প্রেমে ছিল বড় জ্বালা!

প্রকাশিত: ০৮ জুন, ২০২৩ ১১:৪৩:০৩ || পরিবর্তিত: ০৮ জুন, ২০২৩ ১১:৪৩:০৩

প্রেমে ছিল বড় জ্বালা!

অনলাইন ডেস্ক : সে এক নতুন দেশ, আমার জীবনের এক কঠিন সময়। সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৫০ হাজার সুইডিশ ক্রোনার ব্যাংকে জমা দিতে হবে নইলে ভিসা হবে না। বড় ভাই পিএইচডি করছেন, তাঁর কাছে অত টাকা নেই। গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলছে, শুরু করলাম কাজ। সকাল, সন্ধ্যা এবং রাত—শুধু কাজ আর কাজ। ১৫ মে থেকে ১৫ আগস্ট তিন মাসের কাজের অনুমতি, পুরো সময়টি শুধু কাজ আর কাজ। দিনে মোট সময় ২৪ ঘণ্টা, কাজ করি পুরো সময়। এর মাঝে খাওয়া, ঘুম, গোসল, বিশ্বাস হবে না, হওয়ার দরকারও নেই, তবে এটাই সত্য।

কাজ করি একটি হোটেলে, সকালে নাশতা তৈরি, পরে পরিবেশন করি। এরপর হোটেলের রুম পরিপাটি করা, প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা এবং সপ্তাহে ৭ দিন কাজ। সন্ধ্যায় ম্যাকডোনাল্ড’স কাজ রাত ৮টা থেকে সকাল ৩টা অবধি, এখানেও সপ্তাহে ৭ দিন কাজ। এক মাস কাজ করতেই ট্যাক্স অফিস জানতে পেরেছে। আমার নরমাল কাজের রুটিন ৮ ঘণ্টা এবং সপ্তাহে কাজ ৫ দিন। গ্রীষ্মের কাজে কিছুটা ব্যতিক্রম আছে। কিন্তু সেটা যে এত পরিমাণ, এটা কেউ মেনে নিতে পারছে না। শেষে ৪ জায়গাতে কাজ করি, সব মিলে আমার কাজ সপ্তাহে ২৪ ঘণ্টা এবং ঘণ্টায় যে বেতন, তা মিলে ৩ মাসে ৮০ হাজার সুইডিশ ক্রোনার ইনকাম—একজন ছাত্রের জন্য এটা একটি বিশাল ব্যাপার। পড়ার খরচ, আমার খরচ—সবই নিশ্চিত। চলছে জীবন তার গতিতে। মাঝেমধ্যে বন্ধুবান্ধবীদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্টিতে যাই। তবে নতুন বছর উপলক্ষে পার্টিতে এর আগে কখনো কোথাও যাইনি।


