আজ বেদানাময় দিনাজপুরের ইয়াসমিন ট্রাজেডি দিবস

প্রকাশিত: ২৫ অগাস্ট, ২০২২ ০৩:১১:০৯

আজ বেদানাময় দিনাজপুরের ইয়াসমিন ট্রাজেডি দিবস

ইমরান হোসাইন:দিনাজপুর শহরের রামনগর এলাকার রিকশাচালক মৃত এমাজ উদ্দিন ও শরিফা বেগমের একমাত্র কন্যা ইয়াসমিন বেগম। শহরের লালবাগ কোহিনূর স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ত সে। বাবা মারা যাওয়ার পর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় কিশোরী ইয়াসমিনের। সংসারে অভাবের তাড়নায় মাত্র ১২ বছর বয়সে ১৯৯২ সালে গৃহপরিচারিকার কাজ করতে ঢাকায় যায়। সে আবুল আহসান আহমদ আলী নামের এক ব্যক্তির ঢাকার ধানমন্ডি ১নং সড়কের ১৩নং বাসার এক পরিবারে গৃহপরিচারিকার কাজ করত। আবুল আহসান আহমদ আলীর গ্রামের বাড়িও দিনাজপুর জেলায়। টানা তিন বছরে একবারও দিনাজপুরে মায়ের কাছে আসা হয়নি ইয়াসমিনের। তাই বাড়িতে আসার জন্য বিশেষ করে মাকে দেখার জন্য ভীষণ উতলা ছিল সে। গৃহস্বামী তাকে দুর্গাপূজার ছুটিতে যাওয়ার কথা বলেন। কিন্তু বাড়ি যাওয়ার জন্য উতলা ইয়াসমিন সে বাক্যে সান্ত্বনা পায়নি। সম্ভবত তাই ওই বছরের ২৩ আগস্ট ওই পরিবারের ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে একাই দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যায়। সে উঠে পড়ে দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁওগামী নৈশ কোচ হাছনা এন্টারপ্রাইজে।

ফিরে দেখা ২৫ আগস্ট ১৯৯৫ : ১৯৯৫ সালে ২৪ আগস্ট ভোরবেলা ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁও গামী ‘হাছনা এন্টারপ্রাইজ’ নামে রাত্রিকালীন কোচে ইয়াসমিন রাত তিনটার দিকে দিনাজপুরের দশ মাইল মোড়ে নামে। কোচের সুপারভাইজার দশ মাইল মোড়ের পান দোকানদার জাবেদ আলী, ওসমান গণি, রহিমসহ স্থানীয়দের কাছে কিশোরী ইয়াসমিনকে দিয়ে সকাল হলে মেয়েটিকে দিনাজপুর শহরগামী যেকোনো গাড়িতে তুলে দেওয়ার অনুরোধ জানান। কিন্তু এর কিছুক্ষণের মধ্যে দিনাজপুর কোতোয়ালি থানা টহল পুলিশের একটি পিক আপ ভ্যান সেখানে আসে। তারা মেয়েটির পরিচয় জানতে চায়। একপর্যায়ে শহরের রামনগর এলাকায় বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পুলিশ ইয়াসমিনকে পিক আপে তুলে নেয়। এরপর পুলিশের টহল ভ্যানটি দশমাইলের কাছে সাধনা আদিবাসী প্রাথমিক স্কুলের সামনে এসে থামে এবং পুলিশ সদস্যরা ইয়াসমিনকে স্কুলের মধ্যে পালাক্রমে ধর্ষণের পর হত্যা করে। পরে তারা ইয়াসমিনের লাশ দিনাজপুর শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে ব্র্যাক অফিসের পাশে একটি আদিবাসীর বাড়ির সামনে ফেলে চলে যায়।

