সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার কাজ করেছেন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শাসক। যার কারণেও বাঙালির এই ভয় ভীতি। 

আরেকটি কারণ এমন হতে পারে যে শাসকগোষ্ঠী মানুষকে মূলা ঝুলিয়ে আসল জায়গা থেকে দূরে রাখার একটা চেষ্টা করছে, সরকারি চাকরির অতিরিক্ত গ্লোরিফিকেশনের কারনে মানুষ যদি বলতেছি আর লেখা উঠতেছে সরকারি চাকরিকে ধ্যান জ্ঞান মনে করে,তাহলে শাসক গোষ্ঠীর পক্ষে তাদের দুঃশাসন চালিয়ে যাওয়াটা আরো বেশি সহজ হয়ে পড়ে এ কারণে বিসিএস এর এত ভেরিফিকেশন যা সাধারণ মানুষের জন্য প্রকৃতপক্ষে একটি স্ক্যাম হয়ে দাঁড়ায় ।" 

ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জনাব শহিদুল হাসান এ প্রসঙ্গে বলেন, - 

"সরকারি চাকুরী আসলে আমাদের এই দেশে অনেক আগে থেকেই জনপ্রিয়।বেতন ভাতা সুযোগ সুবিধা ইত্যাদি কারণে সরকারি চাকরির বেশ কদর রয়েছে বাঙালির মাঝে। তবে হাল আমলে সরকারি চাকরি পেতে হলে  বেশ প্রতিযোগিতামূলক একটি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সেখানে কখনো কখনো ৪,৩,২ এমনকি মাত্র  ১ শতাংশ শিক্ষার্থী কৃতকার্য হতে পারে। তো এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় গুলো নতুন করে ভাবছে বিশ্ববিদ্যালয়ের চার বছরের গ্রাজুয়েশন এর মধ্যেই  কিভাবে ছাত্রদেরকে চাকরি উপযোগী করা যায়  তা নিয়ে চলছে গবেষণা। আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে

একই সাথে নতুন জ্ঞান এবং দক্ষ প্রশাসক তৈরি করবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।" 

শেষ কথা 

আশা করা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একদিন একটি আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় পরিগণিত হবে যেখানে একগুঁয়ে প্রশাসক নয় গবেষক এবং নতুন জ্ঞান সৃষ্টির কর্মযজ্ঞ চলবে। একটি পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীকে আলোর মুখ দেখাতে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একদিন গবেষণায় সারা বিশ্বের রোল মডেল হবে এই প্রত্যাশা। 

লেখক - আসাদুজ্জামান 
ইতিহাস বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


প্রজন্মনিউজ২৪/এসআই
 

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