কুমার অরবিন্দের গল্প: সেলাই করা জীবন

প্রকাশিত: ০১ এপ্রিল, ২০২৩ ০৫:৫৭:০৬ || পরিবর্তিত: ০১ এপ্রিল, ২০২৩ ০৫:৫৭:০৬

কুমার অরবিন্দের গল্প: সেলাই করা জীবন

সাহিত্য ডেস্ক: সাদিয়ার ভাগ্নে জন্ম নিলে ক্লিনিকে দেখতে গিয়েছিল মৃত্তিকা। কেমন একটা বিদঘুটে গন্ধ নাকে লেগেছিল, বমি পেয়েছিল। সাদিয়া বলেছিল, এটা আঁতুড়ের গন্ধ। ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এখন তার আঁতুড় আঁতুড় গন্ধ লাগে। তবে এখন আর বমি পায় না। তাই অন্যদের মতো নাকে কাপড়চাপা দেয় না। বুক ভরে ডাস্টবিনের আঁতুড়গন্ধ ফুসফুসে টেনে নেয়।

ঈদ এলেই মৃত্তিকার সবচেয়ে বেশি মন খারাপ হয়। এই মন খারাপের কোনো পরিমাপ হয় না। পৃথিবীর কোনো ভাষায় এমন কোনো শব্দ নেই, যা দিয়ে এটা কেউ প্রকাশ করতে পারবে। এমন মন খারাপের দিনে সে একাকী জানালার শিক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দূরের রাস্তা দিয়ে নতুন জামাজুতা পরা ছেলেমেয়েদের চলাচল দেখে, মা-বাবার হাত ধরা শিশুদের দেখে। প্রেমিককে জাপটে ধরা প্রেমিকাকে নিয়ে বাইকগুলো দ্রুত চলে যায় শহরের এমাথা থেকে ওমাথা। শহরে এক ধরনের গুঞ্জরণ ওঠে। এই গুঞ্জরণের মধ্যে হাসি থাকে, আনন্দ থাকে, উচ্ছলতা থাকে, খুশি থাকে। ঈদের দিন ছাড়া এই চাপা গুঞ্জরণ সে আর কখনো শুনতে পায়নি। রাত থেকেই আশেপাশের কোনো বাসা থেকে ভেসে আসেন নজরুল- ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানি তাগিদ।’ কিন্তু ঈদের দিনে মৃত্তিকার মন বিষাদে ভরে থাকে। ফাঁকা হোস্টেলে দূরবর্তী দ্বীপে হারিয়ে যাওয়া কোনো যাত্রীর মতো একাকী সে দেহে ও মনে বিধ্বস্ত হয়। চারপাশে অসংখ্য প্রাণের কোলাহল কিন্তু কথা বলার মতো কোনো মুখ নেই। মোবাইলের হঠাৎ রিংটোনে মৃত্তিকার বিষাদযাপনে ছেদ পড়ে। নিশ্চয়ই নেফাউর কল দিয়েছে!

রমজানের শুরুতেই হলের বান্ধবীদের মধ্যে এক ধরনের প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করে মৃত্তিকা। কে কার জন্য কী কিনলো, তাদের জন্য কে কে কী কী কিনলো এসব নিয়ে কথা হয়। কিনে আনা কাপড়গুলো একে অন্যকে দেখায়। দাম নিয়ে আলোচনা হয়। একটা নীলচে রঙের টি-শার্ট সামনে রেখে সাদিয়া বলে, ‘দেখ তো কেমন হয়েছে?’
মৃত্তিকা শার্টটা হাতে নেয়। অদ্ভুত একটা প্রেম প্রেম গন্ধ পায়। সে জানে কতদিন টিফিন না খেয়ে জমানো টাকায় প্রেমিকের জন্য সে এটা কিনেছে। হাতের ইশারায় মৃত্তিকা জানায় দারুণ হয়েছে। সাদিয়ার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। অন্যদের কিনে আনা কাপড়গুলোও মুখে হাসি নিয়ে উলটেপালটে দেখে। ‘তুই কী কিনলি?’
রিপার প্রশ্নে মৃত্তিকা মুখে ম্লান হাসিটুকু ধরে রেখেই ডানেবামে মাথা নাড়ে। তার জন্য কেউ কিছু কিনে প্রতীক্ষা করে না, সেও কারোর জন্য প্রতীক্ষায় থাকে না। শুধু একজনের জন্য থাকে বোধহয়। মাঝেমধ্যে তাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে।

