বজ্রপাত কেন হয়?

প্রকাশিত: ২৭ মে, ২০২৩ ০৪:১৭:১২

বজ্রপাত কেন হয়?

 বর্ষা মৌসুমে দেশের বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাতে মানুষের প্রাণহানির ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে। বজ্রপাতের মৃত্যুর ঘটনায় কমবেশি সব মানুষের হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত। বজ্রপাত কী? এটি কেন হয়? দিন দিন এটি বেড়ে যাওয়ার কারণই বা কী? আল্লাহ ও তাঁর রাসুল কোরআন-সুন্নায় বজ্রপাত সম্পর্কে কী বলেছেন?
ঘন ঘন বজ্রপাত আসমানি দুর্যোগ। মানুষকে অন্যায় থেকে বিরত রাখার সতর্কবার্তা। এ বজ্রপাত মহান আল্লাহর শক্তিমত্তার এক মহানিদর্শন। তিনি ইচ্ছা করলেই যে কাউকেই এ বজ্রপাতের মাধ্যমে শাস্তি দিতে পারেন। আবার মানুষও এ বজ্রপাত থেকে সর্বোত্তম শিক্ষা নিতে পারে।

বজ্রপাত কী?

আল্লাহ তাআলার শক্তির নিদর্শনগুলোর একটি হলো বজ্রপাত। তিনি চাইলেই যে কাউকে যেকোনো সময় বজ্রপাতের মাধ্যমে শাস্তি দিতে পারেন। যদিও সবক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা এমনটি করেন না। বজ্রপাত সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে-
وَ یُسَبِّحُ الرَّعۡدُ بِحَمۡدِهٖ وَ الۡمَلٰٓئِکَۃُ مِنۡ خِیۡفَتِهٖ ۚ وَ یُرۡسِلُ الصَّوَاعِقَ فَیُصِیۡبُ بِهَا مَنۡ یَّشَآءُ وَ هُمۡ یُجَادِلُوۡنَ فِی اللّٰهِ ۚ وَ هُوَ شَدِیۡدُ الۡمِحَالِ
‘বজ্র তাঁরই তাসবিহ ও হামদ জ্ঞাপন করে এবং তাঁর ভয়ে ফেরেশতাগণও (তাসবিহরত রয়েছে)। তিনিই গর্জমান বিজলি পাঠান, তারপর যার ওপর ইচ্ছা একে বিপদরূপে পতিত করেন। আর তাদের (অর্থাৎ কাফিরদের) অবস্থা এই যে তারা আল্লাহ সম্পর্কেই তর্কবিতর্ক করছে, অথচ তাঁর শক্তি অতি প্রচণ্ড। ’ (সুরা রাদ: আয়াত ১৩)
হাদিসে পাকে এসেছে, এক প্রভাবশালী লোকের কাছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে লোক পাঠালে সে বললো, ‘কে আল্লাহর রাসুল? আল্লাহ কি? সোনার না রূপার? নাকি পিতলের?
এভাবে তিনবার সে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাঠানো লোককে ফিরিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তার উপর আকাশ থেকে বজ্রপাত করলেন। ফলে তার মাথা গুড়িয়ে যায়। তখন এ আয়াত নাজিল হয়।’ (ইবনে আবি আসেম: আস সুন্নাহ)

বজ্রপাত কেন হয়?


মানুষের কাজকর্মই বজ্রপাতের মূল কারণ। দুনিয়ায় আল্লাহর অবাধ্যতা যত বাড়বে, দুনিয়ার বুকে বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ ততই বাড়বে। সুরা রাদের ১৩নং আয়াতের শেষাংশে [আর তাদের (অর্থাৎ কাফিরদের) অবস্থা এই যে তারা আল্লাহর সম্পর্কেই তর্কবিতর্ক করছে, অথচ তার শক্তি অতি প্রচণ্ড।] এ ধরনের অতি আপডেট ব্যক্তিদের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।
হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, ইহুদিরা একবার নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললেন, হে আবুল কাসিম! (বৃষ্টির সময় আকাশে যে আওয়াজ হয় সেটা কীসের আওয়াজ?) আমাদেরকে রাদ (মেঘের গর্জনের আওয়াজ)প্রসঙ্গে বলুন, এটা কি? তিনি বললেন, ‘মেঘমালাকে হাকিয়ে নেওয়ার জন্য ফেরেশতাদের একজন নিয়োজিত আছে। তার সঙ্গে রয়েছে আগুনের চাবুক। এর সাহায্যে সে মেঘমালাকে সেই দিকে পরিচালনা করেন, যেদিকে আল্লাহ তাআলা চান। তারা বললো, আমরা যে আওয়াজ শুনতে পাই তার তাৎপর্য কি? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এটা হচ্ছে ফেরেশতার হাকডাক। এভাবে হাকডাক দিয়ে সে মেঘমালাকে তার নির্দেশিত স্থানে নিয়ে যায়।’ তারা বললো, আপনি সত্য বলেছেন।’ (তিরমিজি)

বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ার কারণ কী?


