মায়ের হাতের ইফতারির জন্য এখন আর কে অপেক্ষা করে!

প্রকাশিত: ২৪ মার্চ, ২০২৩ ০৬:১০:১৭

মায়ের হাতের ইফতারির জন্য এখন আর কে অপেক্ষা করে!

রমজানে ইফতারি মানে পরিবারের সবাইকে নিয়ে এক টেবিলে বসে খাবারের আয়োজন, যা রোজার মাসে একরকমের প্রতিদিনকার উৎসব। প্রতিটি ঘরে ইফতারির প্রধান কারিগর হিসেবে থাকেন ঘরের কর্ত্রী, সন্তানের মা।

সময়ের পরিক্রমায় বাঙালি সংস্কৃতির এই ইফতার আয়োজনে এসেছে বড় রকমের পরিবর্তন। নব্বইয়ের দশকেও যেখানে ইফতার মানে পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে পানাহারের মাধ্যমে রোজা ভাঙা, সেখানে বর্তমান সময়ে এসে প্রতিদিনকার এ আয়োজন হয়ে গেছে কালেভদ্রের একরকমের দায়িত্ববোধের থেকে অংশগ্রহণমূলক সংস্কৃতি।

মিরপুরের পাইকপাড়ার ষাটোর্ধ্ব গৃহিণী শায়লা বেগম তার সময়কার ইফতারির আয়োজনের বর্ণনা দিতে গিয়ে গণমাধ্যম কে বলেন, ‘বাচ্চারা তখন ছোট ছিল। দুজন স্কুলে পড়ত, একজন কলেজে। আমার স্বামী ছিল সরকারি কর্মকর্তা। রোজার দিনে এমনিতেই বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ থাকত। আসরের পর থেকেই শুরু করতাম ইফতারির আয়োজন। পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ, ছোলা ভাজার গন্ধে সারা ঘর ভরে যেত। বড় ছেলে ওর ভাইদের নিয়ে শরবত বানাতো। শেষ বেলার দিকে ওদের বাবা ফিরত, হয়তো হাতে হালিম কিংবা দই নিয়ে। ইফতারির টেবিলে মুখে খেজুর আর শরবত দিয়ে বাচ্চারা যেত ভাজাপোড়া খেতে। আবার আজানের আগে একটেবিলে বসে সবাই মিলে মোনাজাত করা। এটা ছিল প্রতিদিনকার নিয়ম। রোজার প্রতিদিনের ইফতারিই ছিল উদ্‌যাপনের মতো।’

এখনকার ইফতারি কেমন হয় জানতে চাইলে শায়লা বলেন, ‘এখন বাচ্চারা বড় হয়েছে। যে যার বাসায় স্ত্রী নিয়ে থাকে। আমি আর আমার স্বামী দুজন মাত্র মানুষ ইফতারি করি। ওরা হয়তো মাঝে মধ্যে আসে। তাও একসঙ্গে সবাই আসে না। টেবিলের বাকি চেয়ারগুলো শূন্য পড়ে থাকে। এখন আর আগের মতো অত বড় আয়োজনও করি না। মায়ের হাতের রান্না তখনই সার্থক যখন বাচ্চারা সে রান্না খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে। ওরা এখন রেস্টুরেন্টে খায়, বাইরে থেকে ইফতারি নিয়ে আসে।’

মায়ের হাতের রান্নার কথা বলতে গিয়ে সরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা আহমেদ সাদেক বলেন, শুধু ইফতারি কেন, একসময় বাসায় অলিখিত নিয়মই ছিল রাতে সবাই একটেবিলে বসে খেতে হবে। ছোটবেলায় মা যখন নতুন কিছু রান্না করতো, ইফতারিতে নতুন আইটেম করতো, কী প্রবল আগ্রহ নিয়েই না অপেক্ষা করতাম, রান্নাঘরে ঘুর ঘুর করতাম। সেই যে মায়ের হাতের রান্নার একটা আমেজ ছিল, সেটি কোথায় যেন হারিয়ে গেল। আমার বাচ্চাদের মধ্যে মায়ের হাতের রান্না নিয়ে এখন আর সেই উদ্দীপনা কাজ করে না। ওরা বাইরের খবারই পছন্দ করে। অন্যদিকে আমার স্ত্রীও রান্না করাটা একটি বাড়তি ঝামেলা মনে করেন।’