মৃত্তিকাকে সবাই একটু নাকউঁচু স্বভাবের জানে। কোনো ছেলেকেই সে সহ্য করতে পারে না। কাছে ঘেঁষতে চাওয়া বা বন্ধুত্ব করতে চাওয়া কোনো ছেলেকেই সে পাত্তা দেয় না। বরং তীক্ষ্ম কথার বাণে তাদের বিদ্ধ করে। অনেক ছেলে মৃত্তিকার এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে পছন্দও করে। যাকে সহজেই পাওয়া যায়, তাকে পাওয়ার মধ্যে কোনো আনন্দ নেই, কৃতিত্বও নেই। অজেয় হৃদয়কে ভালোবাসা দিয়ে জয় করা যুদ্ধ জয়ের মতোই অথবা তার চেয়েও বেশি মাহাত্ম্যপূর্ণ। কোনো কোনো গুণগ্রাহীর এমন দার্শনিক কথাবার্তা সাদিয়ার কানেও আসে। কিন্তু তার হৃদয়রাজ্যের চারপাশে ব্যক্তিত্বের চীনের প্রাচীর। সেটি ভেদ করা প্রায় অসম্ভব। তবু যারা সেটি জয় করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে নেফাউর তাদের মধ্যে অন্যতম।

নেফাউর পাত্তা না পেয়ে অন্য বান্ধবীদের শরণাগত হয়। সাদিয়া, রিপা, সোমাকে দিয়ে ওকালতি করায়। কিন্তু কারো কথা কানে নেয়নি মৃত্তিকা। বরং বিষয়টা নিয়ে বান্ধবীদের সঙ্গে তার মনোমালিন্য হয়। সাদিয়ারাও এই চার বছরে বুঝে গিয়েছে মেয়েটা একটু অন্যরকম। সবার চেয়ে আলাদা। ক্লাস, লাইব্রেরি, বই ছাড়া আর কিছু বোঝে না। এমন নিরামিষ মেয়ে এই যুগে আর আছে নাকি?

মৃত্তিকা ছুটিতে কখনো বাড়ি যায় না। না ঈদে, না পূজায়। নানা অজুহাত দেখিয়ে সে শিক্ষা সফরেও যেতে চায় না। বন্ধুদের প্রবল চাপে শিক্ষা সফরে না যাওয়ার কারণ হিসেবে বলেছিল তার টাকা নেই। কিন্তু সবাই জানে দিনের বেশিরভাগ সময় সে টিউশনির পেছনে ব্যয় করে। বন্ধুরা মিলে টাকা দিতে চাইলে সে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। অন্যের টাকায় আনন্দ করার ইচ্ছে তার নেই। তার বাড়ি কোথায় কেউ জানে না। তবে মাঝেমধ্যে কোথাও যায়, সকালে বেরিয়ে সন্ধ্যা নাগাদ ফিরে আসে।

সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষার আগে নেফাউর মৃত্তিকার সাহায্য চায়। ক্লাস শেষে বা অন্য কোনো অবসর সময়ে সে যদি তাকে একটু দেখিয়ে দিতো। মৃত্তিকা বুঝতে পারে এটা নেফাউরের ঘনিষ্ঠ হওয়ার উপলক্ষ। সে নেফাউরকে সাফ জানিয়ে দেয় তার অত সময় নাই। নেফাউর নোটস চাইলেও দিতে অস্বীকৃতি জানায়। পরীক্ষায় ভালো করার জন্য সে শিক্ষকের সাহায্য নিতে বলে।

মৃত্তিকার এই ঘটনায় খুব ব্যথিত হয় নেফাউর। সে দেখতে সুন্দর, ব্যবসায়ী বাবার একমাত্র সন্তান। ঢাকা শহরে বাড়ি আছে। ক্যাম্পাসের যে কোনো মেয়েকে পটানো তার জন্য কোনো ব্যাপার না। কিন্তু এই মেয়ে তাকে পাত্তাই দেয় না! সে ক্ষেপে গিয়ে বলে, ‘কী এমন বিশ্বসুন্দরী হয়েছ? তুমি এক ধরনের ফেক অহংকার আর দেমাগ নিয়ে চলো। তুমি যে প্রায়ই রুম ডেটে যাও; সে খবরও তো আমরা জানি। তোমার মতো অসামাজিক মেয়ের পেছনে এতদিন শুধু শুধু সময় নষ্ট করেছি।’ মৃত্তিকার সহজে চোখে পানি আসে না। এক ক্লাস বন্ধু-বান্ধবীর সামনে আজ এলো।

