গাজীপুরে কে জিতলেন, কেন জিতলেন?

প্রকাশিত: ২৬ মে, ২০২৩ ০২:৪৭:২৮

গাজীপুরে কে জিতলেন, কেন জিতলেন?

নিজস্ব প্রতিবেদক  :  আজমত উল্লা খানের মতো একজন ঝানু রাজনীতিবিদ এমন একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরে গেলেন, যিনি মেয়র পদে মনোনয়ন জমা দেওয়ার আগে রাজনৈতিক বা সামাজিকভাবে একটুও পরিচিত ছিলেন না।
বিজয়ের পর নগরীর ছয়দানা এলাকায় বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন জায়েদা খাতুন। সঙ্গে ছিলেন তার ছেলে জাহাঙ্গীর আলম। বিজয়ের পর নগরীর ছয়দানা এলাকায় বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন জায়েদা খাতুন। সঙ্গে ছিলেন তার ছেলে জাহাঙ্গীর আলম।

হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে জয়ী হয়েছেন এই সিটির সাবেক (বহিষ্কৃত) মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। এই বাক্যটি ভুল মনে হতে পারে। কেননা, অফিসিয়ালি জয়ী হয়েছেন তার মা জায়েদা খাতুন। কিন্তু কার্যত এটি জাহাঙ্গীরের জয়। কার্যত এটি সরকারের নির্বাচনী কৌশলের জয়। কার্যত এটি সেই কৌশলের কারণে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খানের পরাজয় এবং জাহাঙ্গীর আলমের ভাষায় ‘এটি নৌকার নয় বরং ব্যক্তি আজমত উল্লার পরাজয়’।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা তথা নির্বাচনের প্রবণতা দেখে জনমনে হয়তো এরকম একটি ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী আজমত উল্লা খানই জয়ী হবেন বা তাকে ‘জিতিয়ে আনা হবে’। কিন্তু যখন একে একে সবগুলো কেন্দ্রের ফলাফল আসতে শুরু করলো, তখন দেখা গেলো নৌকা ও টেবিল ঘড়ির ব্যবধান খুব কম এবং কিছুটা এগিয়ে থাকছেন জায়েদা খাতুন। মধ্য রাতে ভোটের চূড়ান্ত ফলাফলে জানা গেলো ৪৮০টি কেন্দ্রে জায়েদা খাতুন (টেবিল ঘড়ি) পেয়েছেন ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট। আজমত উল্লা খান (নৌকা) পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট। অর্থাৎ ভোটের ব্যবধান মাত্র ১৬ হাজার ১৯৭।

আজমত উল্লা খানের মতো একজন ঝানু রাজনীতিবিদ এমন একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরে গেলেন, যিনি মেয়র পদে মনোনয়ন জমা দেওয়ার আগে রাজনৈতিক বা সামাজিকভাবে একটুও পরিচিত ছিলেন না। নির্বাচন তো দূরের কথা, কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও তিনি কখনো অংশ নেননি। বরং মানুষ তার নাম জানলো তার পক্ষে তার ছেলে জাহাঙ্গীর আলম যখন মেয়র পদে মনোনয়নপত্র জমা দিলেন। অর্থাৎ আজমত উল্লা খান পরাজিত হয়েছেন জাহাঙ্গীর আলমের কাছে; তার মায়ের কাছে নন বা কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে নন। নারী  হিসেবে নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর যেমন একটা ইমেজ আছে এবং যে ইমেজের কারণে তিনি শামীম ওসমানের মতো শক্তিমান রাজনীতিবিদের চেয়েও এগিয়ে থাকেন—জায়েদা খাতুনকে তার সেই লৈঙ্গিক পরিচয়ও কোনো বাড়তি সুবিধা দিয়েছে বলে মনে হয় না। বরং এখানে তার জয়ের পুরো কৃতিত্ব তার ছেলের এবং আরও কিছু ফ্যাক্টরের।

