আলকুরআনের দৃষ্টিতে তাওবা ও ইস্তিগফারের গুরুত্ব ও ফযীলত

প্রকাশিত: ২৮ এপ্রিল, ২০২৩ ১১:৩৯:২২

আলকুরআনের দৃষ্টিতে তাওবা ও ইস্তিগফারের গুরুত্ব ও ফযীলত

তাওবা ও ইস্তিগফার মুমিন ও মুত্তাকী বান্দাদের এক বিশেষ গুণ। মানুষকে আল্লাহ তাআলা তাঁর ইবাদত-বন্দেগী ও তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলার জন্য সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু মানুষ যেহেতু শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে  জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে  আল্লাহ তাআলার আদেশ-নিষেধ লঙ্ঘন করে বসে, আল্লাহ তাআলার মরজি মোতাবেক চলার ক্ষেত্রে ভুল করে থাকে, তাই আল্লাহ তাআলা তার সে ভুল বা গুনাহ থেকে মুক্তিদানের  জন্য তাওবা ও ইস্তিগফারের ব্যবস্থা রেখেছেন। এই তাওবা ও ইস্তিগফার একজন মুমিনকে দান করে নিষ্পাপ ও নিষ্কলুষ জীবন। মুমিনকে সর্বদা গুনাহমুক্ত জীবনের প্রতি করে অনুপ্রাণিত। মুমিনকে নিয়ে যায় ঈমান ও আমলের ক্ষেত্রে উন্নতি ও মর্যাদার সুউচ্চ শিখরে।

তাই তাওবা ও ইস্তিগফার মুমিনের জীবনের এক অপরিহার্য বিষয়। তাকওয়াপূর্ণ ও গুনাহমুক্ত জীবন লাভ করতে যা একান্ত জরুরি। আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে মুত্তাকীদের গুণাবলির বর্ণনা দিয়ে বলেন—

এবং তারা সেই সকল লোক, যারা কখনও কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে বা (অন্য কোনোভাবে) নিজেদের প্রতি যুলুম করলে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার ফলে নিজেদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে— আর আল্লাহ ছাড়া কেইবা আছে, যে গুনাহ ক্ষমা করতে পারে। আর তারা জেনেশুনে তাদের কৃতকর্মে অবিচল থাকে না। —সূরা আলে ইমরান (০৩) : ১৩৫

তাওবা ও ইস্তিগফার নবীদের সুন্নত

নবী-রাসূলগণ নিজেরা যেমন আপন রবের কাছে তাওবা ও ইস্তিগফার করেছেন, উম্মতকেও তাওবা ও ইস্তিগফার করতে আদেশ করেছেন। তাওবা-ইস্তিগফার শিক্ষা দিয়েছেন। যদিও নবী-রাসূলগণের তাওবা-ইস্তিগফার ও উম্মতের তাওবা ইস্তিগফারের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। কারণ নবী-রাসূলগণ মা‘সূম ও নিষ্পাপ। তাঁদেরকে আল্লাহ গুনাহ থেকে রক্ষা করেন। কিন্তু তাঁদের উম্মত তো মা‘সূম ও নিষ্পাপ নয়। তাই নবীগণের তাওবা ও ইস্তিগফার হয়ে থাকে কেবলমাত্র নিজেদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য। আর উম্মতের তাওবা ও ইস্তিগফার তো কখনো নিজেদের গুনাহের ক্ষমার জন্য, আবার কখনো নিজেদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য হয়ে থাকে।

নবীগণের তাওবা ও ইস্তিগফার

নবীগণও আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে তাওবা ও ইস্তিগফার করেছেন। তাদের তাওবা ও ইস্তিগফারের ঘটনা ও ভাষা কুরআন মাজীদে বিবৃত হয়েছে। আমরা এখানে কুরআন থেকে কয়েকজন নবীর তাওবা ও ইস্তিগফারের বর্ণনা তুলে ধরছি।

হযরত আদম আ.-এর বক্তব্যে তাওবা ও ইস্তিগফার

হে আমাদের রব! আমরা আমাদের নিজেদের প্রতি যুলুম করেছি। যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন  এবং আমাদের প্রতি দয়া না করেন তবে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তভুর্ক্ত হয়ে যাব। Ñসূরা আ‘রাফ (০৭) : ২১

হযরত নূহ আ.-এর বক্তব্যে তাওবা ও ইস্তিগফার

হে আমার রব! আপনি আমাকে আমার পিতা-মাতাকে এবং আমার ঘরে যারা ঈমানের সঙ্গে প্রবেশ করেছে এবং মুমিন নর-নারীদেরকে ক্ষমা করুন। আপনি যালেমদেরকে ধ্বংসই বৃদ্ধি করুন। —সূরা নূহ (৭১) : ২২