তিন বান্ধবী ধরেছে নতুন বছরের পার্টিতে যেতে হবে। পার্টিতে যেতে কিছু নিয়মকানুন আছে, যেমন বয়স ১৮–এর ওপরে হতে হবে, একা যাওয়া চলবে না, বন্ধুবান্ধব থাকা লাগবে। পার্টিতে ডিনার থাকবে। পরে নাচগান হবে। তার জন্য টিকিট কিনতে হবে। সবকিছুরই ব্যবস্থা করা হয়েছে। শনিবার রাতে বাইরে ডিনার, এরপর নাচগান, জীবনের প্রথম। ডিনার শেষ করলাম, বসে বসে দেখছি, নাচগান চলছে। নিজে এখনো ফ্লোরে নাচ-গানে অংশ নিইনি। কেউ এসে জিজ্ঞেসও করছে না আমি নাচব কি না। নিজে কাউকে জিজ্ঞেস করব তা–ও সম্ভব হচ্ছে না, ইচ্ছে করছে কিন্তু লজ্জার কারণে কিছুই হচ্ছে না। হবে না, এমনটি মানসিকতার কারণে আমি মনের মধ্যে আটকে আছি। জীবনে এসব তো এর আগে করিনি, হঠাৎ কীভাবে সম্ভব? তিন বান্ধবীর সঙ্গে এলাম, ডিনার খেলাম, এরপর তারা ভাগছে নাচে, আছে বেশ মজার সঙ্গে, আমার খবর কে রাখে! হঠাৎ স্লো মিউজিক শুরু হয়ে গেল, ঘড়ির কাঁটায় ১২টা বাজে। জনপ্রিয় সুইডিশ পপ মিউজিক ব্যান্ড, আব্বার বিখ্যাত গান ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ শুরু হয়ে গেছে। বন্ধু তার বান্ধবীকে আর বান্ধবী তার বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে মনের সঙ্গে মন আর বুকের সঙ্গে বুক লাগিয়ে নেচে চলেছে। ডিস্ক টেকের বাতি মৃদু মৃদু জ্বলছে। আমি মনের আনন্দে না তবে, বুকভরা জ্বালা নিয়ে বসে বসে দেখছি। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন এসে হাত ধরেই বলল, আসো নাচি। ধড়ফড় গতিতে উঠে গেলাম। আমার শরীর জড়িয়ে ধরে দিব্যি মেয়েটি গানের ছন্দে সুন্দর করে শিল্পীর সঙ্গে সুরে সুর মিলিয়ে গেয়ে চলছে, ‘ক্লোজ ইয়োর আইস, গিব মি ইউর হ্যান্ড ডার্লিং, ডু ইউ ফিল মাই হার্ট বিটিং, ডু ইউ ফিল দ্য সেম।’ আমি তো দেখছি গানের কথার সঙ্গে শরীরের যে অবস্থা, তাতে সবকিছু মিলে গেছে? এরপরও কিছুই বলার নেই, হৃদয়ে তো কত কিছু বলছে কিন্তু মুখ তো নড়ছে না। আমি তো অসাড় হয়ে গেছি, শরীর তো ঠান্ডা, হওয়ার কথা গরম। মেয়েটি কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পেরেছে। অবাক! সুন্দর করে ইংরেজিতে কথা বলা শুরু করল। ‘ইজ ইট ইয়োর ফার্স্ট টাইম? হোয়ার আর ইউ ফ্রম?’ আমি উত্তর দিতে দিতেই সে বেশ শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। নতুন গান শুরু হয়েছে, ‘হ্যালো ইজ মি ইউ লুকিং ফর’ আমি মনে মনে ভাবছি খাইছে আমারে, না চাইতেই সবকিছু মিলে যাচ্ছে! এত দেখছি মিরাকল কিছু ঘটতে চলছে, ডাকছি আল্লাহকে, ‘হে আল্লাহ! তুমি রহমানুর রাহিম!’ কিছুক্ষণ পর স্লো মিউজিক শেষ হলো, লাইট জ্বলে উঠল, গান থেমে গেল। থামল না আমাদের কথোপকথন।


হ্যাই, আমার নাম জুলিয়া, আমি এই শহরের মেয়ে, তুমি?

আমি বললাম আমার নাম রহমান এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

কী পড়ো, কোথায় থাকো, কত দিন এখানে এসেছ এবং কোথা থেকে এসেছ বলতে বলতে আলতো করে চুমো দিয়ে জুলিয়া চলে গেল। আমার যে কিছু বলার ছিল, তা–ও সে জানল না, শুধু প্রশ্ন করে চলে গেল। যাওয়ার বেলায় শুধু স্মৃতিটাই রেখে গেল ফেলে। এদিকে রাত তিনটা বেজে গেছে, ডরমিটরিতে ফিরতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডরমিটরির দূরত্ব খুব একটা বেশি না, হাঁটতে হাঁটতে রুমে এসে কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে গেলাম। নতুন বছর নতুন চেতনা, নতুন উদ্দীপনা নিয়ে জীবন শুরু করতে হবে। এসেছি বিদেশে শিক্ষা গ্রহণ করতে সেটা ঠিক রেখে বাকি সব। অতএব গত রাতে কী হয়েছিল, সেটার পেছনে সময় দিলে আগামীকাল কী হবে, তা নিয়ে ভাবার সময় হবে না। নতুন বছর কেন যেন ভাবনায় ঢুকল।


উইকেন্ডে যে সময়টুকু (শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে রোববার বিকেল অবধি) এ সময়কে বরং সৃজনশীলভাবে কাজে লাগাতে চেষ্টা করতে হবে।

