জাকসু নির্বাচনের ঘোষিত রোডম্যাপ নিয়ে যা বলছে ছাত্রসংগঠনগুলো

প্রকাশিত: ১৪ জানুয়ারী, ২০২৫ ০১:০৫:০৭

জাকসু নির্বাচনের ঘোষিত রোডম্যাপ নিয়ে যা বলছে ছাত্রসংগঠনগুলো

প্রজন্মডেস্ক : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) ও হল ছাত্র সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার পর ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে নির্বাচনের সময় নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলন, ইসলামী ছাত্রশিবির, ছাত্র ইউনিয়ন (একাংশ), ছাত্র অধিকার পরিষদসহ কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা রোডম্যাপ অনুযায়ী যথাসময়ে নির্বাচন চান। তবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন (একাংশ), ছাত্র ফ্রন্টসহ (মার্ক্সবাদী) কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গঠনতন্ত্রসহ বেশ কিছু বিষয়ে সংস্কার এনে তারপর নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানাচ্ছে।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই জাকসুর দাবি জোরালো হয়। অভ্যুত্থানের পর জাকসুর দাবিতে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল, অনশনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৩০ ডিসেম্বর জাকসুর রোডম্যাপ ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ জাকসু নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯২ সালে। সে হিসাবে দীর্ঘ ৩৩ বছর পর অচল জাকসু সচল হতে চলেছে।

জাকসু নির্বাচন উপলক্ষে ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশনের পক্ষ থেকে খসড়া ভোটার তালিকাও প্রস্তুত করা হয়েছে। জাকসু নির্বাচনের ব্যাপারে পরামর্শ নিতে সোমবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়ে যাবে আগামী ১ ফেব্রুয়ারি।

ভোটার নিয়ে সমালোচনা
১১ জানুয়ারি জাকসুর খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। ওই দিন বিজ্ঞপ্তিতে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে যেসব শিক্ষার্থী স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ৬ (৪ +২) বছর অথবা স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ২ (১ +১) বছর অধ্যয়নরত আছেন, শুধু তাঁদের নাম জাকসুর ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

জাকসুর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীই জাকসুর সদস্য হতে পারেন। তবে সম্প্রতি উপাচার্য মো. কামরুল আহসান গঠনতন্ত্রের ১৯ ধারাবলে, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ছাড়া বাকিদের সদস্য হওয়ার বিষয়টি বাতিল করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ছাড়াও এমফিল, পিএইচডি ও উইকেন্ড কোর্সের শিক্ষার্থী আছেন। এর বাইরে স্নাতক-স্নাতকোত্তরে অনিয়মিত শিক্ষার্থী আছেন। তাঁদেরও ভোটার তালিকায় রাখা হয়নি। যদিও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নির্ধারিত চাঁদা দিয়ে তাঁরা সদস্য হতে পারতেন।

জাকসুর গঠনতন্ত্রের ১ ধারায় বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের সদস্য ও যাঁদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রত্যক্ষভাবে শিক্ষাদান করে থাকে, সেসব ছাত্রই জাকসুর সদস্য হবেন। অন্যদিকে, ১৯ ধারায় বলা হয়েছে, এই গঠনতন্ত্রে অনুল্লেখিত এমন কোনো বিষয়ের সম্মুখীন হলে, সে বিষয়ে সভাপতি (উপাচার্য) সিদ্ধান্ত নেবেন এবং তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।

জাকসুর নির্বাচন কমিশনের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এমফিল, পিএইচডি ও উইকেন্ডের শিক্ষার্থীদের হলে সংযুক্ত করা হলেও তাঁরা আবাসিক হলে থাকতে পারেন না। কিন্তু তাঁরা প্রত্যক্ষভাবে ক্লাস করেন, আবার হলের চাঁদাও দেন। এ বিষয়ে গঠনতন্ত্রে অস্পষ্টতা থাকায় উপাচার্য তাঁদের ভোটার তালিকায় রাখেননি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও নির্বাচন কমিশনের সদস্যসচিব রাশিদুল আলম বলেন, শুধু স্নাতক এবং স্নাতকোত্তরের নিয়মিত শিক্ষার্থীরাই নির্বাচনের বৈধ ভোটার। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যেসব বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে সেসব বিষয়ে উপাচার্য ক্ষমতাবলে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন চায় ছাত্রদল ও বামপন্থীদের একাংশ
ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা বলছেন, তাঁরাও জাকসু নির্বাচন চান। তবে নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের যাঁরা প্রশাসনের দায়িত্বে আছেন, তাঁদের অপসারণ করতে হবে। একই সঙ্গে জুলাই আন্দোলনে হামলাকারীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের আমলে ছাত্রদলের যাঁরা নির্যাতিত হয়ে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি, তাঁদের ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দিতে হবে। এসব বিষয়ে বেশ কিছু প্রস্তাবনা তাঁরা আগামী বৃহস্পতিবার উপাচার্য বরাবর দেবেন। বিষয়গুলো সংস্কার করেই তারপর নির্বাচন চায় ছাত্রদল।

