রাজধানীর যাত্রী ছাউনি অব্যবস্থাপনায নাজেহাল

প্রকাশিত: ০১ জুলাই, ২০২২ ০৪:০৮:৫৪

রাজধানীর যাত্রী ছাউনি অব্যবস্থাপনায নাজেহাল

নগরে চলার পথে রোদ বৃষ্টি থেকে বাঁচতে এবং নির্দিষ্ট স্থানে বাসে ওঠা-নামা করতে দুই শতাধিক স্থানে যাপত্রী ছাউনি করেছিল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। কিন্তু এখন অধিকাংশ যাত্রী ছাউনির অবস্থা নাজুক। ময়লা-আবর্জনা ও বসার বেঞ্চগুলো ভাঙা। বৃষ্টি হলে যাত্রী ছাউনিতে যাত্রীরা দাড়াতে পারে না ছাউনি দিয়ে পানি পড়তে থাকে। 

এই যাত্রী ছাউনিগুলোর সামনে বাস থামার নির্দেশনা আছে। তবে, কোনো যাত্রী ছাউনিতেই বাস থামছে না। যত্রতত্র যাত্রীও ওঠা-নামা করছে না । ফলে যানজট তৈরি হচ্ছে । প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। যাত্রীদের অভিযোগ, সিটি করপোরেশন এবং পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের নির্দেশনা মতে যপাত্রী ছাউনির সামনে বাস থামার কথা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন, সড়কে কোনো শৃঙ্খলা নেই। যাত্রী ছাউনির বদলে শতশত যাত্রী রাস্তায় বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকেন। বাস দেখামাত্রই দৌড় দিয়ে উঠে পড়েন। এছাড়া অনেক যাত্রী চলন্ত অবস্থায়ই গাড়ি থেকে নামতে বাধ্য হন। এতে প্রতিনিয়ত সড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে। যাত্রী ছাউনির সামনে সব বাস থামাতে চালকদের বাধ্য করতে হবে। ভাঙা যাত্রী ছাউনিগুলো সংস্কার করতে হবে।

গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করেই দায়িত্ব শেষ করছে সিটি করপোরেশন। এগুলোর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে তারা উদাসীন। এজন্যই সড়কে অরাজকতা সৃষ্টি হয়। এটি কমাতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে পর্যাপ্ত যাত্রী ছাউনি বসাতে হবে।

রাজধানীতে যাত্রী ছাউনি স্থাপনের কাজটি করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এই দুটি সংস্থা বিভিন্ন সময় নগরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দুই শতাধিক যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করেছে। এখনো বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে যাত্রী ছাউনি বসানোর কাজ চলছে বলে জানা গেছে।

ডিএসসিসি: ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে রাজধানীতে বাস বে ও যাত্রী ছাউনি নির্মাণের উদ্যোগ নেয় ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি। এর মধ্যে ডিএসসিসি এলাকায় ২৮টি বাস বে ও ৫০টি যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করা হয়। কিন্তু এসব বে ব্যবহার না করে যত্রতত্র থামিয়ে যাত্রী তুলছেন বাসচালকরা। ফলে যাত্রী ছাউনি নির্মাণে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য মিলছে না। এর আগেও বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় ডিএসসিসির বিভিন্ন এলাকায় যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করা হয়েছিল। সেগুলো এখন জরাজীর্ণ। এখন সব মিলে ডিএসসিসি এলাকায় কয়টি যাত্রী ছাউনি আছে, তার সঠিক তথ্য দিতে পারেনি সংস্থাটি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসসিসি প্রকৌশল দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, উন্নত দেশগুলোর বাস স্টপেজের আদলে তারা বাস বেগুলোতে বিশুদ্ধ খাবার পানি, ওয়াইফাই, টি-স্টল ও মোবাইল ফোন চার্জের ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু সঠিক তদারকির অভাবে বাস বেগুলো কাজে আসেনি। বাস বের লাইট, চার্জার পয়েন্টসহ অন্যান্য সরঞ্জাম চুরি হয়ে গেছে।

সম্প্রতি ডিএসসিসি পল্টনের মুক্তাঙ্গন মাঠ, রায়েরবাগ, শনির আখড়া, সায়েদাবাদ জনপথ মোড়, যাত্রাবাড়ী টিঅ্যান্ডটি অফিস, গোলাপবাগ, বাসাবো, বৌদ্ধমন্দির, মুগদা, সায়েদাবাদের বাস বে ঘুরে এ দৃশ্য দেখা যায়।