পরের দিন সকালে ইয়াসমিনের লাশ পাওয়া যায় দিনাজপুর দশমাইল মহাসড়কে রানীগঞ্জ ব্র্যাক অফিসের সামনে। পরবর্তী সময় ডাক্তারি পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়, পুলিশ হেফাজতে ধর্ষণ শেষে খুন হয়েছিল দিনাজপুরের কিশোরী ইয়াসমিন। পুলিশের এই পৈশাচিক ঘটনা দিনাজপুরবাসীর মধ্যে জানাজানি হলে তারা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা শহরে প্রতিবাদ মিছিল বের করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।  দিনাজপুর কোতোয়ালী পুলিশ বিষয়টি সামাল দেয়ার জন্য ‘একজন অজ্ঞাত পরিচয় যুবতীর লাশ উদ্ধার’ মর্মে ঘটনাটি সাজিয়ে থানায় একটি ইউডি মামলা ফাইল করে। লাশের তড়িঘড়ি ময়নাতদন্ত শেষে আঞ্জুমানে মফিদুলের মাধ্যমে বালু বাড়ি শেখ জাহাঙ্গীর গোরস্থানে দাফন করা হয়। লাশের কোনো প্রকার গোসল ও জানাজা করা হয়নি। এখানে উল্লেখ্য যে, উত্তর গোবিন্দপুর এলাকায় পড়ে থাকা ইয়াসমিনের লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির উদ্দেশ্যে কোতোয়ালী থানার এসআই স্বপন কুমার প্রকাশ্যে জনতার সামনেই লাশ উলঙ্গ করে ফেলে, যা উৎসুক জনতার মাঝে ক্ষোভ সঞ্চার করে।

২৫ আগস্ট ’৯৫ দিনাজপুর শহরের স্থানীয় সংবাদপত্র গুলোয় ঘটনাটির পরস্পর বিরোধী ও বিভিন্নরকম খবর প্রকাশিত হয় এবং জনমনে রহস্যের কুয়াশা ও গুজব আরও ছড়িয়ে পড়ে। আগের দিন ঘটনার অব্যবহিত পরে পুলিশ প্রকৃত ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়া ও অন্যখাতে সরিয়ে নেয়ার জন্য যে রহস্যময় আচরণ করে আসছিল তার অংশ হিসেবে পুলিশ স্থানীয় সাংবাদিক নামধারী হলুদ সাংবাদিকদের ক্রয় করার চেষ্টা করে ও নিহত ইয়াসমিনকে ‘পতিতা বানু’ বানাবার চক্রান্ত চালায়। অভিযোগ পাওয়া যায় যে, কিছু সংবাদপত্র দরদামে বনিবনা না হওয়ায় ও রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের নটবরদের নেপথ্য ইন্ধনে ঘটনাটির খবরে পরস্পর বিরোধী ও অস্বাভাবিক কভারেজ করে।

একজন পরিচিত বালিকাকে ‘অজ্ঞাত পরিচয়’ ও ‘পতিতা’ বানানো, তাকে সর্ব সম্মুখে বেআব্রু করা, গোসল ও জানাজা ব্যতিরেকে লুকোছাপা সতর্কতার সঙ্গে লাশ দাফন করা, সেই কবরে প্রহরার ব্যবস্থা নেয়া, বানুকে মেরে কবরের লাশ বদলের পাঁয়তারা ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কিত পুলিশ ও প্রশাসনের রহস্যময় আচরণ জনমনে কৌতূহল ও বিক্ষোভ শতগুণে জাগিয়ে তোলে। 

