স্মৃতির মিনারে তুমি চির অম্লান

প্রকাশিত: ১০ মার্চ, ২০২৩ ০৫:৩৯:৪৮

স্মৃতির মিনারে তুমি চির অম্লান

আল গিফারী, সাতক্ষীরা প্রতিনিধিঃ মাওলানা এ এম রিয়াছাত আলী বিশ্বাস ১৯৩৭ সালে ২৮ ডিসেম্বরে আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের কুড়িকাহুনিয়া গ্রামের এক সমভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে সুবেহ সাদিকের সময় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মৃত জনাব আলী বিশ্বাস ও মাতা মৃত রাহিলা খাতুন।

ছাত্র জীবন
এ এম রিয়াছাত আলী বিশ্বাস ১৯৪৬ সালে শ্যামনগর উপজেলার পাতাখালী মাদরাসা থেকে ৮ম শ্রেণী ও ১৯৪৮ সালে একই মাদরাসা থেকে দাখিল পাস করেন। ১৯৫০ সালে বাগেরহাট জেলার সোনাতুনিয়া ফাজিল মাদরাসা থেকে আলিম ও ১৯৫২ ফাজিল পাস করেন। তিনি ১৯৫৪ সালে বরিশাল ছারছীনা দারুসসুন্নাত আলিয়া কামিল মাদরাসা থেকে হাদিসের ওপর কামিল ডিগ্রি অর্জন করেন।

রাজনৈতিক জীবন
মাওলানা এ এম রিয়াছাত আলী বিশ্বাস ১৯৫৮ ও ১৯৬৩ সালে প্রতাপনগর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য এবং ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন। ইউপি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে তিনি রাষ্ট্রীয় স্বর্ণ পদক লাভ করেন। তিনি ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মনোনয়নে সাতক্ষীরা-৩ (আশাশুনি, দেবহাটা) আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য ও ২০০১ সালে চার দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে একই আসন থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় তিনি বাংলাদেশ সরকারে অর্থ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন।

মাওলানা এ এম রিয়াছাত আলী বিশ্বাস বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম সুন্দরবন উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা। ২২ লক্ষ জনবসতি সম্পন্ন জেলাটি যাদের হাত ধরে ফুলে ফলে সৌরভ ছড়িয়েছেন তার মধ্যে সাবেক এমপি এ এম রিয়াছাত আলী বিশ্বাস অন্যতম। মুসলিম-হিন্ধু, গরীব-দুঃখী, মেহনতী  মানুষের আস্থা ও ভরসার শেষ ঠিকানায় পরিণত হয়ে ছিলেন এ এম রিয়াছাত আলী বিশ্বাস। তাঁর অদম্য সাহস, সততা, নীতি, আদর্শ, দেশাত্ববোধ ও মানুষের  প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা, শিক্ষা, খেলাধুলা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অবহেলি জেলাবাসির কাছে এক কিংবদন্তি নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

পরিবার থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে তাঁর অনন্য অবদানের কথা দলমত নির্বিশেষে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণে রাখবে। এম রিয়াছাল আলী বিশ্বাস সফল কৃতিত্বের গভীরে এক প্ররণাময় জীবন উপহার দিয়েছেন। মানুষের হৃদয়ের অকৃত্তিম ভাল বাসার ঝর্নাধারা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন এ এম রিয়াছাত আলী বিশ্বাস। তিনি একাধারে সংগঠক, সমাজ সেবক, জনদরদী, সমাজ হিতোষী, গরীবের বন্ধু সম্বলহীনার অবলম্বন, অসহায়ার সহায়, মানুষ কে কাছে টেনে আপন করে নেওয়ার চুম্বক রশ্মি।

শুধু সাদা মনের আলোকিত মানুষই ছিলেন না! তিনি ছিলেন প্রস্ফুটিত গোলাপ, যার সৌরভে আমোদিত হননি এমন মানুষের সংখ্যা খুজে পাওয়া দু:স্করই হবে বলে আমার দৃড় বিশ্বাস। শাহাদাতের প্রেরনায় উজ্জীবিত যে মানুষটি ছিলেন লাখো ফুলের সৌরভে সদা সুরভিত। তাঁর জীবন আলখ্যে কলমের খোচা দিয়ে মালা তৈরি করা সত্যিই এক দূর্লভ প্রয়াস। যার কথা মনে পড়লে আশা- নিরাশায় দোলায় ছন্দ পতন ঢেউয়ের তালে । সঞ্চয় করা সমস্ত শক্তির পুস্পগুলো যেন বারে বারে মুখ থুবড়ে ঝরে পড়ে যায়, অচেনা এক বেদনায়। দেখতে দেখতে দক্ষিণ বাংলার মহানায়ক এ এম রিয়াছাত আলীর অনন্তযাত্রার সাতটি বছর গত হয়ে গেল। সময়ের পরিক্রমায় একেবারে কম নয়। উপকূল বাসির শ্রেষ্ঠ সংস্কারক, সুদক্ষ রাষ্ট্রনীতিবিদ, ইসলামী সংগঠনের নির্মাতা, লাখো কোটি মানুষের শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি এ এম রিয়াছাত আলী।

