“ঘূর্ণিঝড়ের বিস্কুট”

প্রকাশিত: ২০ ডিসেম্বর, ২০২২ ০৪:২৭:১২ || পরিবর্তিত: ২০ ডিসেম্বর, ২০২২ ০৪:২৭:১২

“ঘূর্ণিঝড়ের বিস্কুট”

                                    “ঘূর্ণিঝড়ের বিস্কুট” 


                                      আলাউদ্দিন খলিফা 

 

টুনটুনি তোমাকে আজ একটি গল্প শোনাবো তুমি যদি শুনতে চাও তাহলেই তোমাকে বলব।-

শুনাও'না ভাইয়া। তোমার গল্প আমার খুবই ভালো লাগে। 

তাহলে শোন-
তখন আমি সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। দুদিন আগ থেকে টিপটিপ বৃষ্টি পরতেছিল। রাত ৮টা। ভারত-পাকিস্তানের একদিনের ওয়ান্ডে ম্যাচ চলছিল। গ্রামের বাজারে ছোট্ট একটি টিনের দোকানে বিশ জনের সাথে আমিও খেলা দেখছিলাম। 
ব্যাটসম্যান আউট হবার পর ব্যাটিং-এ আফ্রিদি নেমেছেন। বলার বল করবেন আমরা তাকিয়ে আফ্রিদির চার-ছক্কার ফুলঝুরি দেখার জন্য। হঠাৎ আমাদের মাথার উপর থেকে টিনের চাল উড়ে গেলে সবাই বিস্মিত!
 
হৈচৈ চারিদিক। বাতাসের প্রচন্ড শনশন শব্দ। দোকান ঘর নড়ছিল। আমার চারপাশ থেকে সবাই ছুটছে তো ছুটছে সাথে আমিও। কেউ কাউকে হাতের নাগাল পাচ্ছে না। বিদ্যুৎও চলে গেছে ঝড়ের ভয়ে!
প্রচন্ড অন্ধকার কিছুই দেখা যায় না। বাতাসের এত বেশি চাপ ছিল যার কারনে কেউ পিছনে যাবার তো দূরের কথা পিছনে তাকাতেও পারছে না। মনে হলো সুপার ম্যানের মত বাতাসে উড়ছি!

কার টর্চ লাইটের বদৌলতে দেখতে পেলাম বাজার সংলগ্ন পুকুর পাড়ের বিশাল নারিকেল গাছটা নুয়ে ভেঙে পড়ার উপক্রম। বাজারের পাশেই ছিল সরকারী প্রাইমারী স্কুল। কেউ যেন জোরে হাক মেরে ওদিকে যাবার জন্য ডাকছে। কোন দিশামিশা না পেয়ে ওদিকেই গেলাম। 

দেখতে পেলাম গ্রামের আশপাশের লোকজন এখানে আশ্রয় নিয়েছে। কেউ কান্নাকাটি করছে, কেউ জোরে সোরে দরুদ পড়ছে, কেউ মানত করছে, কেউ'বা শেষ বারের মত চিরস্থায়ী খোদার দরবারে পানাহ্ চাচ্ছে। শিশু-বয়স্ক লোকগুলো শীতে কাঁপছে। 

স্কুলের বারান্দয় দাঁড়িয়ে দেখি বাজারের দোকানগুলোর টিন খুলে উড়ে এসে পড়ছে, কোথা থেকে বড় বড় ডালপালা উড়ে এসে স্কুলের সামনে পড়তে দেখছি! বাতাসের এমন বেগ এ জনমে কখনো দেখা হয়নি। আল্লাহ্-বিল্লাহ করতে করতে রাত১২টা। বাতাসের বেগ কমে যায়। 
শীতের প্রকোপে আমি ও আমার বন্ধু মাসুম সিদ্ধান্ত নিলাম শীত থেকে বাঁচার জন্য পাশের কোন বাড়ি থেকে কাঁথা-কম্বল নিয়ে আসার। 
তাই দু'জনে স্কুল থেকে বেড়িয়ে পড়লাম। 

বাজারের উত্তর-পশ্চিম পাশে বিলাল ভাইয়ের বাড়ি থেকে কাঁথা নিয়ে আসার সময় মাসুমের মোবাইলের লাইটের আলোতে রাস্তার পাশে অনেকগুলো বিস্কুটের প্যাকেটের উপর নজর পড়ে। বিস্কুট গুলো ছিল ঘূর্ণিঝড়ে ভেঙে পড়া বেহাল ভাইয়ের দোকানের।
 
মাসুম কয়েকটি প্যাকেট হাতে তুলে নিল। আমি বললাম অপরের বিস্কুট কেন তুমি তুলেছো। বন্ধু জবাব দিল-আমরা খাবো। সুযোগ একটা পেয়েছি। ধর তুইও ল। বিস্কুট দেখে আমার পেটের ক্ষুধাও জেগে উঠল। আমরা দুজনে ওখানে দাড়িয়ে কয়েক প্যাকেট খাবার পর বাকি প্যাকেটগুলো নিয়ে নিলাম।
 
বাকি রাতটা স্কুলেই কাটিয়ে দিলাম কাঁথার ভিতর। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেলাম গ্রাম আগের মত নেই। বাজারের প্রায় সকল দোকান ভেঙে মাটিতে শুয়ে আছে। হঠাৎ আমার বাড়ির কথা মনে পড়ে। তাই সেদিকে রওয়ানা হই।
 