বিকেলে টিউশন থেকে ফেরার পথে নেফাউরের সাথে দেখা হয়। নেফাউরের হাতে ঈদের শপিং ব্যাগ। অন্যদিন হলে নেফাউরই তাকে ডাকত, ফান করত। আজ কিছুই না করে মৃত্তিকাকে না দেখার ভান করে চলে যায়। মৃত্তিকা তাকে পেছন থেকে ডাকে। অবাক হয় নেফাউর। তোমার যদি হাতে সময় থাকে তাহলে চলো একটু বসি।

মৃত্তিকার জন্য নেফাউরের হাতে অফুরন্ত সময়। সকালে মৃত্তিকাকে যতটা খারাপ ভেবে কথাগুলো শুনিয়েছিল এখন অতটা খারাপ মনে হচ্ছে না। তাকে এখন অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। চোখ দুটো আরও বেশি গাঢ়, মুখটা আরও উজ্জ্বল। চাহনির মধ্যে আগের কর্কশতা নেই কোমলতা আছে, কাঠিন্য নেই মায়া আছে। এই মেয়েকে সে অহংকারী বলেছিল! ছি, নেফাউর ছি।
আত্মধিক্কারের শব্দ শুনতে পায় নেফাউর।
আমার কথা শুনতে পারছো? মৃত্তিকার কথায় তার মোহভঙ্গ হয়।

তারা ক্যাম্পাসের মাঠে গিয়ে বসে। মৃত্তিকা কোনো ভূমিকা না করেই বলতে থাকে, আজ তুমি আমাকে অনেক কথা বলেছ। আমার কিছু কথাও তোমার শোনা উচিত। তুমি আমাকে ভালোবাসো এটা তুমি যেমন বলেছ, অন্যদের দিয়েও অনেকবার বলিয়েছো।

নেফাউর কিছু না বলে শুনতে থাকে। পায়ে দলা ঘাসের দিকে তাকিয়ে মৃত্তিকা বলে, সত্যি কথা বলতে আমি কোনো ছেলেকেই বিশ্বাস করতে পারি না। তোমাদের প্রেমের প্রতি আমার সীমাহীন ঘৃণা জড়ো হয়ে আছে। আমি জানি প্রেমের উৎসস্থল শুধু মন নয়, শরীরও। কিন্তু তোমরা মনকে অগ্রাহ্য করে শুধু শরীরটাকেই পাখির চোখে দেখো। শরীরের প্রতি শরীরের আকর্ষণই তোমাদের কাছে শেষ কথা। তারপর...

কিছুক্ষণ নীরব থাকে মৃত্তিকা। নেফাউর কী বলবে বুঝতে পারে না। সে কেমন করে বোঝাবে সে অন্যদের মতো নয়। মৃত্তিকার গলা ধরে আসে। আমি তোমাদের এই সমাজকেও বিশ্বাস করতে পারি না। সবাই স্বার্থপর! নিজের সুখের জন্য সবাই যা ইচ্ছে তাই করতে পারে, বলতে পারে। এতে অন্যের কতটুকু ক্ষতি হলো তা সে বুঝতে পারে না।

বছর দুয়েকের এক মেয়ে একটা গোলাপ ফুল নিয়ে টলতে টলতে মৃত্তিকার সামনে আসে। মেয়েটার আলগা গায়ে ধুলাবালি লেগে আছে, পরনের প্যান্ট শতচ্ছিন্ন। আশেপাশে তাকিয়ে মৃত্তিকা মেয়েটির মাকে খোঁজে। কিন্তু তেমন কাউকে চোখে পড়ে না। আছে হয়তো কোথাও, হয়তো নেই। ফুলটা নিয়ে সে মেয়েটির হাতে বিশ টাকার একটা নোট দেয়। মেয়েটি আবার টলতে টলতে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যায়। নেফাউর লোভি চোখে ফুলটার দিকে তাকিয়ে থাকে- হাত বদলের অপেক্ষায়। কিন্তু ফুলটা স্থানান্তরিত হয় মৃত্তিকার ভ্যানেটি ব্যাগে।

আমার অতীত জানলে আমার প্রতি তোমার যে মুগ্ধতা আছে তা আর থাকবে না। একটু শ্বাস টেনে নেয় মৃত্তিকা। অনেকক্ষণ নীরব থাকার পর মুখ খোলে নেফাউর, ‘তুমি নিঃসঙ্কোচে সব কথা বলতে পার।’