হযরত মূসা আ.-এর বক্তব্যে তাওবা ও ইস্তিগফার

হে আমার রব! নিশ্চয়ই আমি আমার প্রতি যুলুম করেছি। তাই আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। তাই তিনি তাকে ক্ষমা করলেন। নিশ্চয়ই তিনি বড় ক্ষমাশীল ও অতি দয়ালু। —সূরা কাসাস (২৮) : ২৪

হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বক্তব্যে তাওবা ও ইস্তিগফার

হযরত আগার ইবনে ইয়াসার আলমুযানী রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হে লোকসকল! তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কর। কেননা আমি দিনে একশত বার তাওবা করি। —সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭০২

এখানে এ কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, নবী ও রাসূলগণ আল্লাহ তাআলার নির্বাচিত বান্দা। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁদের গোটা জীবন আল্লাহ তাআলার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। তাই তারা যাবতীয় গুনাহ থেকে দূরে থেকে জীবন যাপন করেন। তাদের থেকে কখনও সগীরা বা কবীরা গুনাহ সংঘটিত হয়নি। এজন্যই আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের সর্ববাদী আকীদা হল, নবী ও রাসূলগণ মা‘সূম ও নিষ্পাপ। তাই আম্বিয়া আলাইহিমুস্ সালামের মুখে তাওবা ও ইস্তিগফার উচ্চারিত হওয়ার অর্থ কখনোই এ নয় যে, তারা তাদের গুনাহের জন্য বা নবুওতের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য তারা তাওবা ও ইস্তিগফার করে থাকেন; বরং তারা তো তাওবা ও ইস্তিগফার করেন আল্লাহ তাআলার কাছে তাঁদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য বা তাঁদের থেকে অধিক উত্তম কাজের তুলনায় কম উত্তম কাজ সংঘটিত হওয়ার কারণে এবং সঙ্গে সঙ্গে উম্মতকে তাওবা ও ইস্তিগফার শিক্ষা দেওয়ার জন্য।

নবীগণ তাদের উম্মতকে তাওবা ও ইস্তিগফার শিক্ষা দিয়েছেন

হযরত সালেহ আ. কতৃর্ক তাঁর উম্মতকে তাওবা ও ইস্তিগফার শিক্ষাদান :

আমি ছামুদ জাতির কাছে সালেহকে প্রেরণ করেছি। তিনি বললেন, হে আমার সম্প্রদায় তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো মাবুদ নেই। তিনিই তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। এবং তোমাদেরকে তাতে বসবাস করিয়েছেন। তাই তোমরা তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। অতঃপর তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তন কর। নিশ্চয়ই আমার রব অতি নিকটে এবং দুআ কবুলকারী। —সূরা হুদ (১১) : ৬১

এভাবে সকল নবী উম্মতকে আল্লাহর দরবারে নিজেদের ভুলত্রুটি ও গুনাহের জন্য তাওবা ও ইস্তিগফার করার আদেশ করেছেন এবং নিজেদের জীবনকে শিরকের গুনাহ থেকে শুরু করে সকল গুনাহ থেকে পবিত্র করার জন্য তাওবা ও ইস্তিগফার শিক্ষা দিয়েছেন। তাই দ্বীন ও শরীয়তে তাওবা ও ইস্তিগফারের গুরুত্ব অপরিসীম। 

তাওবা ও ইস্তিগফার মুমিনকে আল্লাহ তাআলার ক্ষমা ও দয়া লাভে সাহায্য করে

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন—

আর তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ বড় ক্ষমাশীল ও অতি দয়ালু। —সূরা বাকারা (০২) : ১৯৯

তিনি আরও বলেন—
তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। অতঃপর তাঁর কাছে ফিরে আস। নিশ্চয়ই আমার রব অতি দয়ালু ও অধিক মমতাময়।—সূরা হুদ (১১) : ৯০

তাওবা ও ইস্তিগফারকারীদের প্রতি আল্লাহ শাস্তি প্রেরণ করেন না

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন—

আপনি তাদের মাঝে থাকা অবস্থায় কিছুতেই আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দেবেন না। আর তারা ক্ষমা প্রার্থনা করা অবস্থায়ও তাদেরকে শাস্তি দেবেন না। —সূরা আনফাল (০৮) : ৩৩

এমনকি তাওবা-ইস্তিগফারের ফলে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো জাতির উপর শাস্তি আসার প্রতিশ্রম্নতি দেওয়ার পরও সে শাস্তিকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে হযরত ইউনুস আ.-এর কওমের ঘটনা উল্লেখযোগ্য, যা আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে

কেন কোনো জনপদ(বাসীরা) ঈমান আনয়নকারী হল না? তাহলে তাদের ঈমান তাদের উপকারে আসত। তবে ইউনুসের সম্প্রদায় ব্যতিক্রম। তারা যখন ঈমান আনল তখন আমি পার্থিব জীবনে তাদের উপড় থেকে লাঞ্ছনার আযাব তুলে নিলাম এবং তাদেরকে একটা সময় পর্যন্ত জীবন উপভোগ করতে দিলাম। —সূরা ইউনুস (১০) : ৯৮

হযরত ইউনুস আ. তাঁর কওমকে তাওহীদের দাওয়াত দিলেন এবং তাদেরকে বহুভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলেন; কিন্তু তারা তাঁর দাওয়াতে সাড়া দিল না। বরং তাদের অবাধ্যতা ও সীমালঙ্ঘনে ডুবে থাকল। তখন তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি আসার প্রতিশ্রম্নতি শুনিয়ে দিলেন। হযরত ইউনুস আ. যেহেতু বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাদের উপর তো এখন শাস্তি আসা অবধারিত, তাই তিনি নিজ এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হলেন। তারা হযরত ইউনুস আ.কে যখন খুঁজে পেল না তখন তারা বুঝতে পারল যে, এখন তো আমাদের উপর শাস্তি এসেই যাবে। তাই তারা তাওবা-ইস্তিগফার করতে লাগল। তাদের এ অবস্থা দেখে আল্লাহ তাআলা আর শাস্তি প্রেরণ করলেন না। এভাবে তারা তাওবা ও ইস্তিগফারের ফলে আল্লাহর শাস্তি থেকে বেঁচে গেল।

তাওবা ও ইস্তিগফার মুমিনের পার্থিব নিআমত, শক্তি সামর্থ্য ও যাবতীয় সমৃদ্ধি লাভে সাহায্য করে

কুরআনে ইরশাদ হয়েছে—

আমি বললাম, তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল। তাহলে তিনি তোমাদের প্রতি মুষলধারে বৃষ্টি প্রেরণ করবেন। আর তিনি তোমাদেরকে সম্পদ ও সন্তানাদি বৃদ্ধি করে দেবেন। তিনি তোমাদের জন্য বিভিন্ন উদ্যান ও নদ-নদী সৃষ্টি করে দেবেন। —সূরা নূহ (৭১) : ১০-১২

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে—

হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। অতঃপর তাঁর কাছে তাওবা কর। তিনি তোমাদের প্রতি মুষলধারে বৃষ্টি প্রেরণ করবেন। তোমাদের শক্তিকে আরও বাড়িয়ে দেবেন। আর তোমরা অপরাধী হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিও না। —সূরা হুদ (১১) : ৫২

এভাবে কুরআন মাজীদ তাওবা ও ইস্তিগফারের অনেক ফায়দা ও উপকারের কথা তুলে ধরেছে। তাই আল্লাহ তাআলার ক্ষমা, দয়া এবং দুনিয়া ও আখিরাতে সব দিক থেকে তাঁর সাহায্য লাভ করার জন্য তাওবা ও ইস্তিগফারের বিকল্প নেই।

তাওবা ও ইস্তিগফারের উপকারিতায় রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন—

যে ব্যক্তি বেশি বেশি ইস্তিগফার করবে আল্লাহ তাআলা তার সকল সংকট থেকে উত্তরণের ব্যবস্থা করে দেন, তার সকল পেরেশানী দূর করে দেন এবং তাকে এমন জায়গা থেকে রিযিক দান করেন, যা সে কল্পনাও করতে পারে না। —সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৫১৮

মোটকথা, তাওবা ও ইস্তিগফারের মাধ্যমে একজন মুমিনের দুনিয়া ও আখেরাতের জীবন সর্বাঙ্গীন সুন্দর ও সফল হয়। এর মাধ্যমে একজন মুমিন লাভ করে উভয় জাহানের সমৃদ্ধি। সর্বোপরি তাওবা ও ইস্তিগফারের মাধ্যমে মুমিন আল্লাহ তাআলার নিকটতম বান্দায় পরিণত হয়।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলের সগীরা-কবীরা গুনাহসহ সব ধরনের অন্যায়-অপরাধ ক্ষমা করেন। এবং আমাদেরকে সব ধরনের গুনাহ থেকে তাওবা করার তাওফীক দান করেন— আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন।


প্রজন্মনিউজ২৪/হাসিব

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন





ব্রেকিং নিউজ