কিন্তু রাস্তা! এ কী অবস্থা, দুই পাশের মাঝারি-বড় সেগুন,অর্জুন, বাবলা,মেহগনি, চাম্বল সব এলোমেলো ভাবে ভেঙে-উপড়ে ধুমরে-মুচকে পড়ে আছে। ধান ক্ষেতের অবস্থা করুন। ভেঙ্গে উপড়ে শুয়ে পড়া গাছগুলোর কারনে সামনে এগিয়ে যাওয়া কষ্ট সাধ্য।
 
অবশেষে আমার বাড়ির সামনে দাড়ালাম। আমার বাড়িতে পাঁচটি কাঠের ঘর ছিল  চারটি ঘরই মাটির সাথে মিশে যায়। আমার মনে ভয় ঢুকল বাড়ির লোকজন কোথায়? অবশিষ্ট ঘরটি ছিল বড় কাকার। সেটি একটু বেশি মজবুত হওয়ায় ক্ষতি একটু কম হয়েছে। ও ঘরটাতেই দাদা-দাদি, শিশুদেরকে দেখতে পেলাম। ছোট কাকার মাথায় রাতে একটি সুপারি গাছ ভেঙে পড়ায় বেশ খানিকটা আহত হয়েছে।
 
ঝড় শুরু হবার কারনে আশে পাশে আশ্রয়স্থল না থাকায় তাদের সারা রাত ভীষণ ভয়ে কাটে। সৌন্দর্যমুগ্ধ বাগানের দিকে তাকিয়ে দেখি বিশাল বড় বড় গাছের কোনটার মাথা নেই, কোনটার মাঝ বরারব ভেঙে গেছে, অধিকাংশ গাছ উপড়ে পড়ে আছে,সুপারি গাছ গুলো বাঁকা হয়ে আছে। বাগানের বিভিন্ন রকমের ফল ঝড়ে নিচে পড়ে আছে।

চিন্তা করার বিষয়-যে গাছ গুলোকে দু'চারশ লোকে বল প্রয়োগেও মাটির সাথে মিশাতে পারবে না সেই গাছগুলোকে ঝড় মুহূর্তের ভিতর তছনছ করে দিল! 
কত ক্ষমতা সেই হুকুমদাতার যার হুকুমে সেকেন্ডের ভিতর পৃথিবীর সব নত হয়ে যায়!

বিকালবেলা বাজারে গিয়ে শুনতে পেলাম বহুত লোক মারা গিয়েছে আশপাশ ইউনিয়ন গুলোতে। কারো লাশ নদীর তীরে, কারো লাশ ধান ক্ষত, কারো লাশ বাগানের ডালের সাথে ঝুলছে। অসংখ্য পশুপাখি মারা গেছে। মৃত্যু মানুষদের আত্মীয় স্বজনদের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারি হয়ে যায়। 
চারদিকে হাহাকার। গাছের ডালপালা পড়ে পুকুর খাল বিলের পানি পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যায়। খাবারের সংকট দেখা দেয়। যেসব এলাকায ক্ষয় ক্ষতি কম হয়েছে সেইসব এলাকার যুবকরা বস্ত্র-চাল ডাল কালেকশন করে সহযোগিতা করার চেষ্টা করে।
 
কোন ত্রাণ কর্মীরা ঐ এলাকাগুলোতে গেলে সকল বয়সের মানুষগুলো বেঁচে থাকার জন্য ছুটে আসে এক বেলা খাবার নেবার জন্য। ক্ষুদার্ত মানুষগুলো খাবারের অভাবে পরস্পর স্বার্থপর হয়ে যায়।বিভিন্ন এনজিও ত্রাণ দিতে আসলে তারা এলাকার মেম্বার-চেয়্যারম্যানদের কাছে দায়িত্ব দেয় ত্রাণের।
 
দুঃখের বিষয় হল, যাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয় তারা অধিকাংশ ত্রাণ আত্মসাৎ করে।এনজিওগুলো দুর্গত মানুষদের জন্য টাকা, ঘর, চাল ডাল, গম, ছোলা, কম্বল, গরু-ছাগল দান করলেও সরকারী কর্মকর্তারা আত্মসাৎ করে নেয়।
'মানুষের করুন অবস্থার সময়ও অসৎ লোকদের চরিত্রের পরিবর্তন হয় না' তা আগে জানা ছিল না।
কিরে টুনটুনি, তোমার চোখে পানি!

ভাইয়া তোমার গল্প শুনে মনটা হু করে উঠল। তারা বিপদে পাশে না দাড়িয়ে দুঃখি মানুষদের সাথে এমন করল!
 
শোন টুনটুনি -
তখন থেকে নিজের মাঝে একটি স্বপ্ন লালন করছি, বড় হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াবো। এই অসহায় লোকগুলোর মুখে হাসি ফোঁটাবো। আর অসৎ মানুষগুলোকে দেশ ছাড়া করব। 
কিন্তু টুনটুনি, একটা কাজ আমার সবসময় ভীষণ নাড়া দেয়। 
কি সেটা ভাইয়া? 
আমার অপরাধের। সেই বেহাল ভাইয়ের ভেঙ্গে পড়া দোকানের বিস্কুটের ঘটনা।


প্রজন্মনিউজ২৪/আ.খ
 

এ সম্পর্কিত খবর

“ঘূর্ণিঝড়ের বিস্কুট”

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন





ব্রেকিং নিউজ