আমার বয়স যখন একদিন, দুইদিন বা কয়েকঘণ্টা তখন আমাকে ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন এক সুইপার। আমার গায়ে তখন পিঁপড়ার কামরের ছোপ ছোপ দাগ। ক্ষুধায় অচেতন, কান্নারও শক্তি ছিল না। আমি কুকুর-শেয়ালের পেটে যেতে পারতাম। কিন্তু পৃথিবীতে আমার যে আরও বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হবে, অত অল্পতে আমার মুক্তি নেই। পরে আমার ঠাঁই হয় এক এতিমখানায়। আমি সেখানেই বড় হই, তাদের সহায়তায় লেখাপড়া করি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই।

আমি যে এত টিউশনি করি, তার অনেকটাই সেই এতিমখানায় দিতে হয়। তাদের প্রতি আমার দায়বদ্ধতা আছে। মাঝেমধ্যে সেখানে যেতেও হয়- তোমরা যেটাকে রুম ডেট ভাবো!
   
লজ্জায় মুখ লাল হয় নেফাউরের। কারোর কাছে আমার কোনো জবাবদিহিতা নেই, কারোর কাছে আমার কিছু প্রমাণ করার নেই। তোমার কাছেও নেই। তবুও লুকিয়ে রাখা কথাগুলো তোমাকে কেন বলছি জানি না, মৃত্তিকা বলতে থাকে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। নিজের একটা আইডেনটিটি তৈরি হচ্ছে। তবু আত্মপরিচয় নিয়ে এক ধরনের হীন্মন্যতায় ভুগি। আমায় যারা জন্ম দিয়েছিল, তারা দেখতে হয়তো মানুষের মতো ছিল, কিন্তু মানুষ ছিল না। তাই তাদের অবাঞ্ছিত সন্তান হিসেবে নিজেকেও মানুষ মনে হয় না। আমি শুধু একটা প্রাণ ধারণ করে আছি। অন্য প্রাণীর সাথে আমার তেমন কোনো পার্থক্য নেই।

আমার মা-বাবার ধর্ম কী ছিল আমি জানি না। মুসলিম রীতিনীতি মেনে বড় হয়েছি বলে আমি মুসলিম। আমি ঈদে বা বড় কোনো ছুটিতে কোথাও যাই না কেন এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ? আমার যাবার কোনো জায়গা নেই। আমার কোনো ঈদ নেই, পার্বণ নেই, উৎসব নেই।

এতকিছু জানার পর তুমি বা তোমরা বা তোমাদের সমাজ আমাকে নিজের করে নিতে পারবে না। তাই নিজের মধ্যেই নিজেকেই লুকিয়ে রাখি। তোমরা আমার চেয়ে আলাদা। আমার জন্মদাত্রীকে হয়তো তোমার মতো কোনো এক পুরুষ হয় প্রলোভন দেখিয়ে, নয় তো জোর করে...। যারা আমার জন্মের কারণ তারা আমাকে স্বীকৃতি দিতে পারেনি, তোমরা পারবে কী করে? এজন্য বন্ধু বলে তোমরা যারা আমার কাছে আসতে চাও, প্রেম নিবেদন করতে চাও তাদের আমার বেশি ভয় হয়। তখন আমার মনে না পড়া মায়ের মুখটা মনে পড়ে। আমি বিস্মিত হয়ে দেখি সে মুখটা আমার নিজেরই।

দুই.
শাড়ি চারটা হাতে নিয়ে দোয়েল চত্বরের দিকে এগোতে থাকে মৃত্তিকা। টিউশনির টাকা জমিয়ে প্রতি ঈদে একটা করে শাড়ি কিনেছে সে। প্রতীক্ষায় থেকেছে দৈবক্রমে যদি কখনো মায়ের সঙ্গে দেখা হয়।

সেদিন ডাস্টবিনে ফেলে যাওয়ার সময় মায়ের চোখে কি পানি জমেছিল? মেয়েকে কিছুতেই ফেলবে না বলে কি প্রতিবাদ করেছিল? মেয়েটা নিশ্চিত মরবে বা বেঁচে থাকলেও মরার মতোই বেঁচে থাকবে এটা ভেবে কি তার বুক কেঁপেছিল?