কী করা যায়! শহরে নতুন একটি ম্যাকডোনাল্ড’স ওপেন করেছে। উইকেন্ডে সারা রাতই খোলা থাকে, ভাবলাম সেখানে গিয়ে নক করি। কথা বললাম ম্যানেজারের সঙ্গে, আমি স্টকহোমে এক সামার ম্যাকডোনাল্ড’স এ কাজ করেছি, অভিজ্ঞতা আছে। সেই সুবাদে সপ্তাহে দুই দিন কাজ হয়ে গেল বিকেল পাঁচটা থেকে ক্লোজিং। যে টাকা পাব তাতে আমার ভালোভাবে চলে যাবে, সামারে গাধার মতো খাটতে হবে না এবং উইকেন্ডে বাইরে যাওয়ার মতো সময় থাকবে না এবং কেউ নাম ঠিকানা জানতে চেয়ে প্রশ্ন করে চলে যাবে না। নিজেকে ছ্যাঁক খাওয়া প্রেমিক হতে হবে না—এসব ভাবনা মনের মধ্যে ক্ষণিকের তরে এসে বিদায় নিয়ে চলে গেল। নিজেকে বেশ শক্ত করে গড়তে শুরু করেছি। পাশের দেশ ওয়েলস থেকে এসেছে এক বন্ধু নাম গ্রাম, থাকে একই ডরমিটরিতে, তার সঙ্গে সব বিষয়ে আলাপ–আলোচনা করি, সেদিনের রাতের ঘটনাটি জেনে সে বলেছিল, ‘ওয়ান্স আ ফরেনার, অলওয়েজ আ ফরেনার।’

গ্রামের কথাটি মনে ধরেছে বেশ। একটু জিদ চেপেছে মনে, ঠিক আছে বিদেশি তার অর্থ এই নয়, যার যা খুশি করবে, নিজের চারপাশে প্রতিবাদের দেয়াল গড়ব যেন ঝড়ঝাপটা এলে ভেঙে না পড়ি। এরপর বাঙালি স্টাইলে প্রেম করলে কোনো লাভ হবে না এবং এই প্রেম দিয়ে কিছু হবেও না। সারা জীবন দেবদাস হয়ে বেঁচে থাকতে চাই না, প্রেমের ধরন পাল্টাতে হবে। আর লজ্জা, সে তো নারীর ব্যক্তিত্ব? সেটা কেন আমার মধ্যে ঘেঁষাঘেঁষি করবে? প্রেমে কেন জ্বালা হবে, বিরহ হবে? ভালোমতো জিদ চেপেছে, তো পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করছি নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস বেড়েছে অনেক, বেশ অল্প দিনের মধ্যে। চাপে এবং হৃদয়ের তাপে নিজেকে শক্ত করতে পারা, এ এক নতুন চ্যালেঞ্জ, যা সত্যিই নতুন দরজা খুলে দিয়েছে বিবেকে। শনিবার রাত, ম্যাকডোনাল্ড’সে কাজ করছি, রাত একটা হবে, একটি মেয়ে বারগার সঙ্গে একটি কোকাকোলার অর্ডার করল। আমি দাম নিয়ে তার খাবার রেডি করে তাকে তুলে দিতেই সে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ধন্যবাদ বলে খাবার নিয়ে পাশের টেবিলে বসে পড়ল। আমি পরের ক্রেতাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। খাবার শেষে মেয়েটি ফিরে এসে বলছে, রহমান, সরি, চিনতে পেরেছ আমি জুলিয়া, নতুন বছরে তোমার সঙ্গে ড্যান্স করেছিলাম। মনে মনে ভাবছি, বিদেশি হতে পারি স্মৃতিশক্তি তোদের চেয়ে খারাপ না। এরপর বাঙালি, ক্ষমা করি তবে ভুলি না, তোরে কেমনে ভুলি!

বললাম, হ্যাঁ, চিনেছি, তা কেমন আছ?
বলল কাল কি তুমি ফ্রি নাকি কালও কাজ?
আমি বললাম, আমি প্রতি উইকেন্ডেই কাজ করি।
জুলিয়া বলল ঘুম থেকে কখন উঠবে?
আমি বললাম কেন?
জুলিয়া বলল, বিকেলে সময় হবে কি? এক কাপ কফি খাওয়ার সময় হবে আমার সঙ্গে? আমার বাড়ি বেশি দূরে নয়, প্লিজ, রাজি হয়ে যাও। সেদিন রাতে আমার হঠাৎ চলে যাওয়াটা ঠিক হয়নি, আমি ক্ষমা চাইছি, প্লিজ, ক্ষমা করে দাও।

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম
আমি বললাম ঠিক আছে, তা ঠিকানা দিয়ে যাও কাল দেখা হবে। বেশ খুশি হয়ে চলে গেল, আবারও যাওয়ার বেলা একটু মধুর হাসির জাল মনের মধ্যে ফেলে চলে গেল। কিছুক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়লাম এবং তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে কাজ শেষে ডরমিটরিতে এসে ঘুমিয়ে গেলাম। মূলত কাজ করি শুক্রবার বিকেল থেকে ক্লোজিং এবং শনিবার সন্ধ্যা থেকে ক্লোজিং। রবিবারের দিনে ঘুম থেকে উঠি দেরি করে পরে সন্ধ্যায় চুপচাপ করিডরের রুমেই সময় কাটে। আজ সময়টি কাটবে জুলিয়ার বাড়িতে।


ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে দোকান থেকে একগুচ্ছ ফুলের তোড়া কিনে ঠিকানা সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। যেতে যেতে পথে শরতের বিকেলে সবুজের মধ্যে নানা রঙের রঙিন পাতার মিশ্রণে নিজেই কিছুক্ষণের মধ্যে কবি হয়ে গেলাম। কবি কবি ভাব নিয়েই জুলিয়ার বাড়িতে ঢুকে দরজায় নক করতেই যিনি দরজা খুললেন, তিনি জুলিয়া নন, তিনি জুলিয়ার মা, মিসেস হিল্লেব্রান্ডট, বাংলাদেশে তিন মাস ছিলেন। লিনলোপিং বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাঁকে ঢাকাতে পাঠানো হয় স্টুডেন্ট রিক্রুটিং অ্যাডভাইজার হিসেবে (১৯৮৫ সালে)। দরজা খুলেই তিনি অবাক! রহমান তুমি কী মনে করে? আমি তো হতভম্ব নিজেই, এরপরও নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললাম, জুলিয়ার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। মিসেস হিল্লেব্রান্ডট তো কিছুটা বিষণ্ন এবং অবাকও বটে মনে হচ্ছে। এরপরও জিজ্ঞেস করলেন, তুমি জুলিয়াকে চেন? বললাম, হ্যাঁ। এর মধ্যে ওপর থেকে জুলিয়া এসে হাজির। জুলিয়া এতক্ষণে আমাদের কিছু কথা শুনেছে, তো সে তার মাকে উল্টো জিজ্ঞেস করল, মা, তুমি রহমানকে চেনো? উত্তরে জুলিয়ার মা বললেন, ‘আমার কাজই তো বিদেশি শিক্ষার্থীদের চেনা-জানা’ বলে একটু মুচকি হেসে দিলেন। জুলিয়া আমাকে নিয়ে তার রুমে চলে গেল, যাওয়ার বেলা তার মাকে বলল, মা আমাদের জন্য কফি রেডি করে ডাক দিয়ো।

জুলিয়া আমাকে তার ঘর দেখাচ্ছে, ছোটবেলার ছবি অ্যালবাম খুলে দেখাচ্ছে, সঙ্গে বর্ণনা করছে কোথায় কখন কী ঘটেছে জীবনে।

কী প্রসঙ্গে আমি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলাম, তা তুমি তোমার মায়ের সঙ্গে কখনো বিদেশে যাওনি?

জুলিয়া উত্তরে বলল, ছোটবেলায় গিয়েছি কিন্তু এখন আর যাই না, গেলে তো বাংলাদেশ দেখা হতো। না গেলেও সমস্যা নেই, পুরো বাংলাদেশ এখন আমার সঙ্গে।

আমি বললাম মানে?

প্রশ্ন করতেই সেই পুরোনো অভ্যাস মুখে মুখ লাগিয়ে ছোট্ট একটি চুমো দিতেই নিচ থেকে জুলিয়ার মা বলে উঠলেন, কফি রেডি। নিচে নেমেই একসঙ্গে কফি পান শেষ করতেই জুলিয়ার বাবা এসে হাজির। জুলিয়ার বাবা লিনসোপিংয়ের বোরি মাস্টার। আমাদের আড্ডা বেশ ভালোই জমতে শুরু করল। সবাই বলছে ডিনার সেরে যেন ডরমিটরিতে যাই। একটি কথা পরিষ্কার করা দরকার। বিদায়বেলায় মুখে মুখ রেখে চুমু দেওয়াটা এ সমাজে সব সময় প্রেমের সিম্বল নয়। এটা এখানকার ট্র্যাডিশন, বিশেষ করে অতি কাছের বা পছন্দের হলে এমনটি হয়ে থাকে। গভীর প্রেম বা আরও কিছু হতে হলে জানাজানি, মেলামেশার গভীরতা আরও গাঢ় হতে হবে, তা না হলে ভুল বোঝার কারণে সম্পর্ক শুরুতেই শেষ হওয়ার আশঙ্কা বেশি। আবার সঠিক সময়ে যদি সিগন্যাল না ধরা যায়, তাতেও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা কঠিন! আমার হয়েছে মরণ, কিছুই বুঝতে পারছি না! সবাই যখন রাজি কী করে আর কাজি, এমনটি স্বপ্ন মনে দোলা দিতে শুরু করেছে। অন্যদিকে মিসেস হিল্লেব্রান্ডট কাজ করে বিদেশি শিক্ষার্থীদের নিয়ে তাদের পরিবার বেশ অভ্যস্ত এ ধরনের বন্ধুসুলভ মেলামেশায়। তবে আমার কথা হলো যে মেয়ের মা দাওয়াত দেয়নি আমাকে, দিয়েছে মেয়ে, অতএব ঘটনা অন্য রকম কিছু একটা হবে। আমি হলাম জাতে মাতাল তালে ঠিক, তবুও বলা তো যায় না এ মেয়ের লক্ষণ কী! যাকগে, ভাবলাম সিরিয়াসভাবে কিছু নেওয়ার দরকার নেই, বন্ধু হয়ে ঘোরাঘুরি করলেই হলো, একেবারে একাকী থাকার চেয়ে একটি বান্ধবী থাকলে ক্ষতি কী।