আল্লাহর অবাধ্যতাই বজ্রপাতের মূল কারণ। কেননা হাদিসে পাকের বর্ণনা থেকেও তা সুস্পষ্ট। সেখানে এসেছে, যারা আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হবে না- আল্লাহ তাআলা তাদের বজ্রপাতের আওয়াজ শোনাবেন না। হাদিসে পাকে এসেছে-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ বলেছেন, আমার বান্দারা যদি আমার বিধান মেনে চলতো, তবে আমি তাদের রাতের বেলায় বৃষ্টি দিতাম আর সকাল বেলায় সূর্য (আলো) দিতাম আর কখনও তাদের বজ্রপাতের আওয়াজ শোনাতাম না।’ (মুসনাদে আহমদ)

বজ্রপাতের ক্ষতি থেকে বাঁচার উপায় ও দোয়া


আল্লাহ তাআলার বিধান মেনে জীবন পরিচালনায় রয়েছে বজ্রপাত থেকে বেঁচে থাকার উপায়। কারণ নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদিসে পাকে সুস্পষ্ট করে বলেছেন, যারা আমার বিধান মেনে চলবে, তাদের জন্য দিনে থাকবে আলো আর রাতে থাকবে বৃষ্টি। আর তাদের বজ্রপাতের আওয়াজ শোনানো হবে না।
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মতকে আসমানি দুর্যোগ বজ্রপাত থেকে বেঁচে থাকতে শিখিয়েছেন দোয়া। যারা এ দোয়া পড়বে আল্লাহ তাআলা তাদের বজ্রপাতের ক্ষতি থেকে হেফাজত করবেন। হাদিসে এসেছে-
১. হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর বাবা থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বজ্রের শব্দ শুনতেন বা বিদ্যুতের চমক দেখতেন তখন সঙ্গে সঙ্গে বলতেন-
اَللَّهُمَّ لَا تَقْتُلْنَا بِغَضَبِكَ وَ لَا تُهْلِكْنَا بِعَذَابِكَ وَ عَافِنَا قَبْلَ ذَلِكَ
উচ্চারণ: ‘আল্লাহুম্মা লা তাক্বতুলনা বিগাদাবিকা ওয়া লা তুহলিকনা বিআজাবিকা, ওয়া আ’ফিনা ক্ববলা জালিকা।’
অর্থ: ‘হে আমাদের প্রভু! তোমার ক্রোধের বশবর্তী হয়ে আমাদের মেরে ফেলো না আর তোমার আজাব দিয়ে আমাদের ধ্বংস করো না। বরং এর আগেই আমাদেরকে ক্ষমা ও নিরাপত্তার চাদরে আবৃত করো।’ (তিরমিজি ৩৪৫০)

২. হজরত ইবনে আবি জাকারিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যে ব্যক্তি বজ্রের আওয়াজ শুনে এ দোয়া পড়বে-
سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ
উচ্চারণ: ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি।’
সে বজ্রপাতের আঘাত থেকে মুক্ত থাকবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ২৯২১৩)

