শিক্ষার্থী আত্মহত্যায় ১ম অবস্থানে ঢাকা, এগিয়ে নারী শিক্ষার্থীরা

প্রকাশিত: ২৮ জানুয়ারী, ২০২৩ ০১:৪৬:০১ || পরিবর্তিত: ২৮ জানুয়ারী, ২০২৩ ০১:৪৬:০১

শিক্ষার্থী আত্মহত্যায় ১ম অবস্থানে ঢাকা, এগিয়ে নারী শিক্ষার্থীরা

নিউজ ডেস্ক: গত বছর দেশে আত্মহত্যাকারী স্কুল ও কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বিবেচনায় শীর্ষে রয়েছে ঢাকা বিভাগ। গত বছর সারা দেশে আত্মহত্যাকারী মোট শিক্ষার্থীর ২৩.৭৭ শতাংশ ঢাকা বিভাগের। এর পরেই চট্টগ্রাম বিভাগে ১৭.২৭ এবং রাজশাহী বিভাগে ১৬.৮১ শতাংশ। এ ছাড়াও খুলনা বিভাগে ১৪.১৩, রংপুরে ৮.৭৪, বরিশালে ৮.৫৩, ময়মনসিংহে ৬.২৭ এবং সিলেটে ৪.৪৮ শতাংশ স্কুল-কলেজ পড়ুয়া আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থী রয়েছেন।

তথ্যগুলো উঠে এসেছে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা সমাজসেবী সংগঠন ‘আঁচল ফাউন্ডেশন’-এর একটি জরিপে। আঁচল ফাউন্ডেশনের রিচার্স অ্যান্ড অ্যানালাইসিস ইউনিটের টিম লিডার ফারজানা আক্তার লাবনী গতকাল শুক্রবার তাদের জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেন। দেশে প্রকাশিত জাতীয়, স্থানীয় ও বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল থেকে সংগৃহীত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে জরিপটি পরিচালিত হয়।

জরিপ অনুযায়ী, গত বছর সারা দেশে স্কুল ও সমমান পর্যায়ের শিক্ষার্থী ৩৪০ জন, কলেজ ও সমমান পর্যায়ে ১০৬ জন, মাদরাসাশিক্ষার্থী ৫৪ জনসহ আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৪৬ জন, যাদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থী ২৮৫ জন এবং পুরুষ ১৬১ জন। এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অন্তত ৮৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।

জরিপে তুলনামূলকভাবে নারী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার বেশি দেখা গেছে। স্কুল-কলেজপড়ুয়া আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারী ৬৩.৯০ এবং পুরুষ ৩৬.১ শতাংশ। শুধু স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যাকারী নারী শিক্ষার্থীর পরিমাণ ৬৫.৩০ শতাংশ এবং পুরুষ শিক্ষার্থী ৩৪.৭০ শতাংশ। অন্য দিকে শুধু কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহননকারী নারী ৫৯.৪৪ এবং পুরুষ ৪০.৫৬ শতাংশ।

সমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য এবং উপাত্ত থেকে জানা যায়, ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করছে। সংখ্যায় তা ৪০৫ জন এবং শতকরা হিসেবে ৭৬.১২ শতাংশ। এর মধ্যে নারী ৬৫.৯৩ শতাংশ এবং পুরুষ ৩৪.০৭ শতাংশ। আবার ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী শিক্ষার্থী রয়েছেন ৪০ জন বা ৮.০৮ শতাংশ। এর মধ্যে নারী ৪৬.৫২ শতাংশ থাকলেও পুরুষ রয়েছেন ৫৩.৪৮ শতাংশ। বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের সাথে শিক্ষার্থীদের মানিয়ে নিতে প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি হতে হয় বলেই এ বয়সে আত্মহত্যার হার বেশি বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

আত্মহত্যাকারী স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের জীবদ্দশায় নানাবিধ বিষয়ের মুখোমুখি হয়, যা তাদের আত্মহননের পথে ঠেলে দিতে বাধ্য করে। জরিপে উঠে আসা এমনই বেশকিছু কারণের মধ্যে দেখা যায়, মান-অভিমান তাদেরকে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যাপ্রবণ করে তোলে। ২৭.৩৬ শতাংশ স্কুল-কলেজশিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে অভিমান করে। এদের বড় অংশেরই অভিমান হয়েছে পরিবারের সাথে। এ ছাড়াও প্রেমঘটিত কারণে ২৩.৩২, পারিবারিক কলহে ৩.১৪, হতাশায় ২.০১, মানসিক সমস্যায় ১.৭৯, আর্থিক সমস্যায় ১.৭৯ এবং উত্ত্যক্তকরণ, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথে ধাবিত হয়েছে ৩.১৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আত্মহত্যার পেছনের কারণ জানা যায়নি।