হাজারো স্মৃতির হাতছানি প্রেরনা দৃপ্ত উত্তাল তরঙ্গ মালাই শুধু সৃষ্টি করেনি, সাথে সম্ভাবনার ঊষঞ্চ আলিঙ্গনে যাদু মাখা পরশ বুলিয়ে দিয়ে ছিলেন সাতক্ষীরা বাসিকে। এক নিগুঢ মাইল ফলক হিসেবে বৈরী, অপ্রিয়, প্রতিকুল আর কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি ময়দানের চ্যালেঞ্জ, মোকাবেলায়ও উদ্দ্যোমী আর সাহসী ভুমিকা পালনে আমাদের  মাঝে প্রেরণা যুগিয়েছিলেন।

তিনি এখন তার প্রভু মহানের একান্ত সান্নিধ্যে, স্বর্গের বাগিচায় সবুজ পাখি হয়ে ডানা মেলে উড়বেন এমনটাই আশা করছেন তার ভক্তরা। যিনি সর্বদায় ছিলেন শাহাদাতের তামান্নায় ব্যাকুল, কবির ভাষায় "মরতেই হবে যখন শহিদী মরন দিও আমাকে" যে মৃত্যুর জন্যে তিনি আকাংখিত ছিলেন, যার জন্যে সদা প্রস্তুত ছিলেন, যার মোলাকাতের নেশায় প্রবল পেরেশানীতে উদগ্রীব থাকতেন। যা ছিল মরহুম এ এম রিয়াছাত আলীর চরম ও পরম পাওয়া। তার কীর্তি ও কর্ম এ দেশের মানুষের মণিকোঠায় আসন গেড়ে বসে আছে। সময় চলে যাবে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম আসবে, কিন্তু ইতিহাস জানিয়ে দেবে এ মানুষটির কথা; যিনি পেয়েছিলেন মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা। যার বিনিময়ে তিনি আশাশুনি উপজেলা তথা সাতক্ষীরাকে সাজিয়ে দিয়েছেন উন্নয়ন-সমৃদ্ধি আর সংস্কারের তুলি দিয়ে।

মৃত্যু
ইহকালীন জগত থেকে পরকালীন জগতের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন ২০১৬ সালের ১০ মার্চ বৃহস্পতিবার অনুমানিক বেলা ১০টা ৫৫ মিনিটে  বার্ধক্যজনিত কারণে হৃদরাগে আক্রান্ত হয়ে আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের পিতৃ ভূমিতে এ এম রিয়াছাত আলী বিশ্বাস ইন্তেকাল করেন। "ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন" ৮৪ বছর বয়সে তিনি ৩ ছেলে ৫ মেয়েসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে যান।

মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে পৃথিবীর সফর শেষ করেছিলেন। সেই দিনের সেই জানাজার নামাজের পূর্বেকার কথা আজও স্মরণ রাখারমত। লোকে লোকারন্ন। জানাজায় অংশ না নিয়ে রাস্তার পাশে বসে দু'চোখের অশ্রুতে বুকভাসিয়ে ফেলতে দেখলাম কয়েকজনকে। জানতে চাইলাম, জানাজায় অংশ না নিয়ে কাঁদছেন কেন। কান্না ভেজা কন্ঠে বললেন, আমরা মুসলিম না। আমরা হিন্দু। বুঝতে বাকি রইল না লোকটা আসলে কেমন ছিলেন।

মরহুম এ এম রিয়াছাল আলী বিশ্বাস কারো নিকট থেকে কখনো কোন ভাল মন্দ কিছু শুনে থাকলে সাথে সাথেই এর প্রতিক্রিয়ায় প্রভাবিত হতেন এবং তাৎক্ষণিক তড়িৎ সিদ্ধান্ত না হলে মনে স্বস্তি পেতেন না। তিনি ছিলেন খুবই আবেগ প্রবন ও সাদা মনের মানুষ। মনটি ছিল তাঁর যেন একেবারেই কচিপাতা, একটু তাপেই গলে যাওয়ার মত। কমলতায় এতখানি আবেগে আপ্লত হয়ে যেতেন যে, শর্মিলতায় একটু খানি ছোঁয়া লাগলে যেমনটি হয়ে থাকে। তবে তাঁর হৃদয় ছিল সাগরের ন্যায় বিশাল, দিগন্ত জোড়া দু'বাহুর উষ্ণ আলিঙ্গনে তপ্ত মরুমনকে ভিজিয়ে দিতেন, আকর্ষণীয় স্নিগ্ধ মধুর ব্যবহারে, যার কারনে সাধারন খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষ, দিন মজুর, শ্রমিক কুলিরা সবচেয়ে অধিক শোকাহত ছিলেন তার মৃত্যুতে।

কবর থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রত্যেকটি মঞ্জিলে আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর বান্দার জন্য একান্ত সাহায্যকারী হোন এবং মহান রাব্বুল আলামীন তাঁকে ক্ষমা করুন, তাঁর ওপর রহম করুন, তামাম জিন্দেগীর সকল নেক খেদমত ও ত্যাগ-কুরবানীকে কবুল করে জান্নাতুল ফিরদাউসের আ’লা মাকাম দান করুন। তাঁর পরিবার-পরিজন, আত্নীয়স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা সবরে জামিল দান করুন। আমীন।।


প্রজন্মনিউজ২৪/একে

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