এভারেস্ট জয়ের ৭০ বছরে জয়ীদের কীর্তি বললেন সন্তানরা

প্রকাশিত: ০১ জুন, ২০২৩ ০১:২৯:০৭

এভারেস্ট জয়ের ৭০ বছরে জয়ীদের কীর্তি বললেন সন্তানরা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: জামলিং তেনজিং নোরগে বলেছেন, ‘আমি তাদের সত্যিকারের অগ্রদূত ও অভিযাত্রী হিসেবে দেখি, যারা অজানার পথকে জয় করেছে। তাদের দলবদ্ধ প্রয়াসের কারণেই আমরা আজ অনেক কিছু করতে পারছি।

আজ থেকে ৭০ বছর আগে, ২৯ মের ঐতিহাসিক মুহূর্তের কথা বলছিলেন জামলিং, যিনি পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্ট জয়ী প্রথম দুই অভিযাত্রীর একজন তেনজিং নোরগের সন্তান।

নিউজিল্যান্ডের মৌমাছি পালনকারী এডমন্ড হিলারি যখন নেপাল-চীন সীমান্তে মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার যাত্রা শুরু করেন, তখন তার সাথে ছিলেন তেনজিং নোরগে।

ঐতিহাসিক দুই পর্বতারোহীর ছেলে, জামলিং তেনজিং নোরগে ও পিটার হিলারি। তারা নিজেদের বাবার কাছ থেকে পর্বত জয়ের ওই বীরত্বের গল্প শুনে বড় হয়েছেন। পরে দুজনেই এভারেস্ট জয় করে তাদের বাবাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন।

এভারেস্ট জয়ের ঐতিহাসিক ৭০তম বার্ষিকীতে এক সাক্ষাৎকারে নিজেদের বাবার কৃতিত্বের কথা গর্বের সাথে তুলে ধরেন এভারেস্ট জয়ী বীরদের সন্তানরা।

১৯৫৩ সালের ওই পর্বতারোহণের ঘটনা এমন নজির স্থাপন করেছে, যা কালে কালে অনুসরণ করা হয়ে আসছে।

চলতি বছর পর্বত আরোহণের মৌসুম শুরুর প্রথম ১০ দিনের মধ্যে ৫০০ জনেরও বেশি মানুষ মাউন্ট এভারেস্টের আট হাজার ৮৪৯ মিটার চূড়ায় পৌঁছেছে।

প্রযুক্তি, পর্বত আরোহণের সরঞ্জাম ও যোগাযোগের উন্নয়নের কারণেই এমনটা সম্ভব হয়েছে।

কিন্তু এডমন্ড হিলারি ও তেনজিং নোরগে জিপিএস বা স্যাটেলাইট ফোনের মতো আধুনিক গ্যাজেট ছাড়াই ওই কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন।

ওই সময় তাদের কৃতিত্বের খবর লন্ডনে পৌঁছাতে তিন দিন সময় লেগেছিল।

জামলিং নোরগে বলেন, তারা যাত্রা শুরু করেছিলেন সাধারণ মানুষ হিসেবে এবং ফিরে এসেছেন বিশ্বনায়ক হয়ে। কিন্তু এত বড় অর্জন তাদের বদলাতে পারেনি।

তারা দু’জন আগের মতোই সাধাসিদা ছিলেন। দু’জনই ছিলেন নম্র স্বভাবের।

গর্বের সাথে জামলিং বলেন, ‘দু’জনই তাদের বাকি জীবন হিমালয়ের মানুষকে শুধু দিয়েই গিয়েছেন।’

এডমন্ড হিলারির ছেলে পিটার বলেন, যখনই কেউ এমন কোনো কাজ করে যা আগে কখনো কেউ করেনি, তখন তারা অন্যদের অনুপ্রাণিত করে যে চাইলে আপনিও পারবেন। ৭০তম বার্ষিকীতে আসুন আমরা সেই অর্জন উদযাপন করি।

এই জুটি আগের তিন দশকে একাধিকবার এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার চেষ্টা করেছিলেন। একের পর এক ব্যর্থতার পর এক পর্যায়ে তারা সফল হন।

তেনজিং দুই দশক ধরে ছয়বার এভারেস্টে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন। যার মধ্যে একটি ছিল ১৯৫২ সালে, কিন্তু তিনি ওই বছরও ব্যর্থ হন।