শিক্ষার্থীদের ক্রমবর্ধমান আত্মহত্যার চিত্র নিয়ে মনোবিজ্ঞানী শাহরিনা ফেরদৌস বলেন, জরিপে দেখা যাচ্ছে ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহননের প্রবণতা অনেক বেশি। অর্থাৎ তারা যে বয়ঃসন্ধিকালের সময়টি পার করছে এটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং এ সময়ে কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন এবং সচেতনতা তৈরির কোনো বিকল্প নেই। কী কারণে তাদের সংখ্যা গত বছর এত বেশি ছিল তার কারণগুলো অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। বিশেষ করে তাদের পারিবারিক বন্ধন, ব্যক্তিগত চাহিদা, সামাজিক অবস্থান এসব বিষয় জানার প্রয়োজন রয়েছে।

তবে স্কুল-কলেজশিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার কারণ হিসেবে আরো বেশকিছু ভিন্ন কারণও উঠে এসেছে জরিপে। আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়া, শিক্ষক কর্তৃক অপমানিত হয়ে, গেইম খেলতে বাধা দেয়ায়, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে, মোবাইল ফোন কিনে না দেয়ায়, মোটরসাইকেল কিনে না দেয়ায়, পড়াশোনার চাপ অনুভব করা এবং পারিবারিক চাপেও আত্মহত্যা করেছে আরো কিছু শিক্ষার্থী।

আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, শিশু-কিশোরদের মন সাধারণত ভঙ্গুর প্রকৃতির হয়। এ বয়সে ছোট ছোট বিষয়ও তাদেরকে আন্দোলিত করে। বয়ঃসন্ধিকালে মানসিক বিকাশের সাথে অনেকেই খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে তাদের প্রত্যাশার ক্ষেত্রে ছোটখাটো ঘাটতিও তাদেরকে আত্মহত্যার মতো বড় সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে।

আত্মহত্যা প্রতিরোধের ব্যাপারে শাহরিনা ফেরদৌস বলেন, কোডিড-১৯-এর একটি বড় প্রভাব পড়েছে বয়ঃসন্ধিকালীন জনসমষ্টির উপর, যা কাটিয়ে উঠতে আরো সময়ের প্রয়োজন। সর্বোপরি বয়ঃসন্ধিকালীন মনের যত্ন বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। ছেলেমেয়েদের খেলাধুলার সুযোগ ভীষণ প্রয়োজন। স্ক্রিন বা মোবাইল আসক্তি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারিবারিক বন্ধন, পরিবারের সাথে ভালো সময় কাটানোর চর্চা বাড়াতে হবে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই আত্মবিশ্বাসী এবং সুস্থ মনন গড়ে তুলতে এই পদক্ষেপগুলো অনস্বীকার্য।

আঁচল ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সামিরা আক্তার সিয়াম বলেন, শিক্ষার্থীদের ছোটবেলা থেকেই পরিবারিক, সামাজিক কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় মানসিক স্বাস্থ্য ও আবেগ নিয়ন্ত্রণের কৌশলগুলো শেখাতে হবে। নিজের আবেগীয় আচরণ এবং অন্যের প্রতি সমব্যথী হয়ে কিভাবে নেতিবাচক মন্তব্য বা পরিস্থিতিতে সাড়া দিতে হয় তার চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এতে করে জীবনকে তুচ্ছ না ভেবে, ইতিবাচকভাবে যাপনের কৌশল রপ্ত করতে পারবে।

এ সময় শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা মোকাবেলায় হতাশা, একাকিত্ব ও নেতিবাচক ভাবনা থেকে শিক্ষার্থীদের দূরে রাখতে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ বৃদ্ধি; সন্তানদের মানসিক বিকাশ এবং তাদেরকে সহানুভূতির সাথে শুনতে ও বুঝতে অভিভাবকদের জন্য প্যারেন্টিং কার্যক্রম চালু।  

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষক-কর্মচারীদের আচরণ ও পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে কৌশলী ও সহানুভূতিশীল হতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা; স্কুল-কলেজপর্যায়ে আত্মহত্যা প্রতিরোধী পোস্টার প্রদর্শন; প্রতিটি আত্মহত্যার ঘটনায় পরিবারের ভূমিকা খতিয়ে দেখতে ও দায় বৃদ্ধিতে তাদের আইনি বাধ্যবাধকতার অন্তর্ভুক্ত; স্কুল-কলেজের ছাত্রকল্যাণ ফান্ডের কার্যক্রম ত্বরান্বিত করে তা সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আর্থিক সমস্যা সমাধান।

প্রেমঘটিত সম্পর্কে বা অজ্ঞাতসারে ধারণ করা গোপন ছবি, ভিডিও ইত্যাদি প্রচার তথা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গ ও সাইবার ক্রাইমের বিষয়ে শাস্তি উল্লেখপূর্বক বিশেষ প্রচারণাভিযান পরিচালনা; স্কুল-কলেজপর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যা সতর্কতা চিহ্ন সম্পর্কে ধারণা প্রদান।  

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মেন্টাল হেলথ কর্নার খোলা এবং কার্যকর মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য ক্লিনিক্যাল সুবিধার সহজলভ্যতা নিশ্চিত করার প্রস্তাবনা পেশ করে সংগঠনটি।


প্রজন্মনিউজ২৪/উমায়ের

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