১. আজমত বনাম জাহাঙ্গীর : এটি দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে, গাজীপুরে দলীয় নেতা কিংবা ব্যক্তি হিসেবেও আজমত উল্লা খানের চেয়ে জাহাঙ্গীর আলমের ভোট বেশি। নানা ঘটনায় এটি বোঝা যায় যে তার জনসম্পৃক্ততাও বেশি। বিশেষ করে গাজীপুর শিল্পাঞ্চল হওয়ায় এবং জাহাঙ্গীর আলম নিজেও একজন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী বলে পোশাক শ্রমিকদের অধিকাংশই তাকে ভোট দেন। এটি গাজীপুরের একটি বিরাট ভোট ব্যাংক। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৩ সালের গাজীপুর সিটি নির্বাচনেও যখন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খান বিএনপির প্রার্থী এম এ মান্নানের কাছে হেরে গিয়েছিলেন, সেখানেও জাহাঙ্গীর আলম ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছেন। ওই নির্বাচনে জাহাঙ্গীর আলম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নেন এবং ভোটগ্রহণের বেশ কয়েকদিন আগে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর পরেও প্রায় ৩০ হাজার ভোট পান। তার মানে ভোঠের মাঠে থাকলে হয়তো তিনি ওই নির্বাচনেও জয়ী হতেন। এরপর ২০১৮ সালের সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে গাজীপুরের মেয়র নির্বাচিত হন জাহাঙ্গীর। কিন্তু বেশিদিন থাকতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করায় ২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর তিনি দল থেকে বহিষ্কৃত হন। পরে মেয়র পদও খোয়ান। পরে অবশ্য দল তাকে ক্ষমা করে দেয়। কিন্তু তিনি দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে এবার মেয়র পদে মনোনয়নপত্র জমা দেন। তখন তিনি তার মায়ের পক্ষেও মনোনয়নপত্র জমা দেন। কারণ তিনি নিশ্চিত ছিলেন বা ধারণা করছিলেন যে হয়তো তার মনোনয়ন বাতিল হবে। তা-ই হয়েছে এবং মাকে ডামি প্রার্থী রেখে মূলত জাহাঙ্গীর আলম নির্বাচনে অংশ নিলেন। জিতলেন। সরকার কি জাহাঙ্গীরর এই কৌশলের কাছে হেরে গেলো নাকি সরকার তার সঙ্গে জিততে চায়নি?

২. সংখ্যাগরিষ্ঠ অশিক্ষিত লোকের শাসন: বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে গণতন্ত্র আসলে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ অশিক্ষিত’ লোকের শাসন। অর্থাৎ এখনও আমাদের দেশের ভোটারদের অধিকাংশই ওই অর্থে শিক্ষিত নন। কিন্তু একজন দোকানদার বা একজন পোশাক শ্রমিকের একটি ভোটের যে দাম, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের ভোটেরও সেই দাম। মানুষ সব সময় তার নিজের লোককে ভোট দিতে চায়। সুতরাং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যদি দেখে যে কোনো একজন  প্রার্থী তার জন্য অধিকতর নিকটবর্তী বা যাকে সে মনে করে যে কালাচারালি কাছাকাছি—তাকে ভোট দিতে চায়। সুতরাং নির্বাচনে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকও একজন শ্রমিক নেতার কাছে হেরে যেতে পারেন। এটাই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সুবিধা এবং অসুবিধা।

৩. ভোটের সংস্কৃতি: বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো ও নির্বাচনী ব্যবস্থাটি এমন জায়গায় চলে গেছে যে, কার চেয়ে কে কতটা যোগ্য ও ভালো মানুষ—সেটি তার জয়-পরাজয়ের নিয়ামক নয়। মানুষ এখন ভোট দেয় কিছু পাওয়ার উদ্দেশ্যে নয়, বরং অনেক সময় ভোট দিয়ে তার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। অর্থাৎ আগের লোক ভালো ছিল না, তাই এবার আরও খারাপ লোককে ভোট দিলাম। এমন নয় যে যাকে ভোট দিলাম তিনি আগের জনের চেয়ে উত্তম। যে কারণে দেখা যায়, দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকের বাইরে থাকা বিপুল ভোটারের অনেকেই সুযোগ পেলেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে ভোট দিতে নিরুৎসাহিত হন। আবার ক্ষমতাবানের কাছ থেকে তার কমিউনিটির অনেক মানুষ যেমন উপকৃত হন, তার বিপরীতে বিপুল সংখ্যক মানুষ বঞ্চিত এবং নানাভাবে নির্যাতিতও হন। ফলে তারা ভোটের সময় ‘দেখিয়ে দেয়া’র অপেক্ষায় থাকেন।


৪. মার্কিন চাপ: সরকার বা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এটি স্বীকার করুক বা না করুক, গাজীপুরের নির্বাচনটি যে অবাধ, সুষ্ঠু এবং বিতর্কমুক্ত হলো, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা সম্পর্কিত সাম্প্রতিক ইস্যুরও ভূমিকা আছে। কেননা গাজীপুরে ভোটের একদিন আগেই যুক্তরাষ্ট্রের তরফে জানানো হয়েছে যে, বাংলাদেশের নির্বাচনে অনিয়ম হলে সেই অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবেন না। এটি যে সরকার সংশ্লিষ্ট অনেকের জন্যেই চিন্তার বিষয়, সেটি অস্বীকারের সুযোগ নেই। কারণ ব্যবসা-বাণিজ্য, টাকা পাচার, সন্তানদের পড়ালেখা তথা পরিবারের লোকজনের বসবাসসহ নানা কারণে অসংখ্য বাংলাদেশির সেকেন্ড হোম যুক্তরাষ্ট্র। আবার যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো নাগরিককে ভিসা না দেয় তাহলে তাদের পথ অনুসরণ করে কানাডাসহ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য বন্ধু রাষ্ট্রসমূহও যদি তাদেরকে ভিসা না দেয়, সেটি অনেকেরই ঘুম হারাম করে দেবে। সুতরাং ভিসাসম্পর্কিত এই মার্কিন হুঁশিয়ারিকে সরকার পাত্তা দিচ্ছে না বা এটি কোনো হুমকি নয় বলে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এমতাবস্থায় সরকারকে এটি প্রমাণে সচেষ্ট থাকতে হবে যে তারা নির্বাচনে কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার করছে না। অর্থাৎ বিশ্বকে এটি দেখানো যে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে এবং  স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে সক্ষম। সুতরাং এই ধারাবাহিকতায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনও তারা (ইসি) সরকারের প্রভাব ও চাপের বাইরে থেকে সফলভাবেই সম্পন্ন করতে পারবে।