জামলিং বলেন, ‘আমার বাবা ছোটবেলায় ইয়াক ( চমরি গাই) চড়াতেন। তখন তাকে একটি বিষয় ভাবাতো, এভারেস্টের ওপর দিয়ে কেন কোনো পাখি উড়তে পারে না। তিনি লামার (একজন উচ্চ পদস্থ বৌদ্ধ পুরোহিত) ভবিষ্যদ্বাণী দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। লামা তাকে বলেছিলেন যে এই পর্বত শিখরে একজন বৌদ্ধ অনুসারী প্রথম পা রাখবে।

পিটার বলেন, যখন তার বাবাকে নবম ব্রিটিশ অভিযানে অংশ নিয়ে এভারেস্টের শিখর অতিক্রমের চেষ্টা করতে বলা হয়েছিল, তিনি তখনই বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি ইতিহাস তৈরির একটি দুর্দান্ত সুযোগ পেয়েছেন।

পিটার বলেন, তিনি সবসময়ই জানতেন যে তিনি অসম্ভবকে জয় করতে চান। তিনি একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী লোক ছিলেন। তার মুখে বলা ওই অভিযাত্রার একটি বিষয় আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে, তিনি কিভাবে তুষার ও বরফের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ চূড়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন।

তিনি বলেন, তিনি সামনের দিকে ছিলেন, তুষার ও বরফের পুরু স্তরগুলো কেটে কেটে হাঁটার ধাপ তৈরি করছিলেন। পরে সেই খাড়া ঢাল বেয়ে তিব্বতে নেমেছিলেন।

ভয়াবহ আবহাওয়া সত্ত্বেও তারা চলতে থাকেন।

পিটার মনে করেন যে এটি এভারেস্ট না হয়ে অন্য কোনো পর্বত হলে তার বাবা হাল ছেড়ে দিতেন এবং অন্য কোনো দিন ফিরে আসতেন।

তার বিশ্বাস যে তার বাবাকে ভেতর থেকেই কেউ বলছিল যেন তিনি চলতে থাকেন, হাল না ছাড়েন।

তারা যখন চূড়ায় পৌঁছান, তখন তাদের অক্সিজেনের পরিমাণ ছিল খুব কম। এ জন্য বিশ্বের শীর্ষ চূড়ায় তারা মাত্র ১৫ মিনিট সময় কাটাতে পেরেছেন। এরপর তাদের নেমে আসতে হয়।

চমকপ্রদ ছবি
এভারেস্টের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে পা রেখে তেনজিং বৌদ্ধ ধর্মের দেবতাদের উদ্দেশে নৈবেদ্য হিসেবে কিছু মিষ্টি ও বিস্কিট বরফের মধ্যে পুঁতে দেন।

এডমন্ড হিলারি চূড়ায় উঠে বেশ কয়েকটি ছবি তোলেন। এর একটিতে দেখা যাচ্ছে, তেনজিং ব্রিটেন, নেপাল, জাতিসংঘ ও ভারতের পতাকা ওড়াচ্ছেন।

একই সাথে আশপাশের দৃশ্যও ধারণ করেন তিনি। কিন্তু চূড়ায় ওঠা অবস্থায় হিলারির কোনো ছবি ছিল না।

পিটার বলছিলেন, বাবা মজা করে বলেছিলেন, যতদূর তিনি জানতেন, তেনজিং এর আগে ক্যামেরা ব্যবহার করেননি এবং তিনিও মনে করেননি যে ওই ক্যামেরা দিয়ে তেনজিংকে প্রথম ছবি তুলতে বলা যেত।

কয়েক দশক পরে যখন পিটার ও জামলিং এভারেস্টে আরোহণ করেন, তখন তারা দু’জন আরো ভালোভাবে বুঝতে পারেন যে তাদের বাবারা কোন অজানা পথগুলো অতিক্রম করেছিলেন।

পিটার বলেন, আমি প্রথম ১৯৯০ সালে আরোহণ করেছিলাম। আমি ওই সময় আমার বাবার কথা ভাবা থামাতে পারিনি। যখন আমি হিলারির ধাপে পৌঁছলাম, তখন আমার বাবা যা দেখেছিলেন আমিও তাই দেখলাম। আমিও একই অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। পুরো বিষয়টা খুবই আবেগপ্রবণ ছিল।

