উচ্চশিক্ষায় সংকট,সংখ্যা বাড়লেও বাড়ছেনা মান

প্রকাশিত: ২৯ জানুয়ারী, ২০২৩ ১২:৪২:৩০ || পরিবর্তিত: ২৯ জানুয়ারী, ২০২৩ ১২:৪২:৩০

উচ্চশিক্ষায় সংকট,সংখ্যা বাড়লেও বাড়ছেনা মান

নিউজ ডেস্ক: দেশে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে। পাবলিক আর প্রাইভেট মিলে দেড় শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও আরও নয়টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। অথচ বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই শৃঙ্খলা আনা যায়নি।

অনুমোদন দেওয়ার পর অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম, ট্রাস্টিদের দ্বন্দ্বে পাঠদান বন্ধ হয়ে গেছে। শৃঙ্খলা না মানায় ইউজিসির পক্ষ থেকেও সম্প্রতি ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি বন্ধ করা হয়েছে। আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে আরও ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়কে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আশানুরূপভাবে চলছে না। উপাচার্যদের অনিয়মে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ডুবতে বসেছে। সব মিলিয়ে বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুণে-মানে কতদূর এগিয়েছে সে প্রশ্ন রেখেছেন শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্টরা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্যমতে, এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৩টি। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ১০৯টি। অযাচিতভাবে যত্রতত্র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়ার কারণে হযবরল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। শৃঙ্খলা আর নিয়মের মধ্যে আনতে না পারার কারণে একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে চারটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের। এগুলো হচ্ছে- আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, ইবাইস ইউনিভার্সিটি, কুইন্স ইউনিভার্সিটি ও দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১২ বছরের মধ্যে নিজস্ব স্থায়ী ক্যাম্পাসে সব কার্যক্রম স্থানান্তরের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই আইনের ব্যত্যয় ঘটানোর কারণে বিজ্ঞপ্তিতে ছয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পাসে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছে ইউজিসি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি, আশা ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি, স্টেট ইউনিভার্সিটি ও মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

এ ছাড়া ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রয়েল ইউনিভার্সিটি, সিটি ইউনিভার্সিটি, দ্য মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটি ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি। এ ছাড়া শীর্ষ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়েও অভিযোগের অন্ত নেই।

ইউজিসির তথ্যমতে, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে অনুমোদন না নিয়েই ১০টি প্রোগ্রাম পরিচালনা করছে। এ তালিকায় রয়েছে আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত ১০ বছরেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। গড় হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ২০২১ সালে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় করেছে ৮৫ হাজার ২০২ টাকা। অথচ ২০১৪ সালে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় ছিল ১ লাখ ৭ হাজার ৪৩০ টাকা। বছর বছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টিউশন ফি বাড়ালেও অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে নেতিবাচক চিত্র দেখা গেছে।

জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সম্প্রতি জানান, বর্তমানে দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৩টি। এ ছাড়া সাতক্ষীরা, শরীয়তপুর, নারায়ণগঞ্জ, মেহেরপুর, লক্ষ্মীপুর, ঠাকুরগাঁও, নওগাঁ, বগুড়া ও নাটোরে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হবে। তখন দেশের মোট পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়াবে ৬২ তে। অথচ বিদ্যমান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে সমস্যার অন্ত নেই।

সাবেক উপাচার্যদের অনিয়ম-দুর্নীতিতে পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, এমনকি ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদন থাকলেও অপসারণ বা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ফলে কিছু উপাচার্যের অনিয়ম করার প্রবণতাও কমেনি।

তথ্যমতে, সরকার ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ৪টি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও ৫৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তার ঘটলেও গুণগত মানে তেমন উন্নতি দেখা যাচ্ছে না।

ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, ডেমোগ্রাফিক হিসাবে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ানো সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান না বাড়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। পরিকল্পনা ছাড়াই অনেক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। আবার কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্ষমতা না থাকলেও নতুন নতুন বিভাগ খোলা হচ্ছে। এসব কারণে শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। ইউজিসির এ সদস্য আরো  বলেন, অতীতে অনেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের প্রমাণ থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এর কারণেও কারও কারও মধ্যে অনিয়ম করতে সংকোচ হচ্ছে না। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণার ক্ষেত্রেও অনীহা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দেশের ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় কোনো বরাদ্দ রাখেনি। আর ১৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বছরে কোনো প্রকাশনা ছিল না। নানা সূচকে পিছিয়ে থাকার কারণে আন্তর্জাতিক র‌্যাঙ্কিংয়েও পিছিয়ে থাকছে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের (কিউএস) সর্বশেষ প্রকাশিত বিশ্বসেরা ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ঠাঁই পায়নি বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। র‌্যাঙ্কিংয়ে টানা পঞ্চমবারের মতো ৮০১ থেকে ১০০০তম অবস্থানে রয়েছে উচ্চশিক্ষায় দেশসেরা দুই প্রতিষ্ঠান- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান ছিল এক হাজারের পর।

একাডেমিক রেপুটেশন, এমপ্লয়ার রেপুটেশন, সাইটেশন, শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত, বিদেশি শিক্ষার্থী, বিদেশি ছাত্র সূচকে এই র‌্যাঙ্কিং করা হয়। একাডেমিক রেপুটেশনে বুয়েট পেয়েছে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছে ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ মার্ক। সূচকগুলোতে পিছিয়ে থাকার কারণেই আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে ভালো করতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাঙ্কিং ২০২৩-এ ৬০১ থেকে ৮০০-এর মধ্যে স্থান পেয়েছে মাত্র দুটি বিশ্ববিদ্যালয়। ১২০১ থেকে ১৫০০-এর মধ্যে স্থান করে নিয়েছে মাত্র তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়। পাঠদান, গবেষণা, নলেজ ট্রান্সফার ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি- এই চারটি ক্ষেত্রে ১৩টি সূচক বিবেচনায় নিয়ে তালিকাটি করা হয়।

বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জনসংখ্যা অনুপাতে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়বে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে গবেষণা, পাঠদান মানসম্মত হতে হবে। বিদ্যমান অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই মানসম্মত শিক্ষক নেই, গবেষণা নেই, অবকাঠামো নেই। সেখানে আরও নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হলে সেগুলো কীভাবে মান নিশ্চিত করবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এ শিক্ষাবিদ আরো বলেন, অ্যাক্রেডিটেশন প্রক্রিয়ায় আসার পর এমন অভিযোগ থেকে অনেকাংশেই মুক্তি পাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কারণ যারা মানসম্মত পাঠদান করবে না তারা অ্যাক্রেডিটেশন সনদও পাবে না।


প্রজন্মনিউজ২৪/উমায়ের

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