৩. হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মেঘের গর্জন শুনতেন তখন কথাবার্তা ছেড়ে দিতেন এবং এ আয়াত পাঠ করতেন-
سُبْحَانَ الَّذِىْ يُسَبِّحُ الرَّعْدُ بِحَمْدِهِ وَالْمَلَائِكَةُ مِنْ خِيفَتِهِ
উচ্চারণ: ‘সুবহানাল্লাজি ইউসাব্বিহুর রাদু বিহামদিহি ওয়াল মালাইকাতু মিন খিফাতিহি।’
অর্থ: ‘পবিত্র সেই মহান সত্তা প্রশংসা যিনি পানিভরা মেঘ উঠান। মেঘের গর্জন তার প্রশংসা সহকারে তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করে এবং তার ফেরেশতারাও তাঁর ভয়ে কম্পিত হয়ে তাঁর তাসবিহ পাঠ করে।’ (মুয়াত্তা মালেক, মিশকাত)
বজ্রপাত আল্লাহর দিকে ফিরে আসার অনুপ্রেরণা
মেঘের প্রচণ্ড গর্জন তথা বজ্রপাত ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো ভয়াবহ শাস্তি থেকে মুক্ত থাকতে আল্লাহ তাআলার বিধান মেনে চলা জরুরি। পাশাপাশি বজ্রপাতের ভয়াবহতা থেকে বেঁচে থাকতে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শেখানো দোয়া ও তাসবিহগুলো পড়া উচিত।
ছোট-বড় সবধরনের বজ্রপাত ও বিদ্যুৎ চমক থেকে বেঁচে থাকতে হলে অবশ্যই মানুষকে দুনিয়ার যাবতীয় অন্যায় পরিত্যাগ করতে হবে। নিজেদের গুনাহ থেকে খাঁটি তাওবা করতে হবে। যারা খাঁটি তাওবার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার দিকে ফিরে আসবে তারাই বজ্রপাত থেকে মুক্ত থাকবে। হাদিসে পাকে এসেছে-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ বলেছেন, আমার বান্দারা যদি আমার বিধান মেনে চলতো, তবে আমি তাদের রাতের বেলায় বৃষ্টি দিতাম আর সকাল বেলায় সূর্য (আলো) দিতাম আর কখনও তাদের বজ্রপাতের আওয়াজ শোনাতাম না।’ (মুসনাদে আহমদ)
কোরআন এবং সুন্নাহর বর্ণনায় এ কথা সুস্পষ্ট যে, বজ্রপাত পরাক্রমশালী আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এক মহাদুর্যোগ। আল্লাহ প্রদত্ত এ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বেঁচে থাকতে হলে কোরআন-সুন্নার দিকনির্দেশনা মেনে চলার বিকল্প নেই।

মনে রাখা জরুরি


বজ্রপাত হচ্ছে আসমানি দুর্যোগ। মানুষকে অন্যায় থেকে বিরত রাখার একটি সতর্কবার্তাও বটে। এ বজ্রপাত আল্লাহ তাআলা শক্তিমত্তার এক মহানিদর্শন। তিনি ইচ্ছা করলেই যে কাউকে এ বজ্রপাতের মাধ্যমে শাস্তি দিতে পারেন। আবার মানুষও এ বজ্রপাত থেকে সর্বোত্তম শিক্ষা নিতে পারে। আর কোরআন মাজিদের একটি সুরার নামই রয়েছে রাদ। যার অর্থও ‘বজ্রপাত’। বজ্রপাত নামে নাজিল হওয়া সুরায় মহান আল্লাহ সে কথাই ঘোষণা করেছেন-
هُوَ الَّذِي يُرِيكُمُ الْبَرْقَ خَوْفًا وَطَمَعًا وَيُنْشِئُ السَّحَابَ الثِّقَالَ - وَيُسَبِّحُ الرَّعْدُ بِحَمْدِهِ وَالْمَلاَئِكَةُ مِنْ خِيفَتِهِ وَيُرْسِلُ الصَّوَاعِقَ فَيُصِيبُ بِهَا مَن يَشَاء وَهُمْ يُجَادِلُونَ فِي اللّهِ وَهُوَ شَدِيدُ الْمِحَالِ
‘তিনিই তোমাদের বিদ্যুৎ দেখান ভয়ের জন্য এবং আশার জন্য এবং উপেক্ষিত করেন ঘন মেঘমালা। তাঁর (তাহমিদ) প্রশংসা কর। বজ্র এবং ফেরেশতারাও তার ভয়ে (তাসবিহরত)। তিনি বজ্রপাত করেন। অতঃপর যাকে ইচ্ছা তিনি তা (বজ্রপাত) দ্বারা আঘাত করেন। এরপরও তারা আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্ক করে অথচ তিনি মহাশক্তিশালী।’ (সুরা রাদ : আয়াত ১২-১৩)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে মেঘের গর্জন তথা বজ্রপাত ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো ভয়াবহ শাস্তি থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আল্লাহর বিধিবিধান মেনে জীবন গড়ার তাওফিক দান করুন। কোরআন-সুন্নাহর ওপর আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।


প্রজন্মনিউজ২৪/ইমরান

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন





ব্রেকিং নিউজ