মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতে নতুন স্ফুলিঙ্গ

প্রকাশিত: ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১১:০৪:২৬

মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতে নতুন স্ফুলিঙ্গ

প্রজন্ম ডেক্স: লেবাননের শক্তিশালী সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর দীর্ঘকালের নেতা হাসান নাসরাল্লাহর হত্যাকাণ্ড মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাতে নতুন স্ফুলিঙ্গ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এ সংঘাতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য দেশটির প্রধান শত্রু ইরানের ওপর চাপ বাড়ছে। 

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ফিলিস্তিনের হামাস, লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনে হুতিরা বহুদিন ধরেই ইরানের সম্মুখযোদ্ধা। তবে ইরানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সম্পদ হিজবুল্লাহকে যথেষ্ট দুর্বল করে দেওয়া হলে পাল্টা পদক্ষেপ নিতে ইরান বাধ্য হতে পারে। 

অবশ্য হামলার তীব্র নিন্দা করলেও ইরানের নেতারা প্রতিশোধের জন্য সরাসরি কোনো পদক্ষেপ নেননি বা হুমকি দেননি। তেহরানে গত মাসে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াকে হত্যারও বদলা নেয়নি ইরান। এই নিষ্ক্রিয়তায় কিছু বিশ্লেষক এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, ইরানিরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি সংঘর্ষের ঝুঁকি নিতে চায় না। তবে নাসরাল্লাহকে হত্যা ইসরায়েল এবং হিজবুল্লাহর মধ্যে যুদ্ধবিরতি আলোচনার ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, নাসরাল্লাহর মৃত্যু ইরানি ছায়াশক্তির জন্য একটি আঘাত। তবে এ ঘটনা হিজবুল্লাহকে পঙ্গু করবে, নাকি প্রতিশোধের আরেকটি চক্রে ইন্ধন দেবে, তা এখনই বলা মুশকিল। 

গতকাল রোববার নিউইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণে বলা হয়, মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাপ্রবাহকে প্রভাবিত করার যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে এবং অন্যান্য প্রধান শক্তি মূলত দর্শকের ভূমিকায় রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় এক বছর ধরে চলা যুদ্ধ থামাতে ব্যর্থ হয়েছে শক্তিধর দেশগুলো। গাজায় যুদ্ধ শেষ করার জন্য ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে আলোচনা চালিয়ে যেতে যুক্তরাষ্ট্র ধাক্কা খেয়েছে। বাইডেন প্রশাসন বারবার চুক্তির দ্বারপ্রান্তে বলে বর্ণনা করলেও আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। লেবাননে পূর্ণ মাত্রায় ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধ এড়াতে পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন বর্তমান প্রচেষ্টা বিপর্যয় এড়াতে পারেনি। শুক্রবার হিজবুল্লাহর দীর্ঘদিনের নেতা নাসরাল্লাহকে ইসরায়েল হত্যার পর শান্তি আলোচনায় সাফল্যের সম্ভাবনা ব্যাপকভাবে অনিশ্চিত বলে মনে হচ্ছে। রক্তপাত ছড়িয়ে পড়ায় যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত বিশ্বের অন্য শক্তিগুলো মূলত নীরব দর্শক হিসেবে রয়েছে। ইরানের তেলের প্রধান আমদানিকারক চীন মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্ব ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিতে চাইলেও শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালনে তেমন আগ্রহী নয়।

আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে কেউই ফিলিস্তিনিদের সামরিকভাবে মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী বা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নয়। ইরানও সতর্ক। কারণ, তারা জানে ইসরায়েলের সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধ ইসলামী প্রজাতন্ত্রের অবসান ঘটাতে পারে। মিসর ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের ঢল নামার আশঙ্কা করছে। সৌদি আরব স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র চায়। তবে এ কারণে সৌদিদের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলবে না। ইরান ৪০ বছর ধরে হিজবুল্লাহকে তার মিলিশিয়াদের প্রক্সি নেটওয়ার্কের প্রধান হাত হিসেবে লালন-পালন করেছে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অগ্রসর প্রতিরক্ষা হিসেবে। তবে গত দুই সপ্তাহে হিজবুল্লাহর নেতৃত্ব অস্ত্রাগার এবং যোগাযোগের ওপর ইসরায়েলি আক্রমণে তা ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। ফলে নাসরাল্লাহ হত্যাকাণ্ডের জবাব কীভাবে দেওয়া যায়, তা নিয়ে ইরান সরকারের মধ্যে ফাটল দেখা দিয়েছে।

রক্ষণশীলরা কড়া জবাব চায়। তবে ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের নেতৃত্বে মধ্যপন্থিরা সংযমের আহ্বান জানিয়েছেন। এসবই ইরান এবং তার সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে দুর্বল অবস্থানে ফেলেছে। নাসরাল্লাহকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন এবং ঘটনা সম্পর্কে অবহিত চারজন ইরানি কর্মকর্তা বলেছেন, খামেনি তাঁর বন্ধু নাসরাল্লাহর মৃত্যুতে গভীরভাবে ভেঙে পড়েছেন; কিন্তু তিনি শান্ত এবং বাস্তববাদী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। ইসরায়েলের ওপর আঘাত করার হুমকির পরিবর্তে তিনি দুটি সংযত বিবৃতি জারি করে নাসরাল্লাহকে মুসলিম বিশ্বের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব এবং প্রতিরোধের অক্ষ হিসেবে তাঁর প্রশংসা করেন। খামেনি বলেন, ইরান হিজবুল্লাহর পাশে থাকবে।