এ যুগের ছেলেমেয়েরা মায়ের হাতের রান্নার চেয়ে হোটেল-রেস্টুরেন্টে খেতে কেন পছন্দ করে তা জানতে এ প্রজন্মের কয়েকজনকে প্রশ্ন করা হয়। তারা জানান, প্রথমত এটা ইতিবাচক যে বাসায় মা-বাবাকে ঝামেলা করতে হচ্ছে না। আর ইফতারিতে বাইরের রেস্টুরেন্টে যতসব আইটেম থাকে প্রতিদিন বাসায় অত আইটেমও থাকে না। এ ছাড়া অনেক সময় ইচ্ছা থাকলে পড়াশোনা-অফিসের কাজের কারণে বাসায় ইফতারি করা হয়ে ওঠে না।

বর্তমান প্রজন্মের এ মনোভাব নিয়ে আগের প্রজন্মের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, দিনকে দিন এ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা রেস্টুরেন্টকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। ইফতারিতে তারা হয়তো ব্যস্ত থাকে মেনে নেয়া যায়, কিন্তু কী দুঃখে সেহরি বাইরে করে, এটা একটা বড় প্রশ্ন।

এদিকে রোজা এলে রাজধানীসহ দেশের জেলা পর্যায়ের ছোট বড় সব রেস্টুরেন্টে শুরু হয় নানা ধরনের লোভনীয় অফার। এসব অফারের মোহে পড়ে তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ তাদের জীবনকে করে ফেলেছে রেস্টুরেন্টকেন্দ্রিক। বুফে, বাই ওয়ান গেট ওয়ান, স্পেশাল প্লাটার, গ্রেট কম্বো, আনলিমিটেড পিৎজা অ্যান্ড সফট ড্রিংকসের মতো অফারগুলো সারাদিন রোজা রেখে কতটা স্বাস্থ্যকর ও ধর্মীয় বিবেচনায় কতটা আদর্শিক সেটিও প্রশ্ন অনেকের মনে।

বর্তমান প্রজন্মের বাইরের ইফতারির ঝোঁক কতটা স্বাস্থ্যসম্মত জানতে চাইলে বারডেম জেনারেল হাসপাতালের খাদ্য ও পুষ্টি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান পুষ্টিবিদ শামসুন্নাহার নাহিদ সময় সংবাদকে বলেন, ‘একজন মানুষ যদি সারাদিন না খেয়ে ইফতারি শুরু করে সফট ড্রিংকস দিয়ে, এরপর পিৎজা বা পাস্তার মতো এমন ভারী খাবার খায় সন্দেহাতীতভাবে তা অস্বাস্থ্যকর। বাইরে যারা বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ইফতারি করছেন তারা অনেক সময় পানির বদলে ইফতারি শুরুই করেন কার্বনেটেড পানীয় দিয়ে, যা রক্তে সুগ্যারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এ থেকে হচ্ছে ডায়াবেটিকস কিংবা হরমোনাল ডিজঅর্ডারের মতো মারত্মক রোগ। অন্যদিকে সফট ড্রিংকসের পর ভারী খাবার হিসেবে পিৎজা বা পাস্তা খাওয়াও স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এসব খাবারে থাকা চিজ ও মেয়োনিজ শরীরের ফ্যাটের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় যা যকৃৎ ও হৃদরোগের কারণ। এসব ছাড়াও বাইরে যে ভাজাপোড়া খাওয়া হয় সেগুলো মূলত বাসি ও পুরনো তেলে ভাজা। সারাদিন না খেয়ে এসব খাবার খেলে শরীরে মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে।’

স্বাস্থ্যের দিক থেকে আদর্শ ইফতার কী জানতে চাইলে শামসুন্নাহার বলেন, ‘যুগ যুগ ধরে আমাদের বাসা-বাড়িতে যে ইফতারির আইটেমগুলো তৈরি হচ্ছে সেটিই আদর্শ ইফতার। শুরুতে পানি কিংবা ফলের জুস আপনার পানিশূন্যতা কমিয়ে দিচ্ছে। এর পর চিড়া, মুড়ি, কলা কিংবা স্যুপ জাতীয় তরল খাবার শরীরকে সতেজ করছে। ইফতারির আইটেমে থাকা নানা ধরনের ফল শরীরে শক্তি যোগাচ্ছে, ফাইবারগুলো হজমে সাহায্য করছে। এমনকি বাসার ভাজাপোড়াও খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। ছোলা-মুড়ি সারাদিনের কার্বোহাইড্রেট ও প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম।’