এ বিষয়ে ছাত্রদলের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক জহির উদ্দিন বাবর বলেন, ছাত্রদল সব সময় ছাত্র সংসদ কার্যকর রাখার পক্ষে। সব ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে প্রশাসন জাকসু নির্বাচনের বিষয়ে একটি সাধারণ সভা করেছিল। ওই সভায় নির্বাচনের আগে অনেকগুলো সংস্কারের দাবি আসে। সেসব বিষয়ে সংস্কার করে নির্বাচনী তফসিল দিতে হবে। ছাত্রশিবিরকে নির্বাচনে চান না জানিয়ে ছাত্রদল আহ্বায়ক বলেন, ‘ক্যাম্পাসে ২২টি সংগঠন ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। ওই তালিকায় জাকসুও ছিল। যেহেতু গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, জাকসুর সিদ্ধান্ত জাকসুকেই (নির্বাচিতরা) নিতে হয়। তাই এই নির্বাচনে শিবির অংশগ্রহণ করুক, আমরা চাই না। জাকসু নির্বাচন হলে নির্বাচিত সদস্যরা শিবিরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। তার আগে শিবিরের উপস্থিতি চাই না।’

ছাত্রশিবিরের উপস্থিতি নিয়ে হট্টগোল,  জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মতবিনিময় সভা স্থগিত
একই কথা বলছেন বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা। তাঁরা বলছেন, জাকসুর যে গঠনতন্ত্র আছে, তার বেশ কিছু বিষয় সংস্কার করা জরুরি। সেসব বিষয় সংস্কার করে তারপর নির্বাচন দেওয়া হোক। বিশেষ করে পদাধিকারবলে উপাচার্যের জাকসুর সভাপতি হওয়ার যে নিয়ম, সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা। এ ছাড়া ছাত্রশিবিরের অংশগ্রহণের বিষয়টি নিয়েও তাঁদের আপত্তি আছে।

ছাত্র ইউনিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের (একাংশের) সভাপতি অমর্ত্য রায় বলেন, ‘আমরা জাকসুর তফসিল ঘোষণার আগে শেখ হাসিনার একজন বিশ্বস্ত ভ্যানগার্ড প্রোভিসি সোহেল আহমেদের অপসারণ চাই। জাকসুর গঠনতান্ত্রিক কিছু জটিলতা বিদ্যমান, যেহেতু জাকসুর গঠনতন্ত্রের বয়স পঁয়তাল্লিশ বছরেরও বেশি। সেই গঠনতন্ত্র এই বাস্তবতায় অনেকটুকুই অপ্রাসঙ্গিক। গঠনতন্ত্রের সংস্কার করে দ্রুতই জাকসুর তফসিল ঘোষণা করা হবে বলে আশা রাখছি আমরা।’

আগে জাকসু, পরে সংস্কার চায় বৈষম্যবিরোধী, শিবির, অধিকার পরিষদ
রোডম্যাপ অনুযায়ী নির্বাচন চায় বেশ কয়েকটি সংগঠন। ছাত্র সংসদ বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারেরই অংশ, জাকসু হলে সংস্কারের পথ আরও সহজ হবে বলে মনে করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জাবি শাখার সদস্যসচিব তৌহিদ সিয়াম। তিনি বলেন, ‘প্রশাসন জাকসু নিয়ে যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা সাধুবাদ জানাই। জাকসু আমাদের যৌক্তিক দাবি। জাকসু নির্বাচনকে কেউ বানচাল করতে চাইলে ছাত্র-জনতা তা রুখে দেবে। রূপরেখা অনুযায়ী সব দল-মত নির্বিশেষে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। যাতে ছাত্র প্রতিনিধিরা শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে কাজ করতে পারেন।’

ছাত্রশিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মহিবুর রহমান বলেন, গত তিন দশক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয়নি। জাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে আমেজ তৈরি হয়েছে, তা যথাসময়ে বাস্তবায়ন করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়কে পথ দেখাবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি। কোনো টালবাহানায় যেন জাকসু নির্বাচনকে পিছিয়ে না দেওয়া হয়, সে ব্যাপারে প্রশাসনের সর্বোচ্চ আন্তরিকতা কামনা করেন তিনি।

নির্বাচন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে জাকসুর একটা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। জুলাই বিপ্লবের পরের যে প্রেক্ষাপট, সবকিছু মিলিয়ে আমি মনে করি এটি অত্যন্ত জটিল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর অনেকগুলো আইনগত দিক এবং কতগুলো জটিলতা থাকবে। সেটা সংশ্লিষ্টরা মিলে কীভাবে দূর করবে, সেটা চ্যালেঞ্জ বলে আমি মনে করি।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, ভোটার হওয়ার ক্ষেত্রে এমফিল, পিএইচডি ও উইকেন্ড কোর্সের শিক্ষার্থীরা ভোট দিতে পারবেন কি না, বিষয়টি নিয়ে অস্পষ্টতা আছে। গঠনতন্ত্রের ১৯ ধারাবলে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে এই সুযোগটাও রাখা হয়েছে যদি কারও সদস্যসংক্রান্ত কোনো জিজ্ঞাসা থাকে, তাহলে ১৪ তারিখের মধ্যে আবেদন করতে বলা হয়েছে। তাঁদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং গঠনতন্ত্রের স্পিরিটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হলে, সে ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হবে।

প্রজন্ম নিউজ২৪/টিপু

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