৫. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু : স্থানীয় পর্যায়ের এসব নির্বাচন প্রভাবমুক্ত রেখে সরকার জাতীয় নির্বাচনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায় সরকারের অপ্রয়োজনীয়তার বিষয়টিও সামনে আনতে পারবে। স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছরের ১২ অক্টোবর অনিয়মের কারণে নির্বাচন কমিশন যেদিন গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনের ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেয়, তার পরদিনই তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছিলেন, এই উপনির্বাচনে ভোট বন্ধের ঘটনায় প্রমাণ হয়েছে দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন নেই। তাঁর এই কথা গণমাধ্যমে রয়ে গেছে।

৬. স্থানীয় নির্বাচনে সরকার বদল হয় না: ঘুরেফিরে যে প্রশ্নটি বরাবরই সামনে আসে তা হলো, স্থানীয় সরকার নির্বাচন যেমনই হোক; এ নির্বাচনে সরকার ও নির্বাচন কমিশন যত নিরপেক্ষ ভূমিকাই পালন করুক না কেন, এই নির্বাচন দিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে মূল্যায়ন করা যাবে কি? কারণ স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জয়-পরাজয়ের ওপর সরকার পরিবর্তন নির্ভর করে না। আরও যে চারটি সিটিতে (রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, বরিশাল) নির্বাচন হবে, তারও দুয়েকটি কিংবা সবগুলোতেও যদি ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা হেরে যান (সম্ভাবনা নেই), তারপরও তাতে সরকার বদল হয়ে যাবে না। এর মধ্য দিয়ে হয়তো সরকারের জনপ্রিয়তা কমেছে বলে প্রমাণিত হবে এবং বিরোধীরা বিশেষ করে বিএনপি এটি বলার সুযোগ পাবে যে, তারা ভোটের মাঠে না থাকার পরেও সরকারি দলের প্রার্থীরা হেরে গেছে—কিন্তু সেটিও সামগ্রিকভাবে জাতীয় নির্বাচনে খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না। কারণ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের বাইরে ব্যক্তির ইমেজ এবং আঞ্চলিকতা ও ইজম অনেক সময় বড় ভূমিকা রাখে। যেমন গাজীপুরে ভোট হয়েছে মূলত ব্যক্তি আজমত ‍উল্লা খান ও জাহাঙ্গীরের মধ্যে। উপরন্তু স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় কোন্দল, বিদ্রোহী প্রার্থীদের শক্তি—এসবেরও ভূমিকা থাকে। অতএব দলীয় সরকারের অধীনে সিটি নির্বাচন খুব ভালো হয়েছে বা হবে বলে সেই ধারাবাহিকতায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনও অবাধ-সুষ্ঠু ও গ্রহণহযোগ্য হবে—এমন উপসংহারে পৌঁছানে কঠিন। কেননা, নির্বাচন কেমন হবে তার পুরোটাই নির্ভর করবে সরকার ওই নির্বাচনটি কেমন দেখতে চায় তার ওপর। সরকার চাইলে গাজীপুরে কারসাজি করে নৌকার প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে পারতো। কিন্তু সরকার সেটি চায়নি বা করেনি। ‍সুতরাং জাতীয় নির্বাচনে কী হবে—সেটি এখনই ধারণা করা কঠিন।

পরিশেষে, গাজীপুরের এই নির্বাচন আওয়ামী লীগের একটি বড় বার্তা যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা যেসব আসনে দলীয় কোন্দল মিটিয়ে নৌকার প্রার্থী দিতে ব্যর্থ হবে, সেসবা জায়গায় তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীরা বেরিয়ে যাবেন। দ্বিতীয়ত নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও চাপমুক্ত রাখার ব্যাপারে সরকারের ওপর যে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি চাপ আছে, সেটিও বিরাট চ্যালেঞ্জ। ফলে আওয়ামী লীগের উচিত হবে এখন বিরোধীদের পেছনে বেশি সময় খরচ না করে নিজের ঘর গোছানোয় মনোযোগ দেয়া।


প্রজন্মনিউজ২৪/এমএইচ 

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