এই এলাকাগুলোর প্রতিটি মোড় থেকে কিছু দূরে বাস বে বা স্টপেজগুলো তৈরি করা হয়েছে। বাস স্টপেজের সামনে প্রায় ১০০ গজ হলুদ রঙ দিয়ে মার্ক করে বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা ‘বাস স্টপেজ’। কিন্তু কোনোটিতেই যাত্রীদের বাসের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়নি। এখানে বিভিন্ন বাসের কাউন্টার, রিকশা, সিএনজি অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল গ্যারেজ গড়ে উঠেছে।

এ ছাড়া এসব বাস বের সামনে কোনো বাস থামে না। বাস বের গ্লাসে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও কোম্পানির বিজ্ঞাপন পোস্টারে ছেয়ে গেছে। সেখানে ভবঘুরে, বখাটেসহ বিভিন্ন লোকজন অলস সময় কাটায়।

শনির আখড়া সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে গুলিস্তানের বাসের অপেক্ষা করছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী আল-আমিন। বাস-বে তে না দাঁড়িয়ে সড়কে দাঁড়িয়েছেন কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে আল-আমিন বলেন, বাস স্টপেজে তো বাস থামে না। সবাই রাস্তার ওপর দাঁড়িয়েই বাসের অপেক্ষা করেন। বাস বের ভেতর ও চারপাশে ময়লা-আবর্জনা স্তূপ হয়ে থাকে। এগুলো কেউ পরিষ্কারও করে না। তাই বৃষ্টি আসলেও এসব বাস বে এর ভেতর কেউ ঢুকতে চায় না।

তিনি বলেন, বাস বেগুলো যাত্রীদের কল্যাণের জন্য। কিন্তু বাসচালকদের উদাসীনতায় এগুলোর যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। বাংলামোটর থেকে কারওয়ান বাজারের দিকে যেতে হাতের বা দিকে পান্থকুঞ্জ পার্কের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে চার বছর আগে একটি যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করেছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। উদ্দেশ্যে ছিল, এই ছাউনির নিচে যাত্রীরা বসবে বা দাঁড়াবে। নির্দিষ্ট বাস ছাউনির সামনে থামবে। নিরাপদে যাত্রী গন্তব্যে পৌঁছাবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো যাত্রী এই ছা্উনিটি ব্যবহার করে।

দেখা যায়, বাংলামোটর মোড় থেকে এই যাত্রী ছাউনির দূরত্ব অন্তত ৫০ মিটার। ফলে কেউ যাত্রী ছাউনিতে যান না। সেখানে বাসও দাঁড়ায় না। প্রতিটি যাত্রীবাহী বাস বাংলামোটর মোড় থেকেই যাত্রী ওঠা-নামা করায়। একইভাবে বাংলামোটর মোড়ে রূপায়ন টাওয়ারের দক্ষিণ পাশে থাকা আরেকটি যাত্রী ছাউনিও অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে।

বছরখানেক আগে কলাবাগান মাঠের সামনে পৃথক দুটি যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করে ডিএসসিসি। কিন্তু এ যাত্রী ছাউনিগুলো কলাবাগান মোড় থেকে প্রায় ৫০ মিটার দূরে। ফলে সেখানেও কোনো যাত্রীকে বাসের জন্য দাঁড়াতে দেখা যায়নি। সবাই কলাবাগান মোড় থেকেই বাসে ওঠা-নামা করছেন।

চার বছর আগে মুক্তাঙ্গন মাঠের একটি অংশ নিয়ে বাস বে নির্মাণ করেছিল ডিএসসিসি। এখন সেই বাস বে অপসারণ করে নিয়েছে ডিএসসিসি। এ ছাড়া মাঠটির বিপরীত পাশে সচিবালয় ঘেঁষে আগের পুরোনো একটি যাত্রী ছাউনি থাকলেও সেটি কাউকে ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। এখন সেখানে চায়ের দোকান গড়ে উঠেছে।

জিপিও মোড় থেকে মিরপুর-১০ এ যাওয়ার জন্য সড়কে দাঁড়িয়েছিলেন আমির হোসেন। আলাপকালে তিনি বলেন, বাস স্টপেজগুলোর পরিবেশ নোংরা। ভাসমান লোকজন সেখানে দিন-রাত ঘুমায়। তাই বাস স্টপেজে যেতে চান না যাত্রীরা। এই বিষয়ে কথা বলতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি ডিএসসিসির প্রধান প্রকৌশলী সালেহ আহম্মেদ।

ডিএনসিসি: ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের সময় একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ১২টি বাস ছাউনি নির্মাণ করেছিল ডিএনসিসি। এখন আরেকটি প্রকল্পের মাধ্যমে আরও ৫০টি যাত্রী ছাউনি নির্মাণের কাজ চলছে। তবে এর আগে নির্মিত ডিএনসিসি এলাকায় কয়টি যাত্রী ছাউনি আছে, তার সঠিক তথ্য দিতে পারেনি সংস্থাটি।