জুলিয়া পড়ে ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনে, ডিপ্লোম্যাট হবে। তিন বছর বাকি তার প্রোগ্রাম শেষ হতে, আমার সময় লাগবে চার বছর, আমি পড়ি তখন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, ভাষা শিখতে এবং একস্ট্রা কিছু সাবজেক্ট কমপ্লিট করতে এক বছর লেগেছে। যা হোক রাতের ডিনার শেষে ডরমিটরিতে ফিরতে জুলিয়া বেশ কিছুক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে প্রায় আমার রুমের কাছে এসে ফিরে গেল। যাওয়ার বেলা আমি জুলিয়াকে বললাম আমি তো বাংলাদেশি পোলা, মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা এমন করে হয়নি, দূর থেকে চিঠিপত্রের মাধ্যমে প্রেমপ্রীতি করার একটু-আধটু অভ্যাস আছে। বললাম, তোমাদের এখানে তো সরাসরি ঘটনা, আমার মনে হয় ঠিকমতো পাস করা কঠিন হতে পারে বা ভুল–বোঝাবুঝি হতে পারে, তা তুমি একটু ম্যানেজ করে নিয়ো। জুলিয়া একটু মুচকি হেসে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, আমাকেও মাঝেমধ্যে চিঠি দিয়ো।

আমাদের দিনকাল খারাপ যাচ্ছে না। দেখতে দেখতে ছয় মাস পার হয়ে গেছে। জুলিয়া আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছরের জন্য একটি ভালো স্কলারশিপ পেয়েছে কিন্তু সে যেতে চাইছে না। কারণ হচ্ছে আমাকে ফেলে সে যাবে না। আমার সুইডেন থেকে নড়ার কোনো সুযোগ নেই। কী আর করি! প্রেমে বড় জ্বালা। যেতে নাহি দিব তবু যেতে দিতে হবে। কথা ছিল চিঠি দেব, দেখতে দেখতে সময় পার হয়ে যাবে আমাদের মধুর মিলন হবে, কিন্তু সেটা হয়নি। জুলিয়ার আমেরিকা যাওয়ার তিন মাস পরে আমি স্টকহোমে মুভ করি, নতুন জীবন শুরু, সময়ের সঙ্গে সবকিছু কোথায় ফেলে এসেছি জানার সুযোগ আর হয়নি, সময়ও হয়নি।

আজ সুইডেনের বড় দিন, লিনসোপিং শহরে ঘুরতে পথে হঠাৎ দেখে থমকে গেলাম। কে সেই সুন্দর কে? মারিয়া, আমার সহধর্মিণী জানতে চাইল। জুলিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই সে নিজ থেকে মারিয়াকে বলল, তোমার রহমানের সঙ্গে বহু বছর আগে আমার পত্রমিতালি ছিল। আমি এখন ডিপ্লোম্যাট, ছুটিতে সুইডেনে এসেছি। কল্পনায় ভাবিনি রহমানকে দেখব সিনসোরিংয়ে।

সবাই একসঙ্গে কিছুক্ষণ কফির আড্ডাখানায় সময় কাটানোর পর ফিরে গেলাম মায়ের কাছে। আমরা আজ লিনসোপিংয়ে এসেছি মাকে দেখতে, ২০০৬ সাল থেকে আমার মা শুয়ে আছেন লিনসোপিংয়ের স্লাকা কবরস্থানে।


প্রজন্মনিউজ২৪/এমএইচ

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন





ব্রেকিং নিউজ