এক পর্যায়ে ২৬ আগস্ট রামনগর মোড়ে মিটিং আহ্বান স্থানীয় জনতা। মাইকিং করে প্রচারণা চলতে থাকে। কোতোয়ালী থানা এলাকায় পুলিশ মাইক ভেঙ্গে দেয়। এই ঘটনার খবর রামনগর এলাকায় পৌঁছয় ও আশেপাশের এলাকার লোকজন সংগঠিত হতে শুরু করে। ওইদিন সন্ধ্যার পরে রামনগর মোড়ে ইয়াসমিনের গায়েবি জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে সমাবেশ থেকে রাত দশটার দিকে প্রতিবাদী জনতা বিক্ষোভ মিছিল সহকারে কোতোয়ালী থানা ঘেরাও করে। তারা অভিযুক্ত তিন পুলিশ কর্তৃক ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদ, ন্যায্য বিচার ও শাস্তি দাবি করে। এসময় পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ করে। এতে আট-দশজন ব্যক্তি আহত হয়। পুলিশ ছয় রাউন্ড ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে। গুলির খবরে থানা ঘেরাও’এ আরও শত শত মানুষ যোগ দেয়। এ সময় হাজার হাজার জনতা কোতোয়ালি থানার সীমানা প্রাচীর ভেঙে ফেলে এবং সারারাত থানা অবরোধ করে রাখে।

২৭ আগস্ট শহরে থমথমে পরিস্থিতির মধ্যেই  সকাল এগারোটার দিকে ঘটনার প্রতিবাদ ও সব প্রশাসনিক কর্মকর্তার বদলি এবং দোষী পুলিশ কর্মকর্তাদের শাস্তির দাবীতে বিক্ষুব্ধ জনতা একে একে রাজপথে নেমে আসে। শহরে একটি বিশাল মিছিল বের হয়। এই মিছিলেও পুলিশ লাঠিচার্জ করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এসময় মিছিলকারীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষের এক পর্যায়ে মারমুখী পুলিশ শহরের বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে গুলি চালায়। ফলে সামু, কাদের ও সিরাজসহ নাম না জানা ৭ জন নিহত হয়। আহত হয় প্রায় ৩ শতাধিক মানুষ। পরে বিক্ষুব্ধ জনগণ শহরের ৪টি পুলিশ ফাঁড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। শহরের আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শহরে ১৪৪ ধারা (কার্ফু) জারি করা হয়। শহরে নামানো হয় বিডিআর। দিনাজপুর থেকে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।

মামলা ও বিচার প্রক্রিয়া :এসব ঘটনায় দিনাজপুরবাসীর পক্ষে তিনটি মামলা দায়ের করা হয়। যার মধ্যে নিরাপত্তা জনিত কারণে ইয়াসমিন হত্যা মামলাটি দিনাজপুর থেকে স্থানান্তর করা হয় রংপুরে।  ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট রংপুরের জেলা ও দায়রা জজ আব্দুল মতিন মামলার রায় ঘোষণা করেন। মামলার রায়ে আসামী পুলিশের এ,এস,আই মইনুল, কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার ও পুলিশের পিক আপ ভ্যান চালক অমৃত লাল বর্মণের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ বিধান ‘৯৫-এর ৬ (৪) ধারায় ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুর আদেশ দেন। আলামত নষ্ট, সত্য গোপন ও অসহযোগিতার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এ,এম,আই মইনুলকে আরো ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। 

২০০৪ সালের ০১ সেপ্টেম্বরে এএসআই মইনুল হক ও কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার এবং ২৯ সেপ্টেম্বর পিক আপ ভ্যান চালক অমৃত লাল বর্মণকে রংপুর জেলা কারাগারের অভ্যন্তরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা।

নারী নির্যাতনের এই যুগান্তকারী প্রতিবাদী ঘটনাকে স্মরণীয় করতেই প্রতিবছর ২৪ আগস্ট দিনটি ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। তবে দিনাজপুরের মানুষ দিবসটি ইয়াসমিন হত্যা দিবস হিসেবেই পালন করে থাকে। ইয়াসমিন হত্যা মামলার রায় ঘোষণা ও বাস্তবায়িত হলেও আজ পর্যন্ত ইয়াসমিন হত্যার প্রতিবাদে আন্দোলন করতে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের হত্যাকারীদের বিচার হয়নি।


প্রজন্মনিউজ২৪/ইজা

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