ডিএনসিসির ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ সূত্র জানায়, ওই ১২টি বাস বে এর মধ্যে বনানী, মহাখালী, মোহাম্মদপুর, মিরপুর-১, খিলক্ষেত, উত্তরাসহ বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করেছেন। এখন পৃথক একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ডিএনসিসির ৫০টি স্থানে যাত্রী ছাউনি নির্মাণের কাজ চলছে। এর মধ্যে তেঁজগাওয়ের নাবিস্কো, ইসিবি চত্বর, মিরপুর-১৪, মিরপুর-১৩, মিরপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, মিরপুর-২, রাইনখৈলা মোড়, চিড়িয়াখানা ফটক সংলগ্ন, গুলশান-১ গোল চত্বর, মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, তিতুমীর কলেজ, এ কে খন্দকার রোড, মহাখালী রেল ক্রসিং, শাহীন কলেজ, লাভ রোড ক্রসিং, সাতরাস্তা, রামপুরা টিভি সেন্টার এলাকায় আরও ১৮টি যাত্রী ছাউনির কাজ শেষ হয়েছে। বাকি যাত্রী ছাউনিগুলো নগরের বিভিন্ন এলাকায় ক্রমান্বয়ে বসানোর কাজ চলছে।

নাবিস্কো থেকে তেজগাঁও সাতরাস্তা মোড় যেতে হাতের বা পাশে বিজি প্রেস সংলগ্ন ফুটপাতের ওপর সম্প্রতি একটি যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করেছে ডিএনসিসি। সরেজমিনে দেখা যায়, উদ্বোধনের আগেই যাত্রী ছাউনিতে একটি পিকআপ পার্কিং করে রাখা আছে। কোনো যাত্রীকে সেখানে দেখা যায়নি। পিআপের ভেতরও চালককে পাওয়া যায়নি। তবে যাত্রী ছাউনি সংলগ্ন একটি বোর্ডে লেখা, ‘যাত্রী ছাউনি নির্মাণকাজ চলিতেছে, সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত।’

সাতরাস্তা মোড়ে কংক্রিটের পুরোনো একটা যাত্রী রয়েছে। মঙ্গলবার (২৮ জুন) দুপুরে দেখা যায়, যাত্রী ছাউনিটির অর্ধেক অংশ দখল করে গড়ে উঠেছে মুদি দোকান। যাত্রীদের বসার বেঞ্চের নিচে ময়লা-আবর্জনায় ভরা। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পোস্টারে পুরো ছাউনি ছেয়ে গেছে।

যাত্রী ছাউনিতে থাকা মুদি দোকানি কামাল হোসেন বলেন, তারা সিটি করপোরেশন থেকে অনুমতি নিয়েই যাত্রী ছাউনিতে দোকান পরিচালনা করছেন। বিনিময়ে করপোরেশনকে ভাড়াও দেন তারা। কিন্তু যাত্রী ছাউনিতে কেন মুদি দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তার উত্তর দিতে পারেননি ডিএনসিসির সংশ্লিষ্টরা।

জানতে চাইলে ডিএনসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন বলেন, যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করেই নতুন আরও ৫০টি আধুনিক যাত্রী ছাউনি নির্মাণকাজ হাতে নিয়েছে ডিএসসিসি। এরই মধ্যে অর্ধেক যাত্রী ছাউনি নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। বাকিগুলো নির্মাণের কাজ চলছে।

তিনি বলেন, এর আগেও বিভিন্ন সময় নগরের অনেক যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করেছে ডিএনসিসি। এর মধ্যে যেগুলো ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে গেছে, সেগুলো ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করা হবে। যেগুলো সংস্কার করা দরকার, সেগুলো সংস্কার করা হবে। যাত্রী বা যাত্রীসেবা নিয়ে কাজ করেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। বলেন,রাজধানীতে যাত্রীর তুলনায় যাত্রী ছাউনি খুবই অপ্রতুল। চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ যাত্রী ছাউনিও নির্মাণ করতে পারেনি সিটি করপোরেশন। 

আবার যেগুলো নির্মাণ করেছে, সেগুলো ব্যবহার অনুপযোগী। সেখানে তাদের কোনো তদারকি নেই। ফলে বাসগুলো যাত্রী ছাউনির সামনে থামছে না। এমন বিশৃঙ্খলভাবে নগরে গণপরিবহন চলছে। যেখানে যাত্রীদের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা নেই।


প্রজন্মনিউজ২৪/মনিরুল

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