আজ মৃত্তিকারও একটা শাড়ি পরতে ইচ্ছে করছিল। যদিও এমন অনেক ইচ্ছা থেকে প্রতিনিয়তই সে নিজেকে বঞ্চিত করে। মুহূর্তেই চারটা শাড়ি দেওয়া শেষ হয়ে গেলো। আরও অসংখ্য হাত তার দিকে এগিয়ে আসছে। এদের মধ্যে কি তার মায়ের হাতটা আছে? মৃত্তিকা নিরুপায় দাঁড়িয়ে থাকে। তার হাতও অন্যদের মতোই, শূন্য। সেও কি তাদের মতো হাত বাড়াবে, মা মা বলে।

এখন আর মৃত্তিকা হলে যাবে না। এতিমখানায় যাওয়ার কথা ছিল। সেখানেও যেতে ইচ্ছে করছে না। সে আজ শহরের ডাস্টবিনগুলো দেখবে। জন্মের পর নবজাতক ও মাকে আঁতুড়ঘরে আলাদা করে রাখা হয়। একটা ময়লা কাঁথায় জড়িয়ে তাকে পুরো পৃথিবী থেকেই আলাদা করে ডাস্টবিনে ফেলে গিয়েছিল। আজ সে খুঁজে ফিরবে তার আঁতুড়ঘর। যার সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি নেই, জন্মের পর তার গা পরিষ্কার করার কথা কেউ ভাবেনি। তাই সারিবদ্ধভাবে পিঁপড়ার দল এসেছিল।

নিজের অতীতবৃত্তান্ত মৃত্তিকা শুনেছিল এক বৃষ্টির দিনে। তার ভেতরেও তখন ঝড়-জল-বৃষ্টি। তারপর থেকে ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মৃত্তিকা কখনো নাকে কাপড় চাপা দেয়নি। বরং বুক ভরে গন্ধটা টেনে নেয়। ডাস্টবিনে পড়ে থাকার সময় তার শরীরেও আঁতুড়ের গন্ধ ছিল। এখন কি তার শরীরে ডাস্টবিনের গন্ধ? ডান বাহুতে নাক রেখে শ্বাস টানে।

মৃত্তিকার এই বাইশ-তেইশ বছরের জীবনকালকে বিচ্ছিন্ন মনে হয়। ছিঁড়ে যাওয়া কাপড়ের মতো ছিন্ন-ভিন্ন। সময়গুলোকে সে একই সুতায় সেলাই করে পেছনের জীবনটাকে সামনে এনে দাঁড় করায়। সুখকর কিছু দেখতে পায় না। সে হাঁটতে থাকে।

মুঠোফোনটা অনবরত বেজেই চলছে। এতিমখানা থেকে হয়তো...। ঈদের জন্য টাকা তো পাঠিয়েছেই। আবার কেন এতবার কল করছে? ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে নেফাউর! রিসিভ করে না। একটা টেক্সট পাঠায়, ‘আমি তোমার হলের সামনে। আমার সাথে আব্বু-আম্মুও আসছেন। তুমি এসো প্লিজ।’

নেফাউরকে অবহেলা করতে পারত মৃত্তিকা। কিন্তু ওর মা-বাবাকে নয়। সে একটা রিকশা নিয়ে হলের সামনে আসে। রিকশা থেকে নামতেই তাকে নেফাউরের মা জড়িয়ে ধরতে ধরতে বলেন, ঈদ মোবারক। পৃথিবীর সব মানুষ এক হয় না, মা। আমরা তোমার সব কথাই নেফাউরের কাছ থেকে শুনেছি। আমাদের ছেলের বউ হতে যদি তোমার আপত্তি থাকে তাহলে দরকার নেই, কিন্তু আমাদের মেয়ে হতে নিশ্চয়ই তুমি আপত্তি করবে না? তিনি মৃত্তিকার থুতনিতে হাত ছুঁয়ে নিজের ঠোঁটে ছোঁয়ান। গাড়িতে ওঠো, আমাদের সঙ্গে আজ তুমি ঈদ করবে।

মৃত্তিকা কিছু না বলে পেছন ফিরে হলের দিকে যেতে শুরু করে। নেফাউরের মাকে জড়িয়ে ধরার সময় নাকে যে আঁতুড় আঁতুড় গন্ধটা লেগেছিল, এখনো সেটা নাকে লেগেই আছে।


প্রজন্মনিউজ২৪/জেড আই

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন





ব্রেকিং নিউজ