ধর্মীয় জায়গা থেকে গোগ্রাসে এভাবে ইফতারি করা ও রোজার মাহাত্ম্য নিয়ে ইসলামি চিন্তাবিদ মুফতি মুহম্মদ ইবনে ফয়সাল রিমন বলেন, ‘রমজান হচ্ছে সংযমের মাস। এই মাসে পানাহার থেকে বিরত থেকে আপনি নিজেকে পরিশুদ্ধ করবেন- এমনটাই রোজার মাহাত্ম্য। একদিকে আপনি বাসায় ইফতারি করলেন না, আপনার বাবা-মা মনে কষ্ট নিয়ে একা একা ইফতারি করল, অন্যদিকে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে হৈ-হুল্লোড় করে আপনি রেস্টুরেন্টে ইফতারি করলেন, ইচ্ছামতো পেট পুরে গলা অবধি খাবার খেলেন; দিন শেষে না আপনি রোজার মাহত্ম্য বুঝলেন, না বাবা-মাকে খুশি রাখতে পারলেন, না নিজের সংযম দেখাতে পারলেন, না সৃষ্টিকর্তা আপনার রোজায় খুশি হলো। সর্বোপরি আপনি পানাহার না করে একরমের উপোস থাকলেন। রোজা রাখা আর উপোস থাকার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত।’

বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে পারিবারিক বন্ধন দিনকে দিন কেন ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে, একটেবিলে বাবা-মায়ের সঙ্গে বসে খাবার হাওয়ার আগ্রহ কালক্রমে কেন কমে যাচ্ছে এসব বিষয়ে গণমাধ্যম কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সাদেকা হালিমের সঙ্গে।

তিনি বলেন, ‘আমরা এমন একটি পুঁজিবাদী সমাজে বাস করছি যেখানে আমরা নিজেদের নিয়েই সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত। ভোগেচ্ছু এই জীবনে আমরা নিজেদের এতটাই আলাদা করে ফেলেছি যে আগেকার সেই বন্ধনগুলো এখন আর আমাদের কিংবা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে শক্ত কোনো অর্থ বহন করে না।’

এ দায় কার- এমন প্রশ্নে সাদেকা হালিম বলেন, ‘দায় মূলত দুই পক্ষেরই। বর্তমান বাবা-মায়েরা সন্তানদের সময় দিতে পারেন না, সন্তানদের সঙ্গে নিজেদের বন্ধনকে পাকাপোক্ত করার সময়টুকু তাদের হাতে নেই। অন্যদিকে বর্তমান প্রজন্মও অনেকটা সম্পর্কবিমুখ। পশ্চিমারা যেভাবে ১৮ বছর বয়সে সন্তানকে স্বাবলম্বী করতে বাসার বাইরে বের করে দেয়, আমাদের দেশের এটা না হলেও সন্তানদের ভেতরে এই একা থাকা, নিজের স্পেস নিয়ে থাকা কিংবা একান্ত নিজের মধ্যে কিংবা নিজের সার্কেলের মধ্যে থাকার প্রবণতা দিনকে দিন বেড়ে যাচ্ছে। এতে করে সেই যে আগে একসঙ্গে বসে ইফতারি করা কিংবা রাতের খাবার খাওয়ার মতো সংস্কৃতি দিনকে দিন হারিয়ে যাচ্ছে।’


প্রজন্মনিউজ২৪/একে

এ সম্পর্কিত খবর

দেওয়ানগঞ্জে মেয়র এর নির্দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার অভিযোগ

সিংড়ায় চলনবিলে সরকারী খাল দখলমুক্ত হওয়ায় মাছ ধরলো শত শত মানুষ

হাবিপ্রবিতে ল্যাব টেকনিশিয়ানদের জন্য দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মশালা

পবিপ্রবিতে ইফতার মাহফিল ও দুঃস্থদের মাঝে ইফতার সামগ্রী বিতরণ

ধর্ষনবিরোধী আন্দোলনের মুখে জাবি প্রক্টরের পদত্যাগ

রাবি ভর্তি পরীক্ষায় 'কম নম্বর দেওয়ার' অভিযোগ ভিত্তিহীন; সংবাদ সম্মেলনে সমন্বয়ক

লন্ডনে গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ হারালেন বাংলাদেশি নাট্যনির্মাতা

অবন্তিকার আত্মহত্যা: শিক্ষক ও সহপাঠী রিমান্ডে

সমুদ্রে ভাসমান অদ্ভুত এক রেস্তোরাঁ!

তিনদিন ছুটির পরেও যানজটে রাজধানীবাসী

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