জামলিং ১৯৯৬ সালে ধর্মীয় ও ব্যক্তিগত কারণে পর্বতারোহণ করেন।

তিনি ও তার বাবা উভয়েই ছিলেন শেরপা। শেরপা হচ্ছে তিব্বতের একটি জাতিগোষ্ঠী, যারা পর্বতারোহণের দক্ষতার জন্য বিখ্যাত। শেরপারা হিমালয়ের সাথে নিজেদের গভীর আধ্যাত্মিক সংযোগ অনুভব করে।

জামলিং বলেন, ‘এটি আমার জন্য একটি তীর্থযাত্রার চেয়ে বেশি কিছু ছিল। আমি আমার ধর্ম ও রীতিনীতির সাথে পুনরায় সংযোগ স্থাপন করতে চাই এবং আমার বাবা কিসের মধ্য দিয়ে গেছেন তা বুঝতে চাই।’

উপচে পড়া ভিড়ে
এখন প্রতি বছর বহু মানুষ এভারেস্ট জয় করছেন। পিটার বা জামলিং শিখরে পৌঁছালেও কেউই তাদের বাবারা যে ধরনের প্রশংসা পেয়েছিলেন- তারা কাছাকাছি কিছু অনুভব করতে পারেননি।

সম্প্রতি কামি রিতা ২৮তম বারের জন্য এভারেস্টের শীর্ষে আরোহণ করেছেন, আগেই এককভাবে সর্বোচ্চ বার এভারেস্ট জয়ের রেকর্ড গড়েছিলেন তিনি। ওই রেকর্ড স্থাপনের মাত্র এক সপ্তাহের মাথায় আবার নিজের রেকর্ডটি ভাঙেন তিনি।

তিনি বলেন, তিনি শিগগিরই অবসর নিবেন না। কারণ পাসাং দাওয়া নামে এক শেরপার সাথে তার জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে।

এ কারণেই কামি রিতা এমন ঘোষণা দিতে পারেন।

পাসাং দাওয়া ইতোমধ্যে ২৬বার এভারেস্ট জয় করেছেন এবং আরো জয়ের প্রচেষ্টায় আছেন।

লাকপা নামে নারী শেরপা, নারী পর্বতারোহীদের মধ্যে রেকর্ড করেছেন। তিনি গত বছর ১০তম বারের মতো চূড়ায় উঠেছেন।

তবে এই শেরপাদের কেউ তাদের পরিবারের দেয়া নাম ব্যবহার করেন না।

জামলিং বলেন, ‘আমার বাবার সময়ের তুলনায় এখনকার দিনে পর্বতারোহণ অনেক সহজ হয়েছে। এ জন্য প্রযুক্তি অনেক সাহায্য করছে। এভারেস্টের চূড়া অতিক্রম করার পর কেউ কেউ এখন দুই নম্বর ক্যাম্প থেকে হেলিকপ্টারে করে কাঠমান্ডুতে যাচ্ছে। সব রুট ঠিক করা আছে, অক্সিজেন ও অন্য সরঞ্জাম শেরপারা বহন করে।’

তিনি বলেন, এখন আর আগের মতো অ্যাডভেঞ্চারের রোমাঞ্চ নেই। এটা একটা ফটোগ্রাফিক ইভেন্টে পরিণত হয়েছে। তারা শুধু আরোহণ করতে আসে না। তারা আসে উপভোগ করতে।

পিটারও এই বক্তব্যের সাথে আংশিকভাবে একমত।

পিটার বলেন, ‘আমাদের বেস ক্যাম্প থেকে চূড়া পর্যন্ত অসংখ্য দড়ি থাকে, খাদের ওপরে মই বসানো থাকে, ক্যাম্পে গরম চাসহ শেরপা দল থাকে। আপনাকে হেলিকপ্টারে ছয় হাজার ৩০০ থেকে ছয় হাজর ৫০০ মিটার পর্যন্ত নিরাপদে উদ্ধার করা যেতে পারে। তবুও পর্বতটা একই। বিভিন্ন চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির একটা বিশাল পর্বত।’

এখনো ওই পর্বতারোহণকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। গত ১০০ বছরে ৩০০ জনেরও বেশি পর্বতারোহীর মৃত্যু হয়েছে। শুধু এই মৌসুমে মৃতের সংখ্যা ১১ জনে দাঁড়িয়েছে।

জামলিং বলেন, ‘পর্বত আপনাকে শেখাবে প্রকৃতিকে সম্মান করতে, আমরা এই পৃথিবীতে কয়েক দিনের অতিথি মাত্র।’

সূত্র : বিবিসি


প্রজন্মনিউজ২৪/এমএ

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