লেবাননে ইসরায়েলের হামলায় নাসরাল্লাহর পাশাপাশি ইরানের আইআরজিসির কুদস ফোর্স শাখার একজন শীর্ষ কমান্ডারও নিহত হয়েছেন। এ হত্যাকাণ্ডের‘জবাব না দিয়ে ছাড়া হবে না’বলে গতকাল হুঁশিয়ারি দিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগছি। তবে বিবিসির বিশ্লেষণে বলা হয়, নাসরাল্লাহর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য আরও বেশি ধ্বংসাত্মক সংঘাতের দিকে যেতে পারে। এ সংঘাতে জড়াতে পারে  ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক নিরাপত্তা বিশ্লেষক মোহাম্মদ আল-বাশা বলেন,  নাসরাল্লাহর নিহতের ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। এটা হিজবুল্লাহকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। এর ফলে হিজবুল্লাহর রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলে স্বল্প মেয়াদে পরিবর্তন আসতে পারে। তবে কট্টর ইসরায়েলবিরোধী এ সংগঠন হঠাৎই হাল ছেড়ে দেবে– আপাতত এমন কোনো আশা করা হয়তো ভুল হবে। হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকে এরই মধ্যে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছে। এখনও সশস্ত্র সংগঠনটির হাজারো যোদ্ধা রয়েছেন। তাদের অনেকেরই সিরিয়ায় যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তারা প্রতিশোধের অঙ্গীকার করেছেন। 

হিজবুল্লাহর অস্ত্রাগারও বেশ সমৃদ্ধ। দূরপাল্লার ও নির্ভুল নির্দেশিত ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে সংগঠনটির বহরে। এসব ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলের তেল আবিব ও অন্যান্য শহরে হামলা চালানো সম্ভব। তাই নিজেদের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে হিজবুল্লাহ এসব অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। হিজবুল্লাহ সত্যিই এসব অস্ত্র ব্যবহার করে ইসরায়েলের শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে ও বেসামরিক মানুষকে হত্যা করতে পারলে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়াও মারাত্মক হবে। পাল্টা হামলায় লেবাননে ব্যাপক অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি ঘটাবে ইসরায়েল। সেই লড়াই ইরান অবধি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও রয়েছে।

‘প্রতিরোধ অক্ষ’নামে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সশস্ত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে ইরানের বেশ সখ্য রয়েছে। ফিলিস্তিনের হামাস, লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি থেকে শুরু করে ইরাক-সিরিয়ায় এমন অসংখ্য গোষ্ঠী ইরানের মিত্র। বর্তমান পরিস্থিতিতে তেহরানের পক্ষ থেকে এসব সশস্ত্র সংগঠনকে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হামলা জোরদার করতে বলা হতে পারে। ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যেই ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলেছে, তারা রোববার ইয়েমেনে হুতি লক্ষ্যবস্তুতে একের পর এক বিমান হামলা শুরু করেছে। গাজা ও লেবাননে ইসরায়েলি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে এ ঘটনা একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাতের আশঙ্কা আরও বাড়িয়েছে বলে জানায় আলজাজিরা।

রোববার বিবৃতিতে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলেছে, ইয়েমেনের রাস ইসা ও হোদেইদাহ বন্দরের বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং সমুদ্রবন্দর স্থাপনাগুলোতে কয়েক ডজন বিমান হামলা চালানো হয়েছে। হামলায় অন্তত চারজন নিহত হয়েছে বলে হুতি-ঘনিষ্ঠ আল মাসিরাহ টিভি জানায়। ইসরায়েলের তেল আবিবের কাছে বেন গুরিয়ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হুতিদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরদিনই পশ্চিম ইয়েমেনে হামলা চালাল ইহুদিবাদী দেশটি। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী মনে করছে, হিজবুল্লাহ এখন দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার হুমকি দূর না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে দেশটি অবস্থান নিতে পারে। এরই মধ্যে সীমান্তঘেঁষা এলাকায় ইসরায়েলি বাহিনীর সম্ভাব্য স্থল অভিযানের প্রস্তুতির ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে দেশটির প্রতিরক্ষা বাহিনী।

তবে ইসরায়েলের সঙ্গে সর্বশেষ যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৮ বছর ধরে হিজবুল্লাহ নিজেদের যোদ্ধাদের পরবর্তী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছে, প্রশিক্ষণ দিয়েছে। নিহত হওয়ার আগেও সর্বশেষ প্রকাশ্য বক্তৃতায় হাসান নাসরাল্লাহ তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে লেবাননের দক্ষিণ সীমান্তে সম্ভাব্য ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিষয়ে কথা বলেছিলেন। হিজবুল্লাহপ্রধান এটাকে সংগঠনের জন্য‘ঐতিহাসিক সুযোগ’হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। এ পরিস্থিতিতে ইসরায়েলি বাহিনীর লেবাননের ভূখণ্ডে প্রবেশ করা তুলনামূলক সহজ হলেও ফিলিস্তিনের গাজার মতোই সেখান থেকে বের হয়ে আসা সময়সাপেক্ষ হতে পারে।


প্রজন্মনিউজ২৪/এম বি

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