৬ বছর যাবৎ ভারতের কারাগারে পাচার হওয়া বাংলাদেশি নারী

প্রকাশিত: ০৯ জুন, ২০২৩ ১২:৩০:৫৫

৬ বছর যাবৎ ভারতের কারাগারে পাচার হওয়া বাংলাদেশি নারী

নিজস্ব প্রতিবেদক: গর্ভবতী হওয়ার চার মাসের মাথায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান স্বামী। সন্তান পেটে নিয়ে অকূলপাথারে পড়ে যান কুড়ি বছর বসয়ী শাহনাজ। সন্তান জন্মের পর চারদিক থেকে অভাব ঘিরে ধরে তাকে। দুই বছর পর সন্তান আলিফকে রেখে বোনের ননদের সঙ্গে কাজের সন্ধানে যান যশোরে। কিন্তু কাজ জোগাড় করে দেওয়া উদ্দেশ্য ছিল না বোনের ননদ গোলাপী বেগমের। কৌশলে তিনি শাহনাজকে পাচার করে দেন ভারতে। শাহনাজের ঠাঁই হয় দিল্লির এক যৌনপল্লিতে। একদিন পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যেতে হয় কারাগারে। সেখানে ছয় বছর দুর্বিষহ জীবন পার করতে হয় তাকে।

অবশেষে যশোর জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ার নামে এক এনজিওর সহায়তায় শাহনাজের সন্ধান বের করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। কারাগার থেকে তার জামিন করানো হয়েছে। এখন তিনি রয়েছেন ভারতের একটি সেফ হোমে। চলতি মাসের মধ্যেই তাকে দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়া চলছে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের মানবপাচার প্রতিরোধ ইউনিটের পুলিশ পরিদর্শক ইমদাদুল কবির জানান, দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর শাহনাজের সন্ধান পাওয়া গেছে। ভারতীয় জেলে তিনি বন্দী ছিলেন। সম্প্রতি তার জামিন হয়েছে। তাকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। আশা করছি এ মাসের মধ্যেই তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

সিআইডি সূত্র জানায়, শাহনাজকে ভারতে পাচারের বিষয়ে ২০১৭ সালের ২ মে আদালতের নির্দেশে দক্ষিণ খান থানায় একটি মামলা হয়েছিল। ওই মামলাটির তদন্তভার থানা থেকে স্থানান্তর করে দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডির মানবপাচার প্রতিরোধ ইউনিটের কাছে। ওই মামলায় জুলেখা ও দুলাল খাঁ নামে দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু শাহনাজের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না।

সিআইডির তদন্ত সূত্র জানায়, শাহনাজকে পাচারের ওই ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত ছিলেন গোলাপী বেগম নামে এক নারী। তিনিই একমাত্র শাহনাজের অবস্থান জানতেন। কিন্তু ঘটনার পর থেকে গোলাপী বেগম নিজেও ভারতে আত্মগোপনে রয়েছেন। এ জন্য শাহনাজকে খুঁজে বের করতে তাদের বেগ পেতে হয়। ২০২১ সালে শাহনাজকে ভারতীয় কারাগারে বন্দী হিসেবে খুঁজে পায় সিআইডি। ওই বছরের ২৫ মার্চ পুলিশ সদর দফতরের ন্যাশনাল কমিউনিকেশন ব্যুরো এনসিবির কাছে শাহনাজকে উদ্ধারের জন্য চিঠিও দেয়। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে শাহনাজকে ফেরানো যায়নি।

সিআইডির তদন্ত সূত্র জানায়, একপর্যায়ে তারা শাহনাজকে ফিরিয়ে আনতে যশোর জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ার নামে একটি এনজিওর সহায়তা নেয়। সংগঠনটি দীর্ঘদিন ধরে ভারতে পাচারের শিকার হওয়া নারীদের ফেরত আনা বিষয়ে কাজ করছিল। সম্প্রতি তারা জানতে পারে শাহনাজ ভারতের উত্তর প্রদেশের একটি জেলে বন্দী অবস্থায় রয়েছেন। পরে ভারতীয় একটি এনজিওর সঙ্গে যোগাযোগ করে শাহনাজকে উদ্ধারের জন্য উচ্চ আদালতে আবেদন করে যশোর জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ার। সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে উত্তর প্রদেশের আদালত তাকে জামিন দেন। এখন তাকে পুলিশের তত্ত্বাবধানে একটি সেফ হোমে রাখা হয়েছে। শিগগির শাহনাজকে দেশে ফেরত আনার প্রক্রিয়া চলছে।

যেভাবে পাচারের শিকার হন শাহনাজ
শাহনাজের স্বজনরা জানান, জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলাধীন কছিশার চরের মৃত মতিনের মেয়ে শাহনাজ। বিয়ের পর তিনি স্বামীর সঙ্গে দক্ষিণখান এলাকায় থাকতেন। তার বোন হোছনে আরা লিজাও থাকেন দক্ষিণখান এলাকায়। বিয়ের কিছুদিন পর চার মাসের সন্তানসম্ভবা শাহনাজের স্বামী মারা যান সড়ক দুর্ঘটনায়। এরপর থেকে বোন লিজা ও মা-বাবার সংসারেই থাকতেন তিনি। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য কাজ খুঁজতে থাকেন তিনি। এর মধ্যেই বড় বোন লিজার ননদ গোলাপী বেগম তাকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেন। প্রথমে সেলাই মেশিন চালানো শেখার পরামর্শ দেন। ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে গোলাপী বেগম শাহনাজকে নিয়ে যশোরে যান। সেখান থেকে কৌশলে তাকে অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে পাচার করে দেন।

স্বজনরা জানান, ভারতে পাচার করার পর গোলাপী বেগম শাহনাজকে ভারতীয় পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দেন। তারা তাকে দিল্লির মনিহারের এক যৌনপল্লিতে নিয়ে যায়। তাকে দিয়ে যৌনকাজ করাতে বাধ্য করা হয়। ওই যৌনপল্লিতে পুলিশি অভিযানে আটক হন শাহনাজ। পরে তার বাংলাদেশি পরিচয় পেয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলা দেয় ভারতীয় পুলিশ। এরপর থেকেই উত্তর প্রদেশের একটি কারাগারে বন্দী ছিলেন তিনি।

শাহনাজের বোন হোছনে আরা লিজা বলেন, পাঁচ বছর ধরে আমরা শাহনাজকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, কিন্তু তার কোনও হদিস পাচ্ছিলাম না। বছরখানেক আগে জানতে পারি সে ভারতের কারাগারে বন্দী। তাকে পাচারের পর ‘পতিতালয়ে’ বিক্রি করা হয়েছিল। তাকে সেখানে নির্যাতনও করা হয়েছে। এখন পুলিশ আর এনজিও কর্মকর্তা জানিয়েছে শিগগির তাকে দেশে ফেরানো হবে। শাহনাজের আট বছরের ছেলে জানতো তার মা মারা গেছে। এখন ছেলেটা তার মাকে দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

অর্ধশতাধিক নারীকে পাচার করেছে গোলাপী
শাহনাজের পাচারের বিষয়টি অনুসন্ধান করতে গিয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ জানতে পারে, শুধু শাহনাজই নন, শাহনাজের মতো আরও অন্তত অর্ধশতাধিক নারীকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার নামে ভারতে পাচার করেছে গোলাপী। পাচারের শিকার নারীদের বেশির ভাগই জামালপুরের বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা।

সিআইডি সূত্র জানায়, গোলাপী দীর্ঘদিন ধরে ভারতে বসবাস করছে। অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দেশে এসে গরিব ও অসহায় নারীদের ভালো আয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে পাচার করে। সেখানে গিয়ে নারীদের সে বিভিন্ন যৌনপল্লিতে বিক্রি করে দেয়। যৌনপল্লিগুলোয় পাচার হওয়া নারীদের নির্যাতন করে যৌনবৃত্তি করতে বাধ্য করা হয়।

গোলাপী নিজে সঞ্জয় নামে ভারতীয় এক ব্যক্তিকে বিয়ে করে ওই দেশের আঁধার কার্ড তথা জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেছে। তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করারও চেষ্টা চলছে বলে জানায় সিআইডি।

প্রজন্মনিউজ২৪/এএইচ

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