দার্শনিক জ্যঁ পল সার্ত্র

প্রকাশিত: ১৬ জুন, ২০২২ ১২:০০:৩৮

দার্শনিক জ্যঁ পল সার্ত্র

জ্যঁ পল সার্ত্রের (Jean-Paul Sartre) জন্ম ২১ জুন ১৯০৫ সালের ফ্রান্সের প্যারিস শহরে।

সার্ত্রের শৈশবের দশটি বছর কাটে পিতামহ মসিয়েঁ শার্ল শোয়াইটজারের তত্ত্বাবধানে। বলা যায় এ অবস্থায় সার্ত্র বেশ স্বাধীনভাবেই বেড়ে উঠছিলেন। শৈশবে তিনি তার মাতামহের  বিশাল গ্রন্থাগারের প্রায় সব পুস্তকই পড়ে শেষ করেছিলেন।
    
১৯৫২ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী আলবার্ট সোয়াইৎজার ভ্রাতুষ্পুত্রী এনিমারি সার্ত্রের মা। শৈশবে একটি বড় সময় কেটেছে যাদের সাথে সেই মা এনিমারি এবং পিতামহ চার্লস শোয়েটজারের প্রভাবকেই জীবনে বড় বলে মেনেছেন তিনি। সার্ত্রের বয়স তখন মাত্র নয়, দ্বিতীয় বিয়ের কারণে মায়ের সাথেও খানিকটা দূরত্ব তৈরি হয়। স্কুল এবং কলেজের মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত সার্ত্রের আচরণে অনিশ্চয়তা এবং জেদের বিষয়গুলো স্পষ্ট হতে থাকে। এরপর ১৯২৫ সালে তিনি ভর্তি হন ‘ফরাসি বুদ্ধিজীবীদের সূতিকাগার’ খ্যাত ‘একোলি নরমাল সুপিরিয়র’এ। পরীক্ষায় প্রথমবারের মতো অকৃতকার্য হন, কিন্তু দ্বিতীয়বার ১৯২৯ সালে ঠিকই কৃতকার্য হন।

প্যারিসের খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একোলি নরমাল সুপিরিয়র থেকে দর্শনশাস্ত্রে ডক্টরেড ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ফ্রান্স ও বিশ্বের খ্যাতনামা একাধিক দার্শনিকের সাথে তার আলাপ হয়। ক্রমে কেন্ট, হেগেল এবং হেইডেগারের মতো দার্শনিকদের তত্ত্ব অধ্যয়ন করেন তিনি। এরই মাঝে ১৯২৯ সালে সার্ত্রের পরিচয় ঘটে সেই সময়কার আলোচিত লেখিকা সিমন দ্য বোভোঁয়ার সাথে, যার সাথে জীবনের শেষদিন অবধি সম্পর্ক বজায় ছিল সার্ত্রের। ১৯৩১ সালে দর্শনের প্রফেসর হিসেবে লা হার্ভেতে যোগদান করেন।

১৯৩২ সালে বৃত্তি নিয়ে জার্মানিতে দর্শনশাস্ত্রের ওপর উচ্চতর শিক্ষার জন্যে যান। এ সময় সমকালীন ইউরোপের অনেক বড় মাপের দার্শনিকদের সাথেও প্রত্যক্ষ যোগাযোগের সুযোগ হয় তার। তিনি ১৯৩৫ সালে প্যারিসের লিসে কঁদরসে শিক্ষকতা শুরু করেন। পাশাপাশি এডমুন্ড হুসরল ও মার্টিন হাইত্তোগার-এর কাছে দর্শনশাস্ত্র পাঠ করতে থাকেন। এর মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ফরাসি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন একজন ‘মেটেরোলজিস্ট’ হিসেবে।

যুদ্ধে তিনি নাৎসি পার্টির হাতে বন্দী হন। জার্মানদের কাছে যুদ্ধবন্দী থাকা অবস্থাতেই রচনা করেন তার প্রথম নাটক। যদিও অসুস্থতার কারণে বন্দী হবার বছরখানেকের মধ্যেই সার্ত্রেকে মুক্তি দেয়া হয়। যুদ্ধ এবং যুদ্ধকালীন সময়ে তার পর্যবেক্ষিত বাস্তবতা গভীর ছাপ ফেলে তার মনে। এসময় প্যারিসে ফিরে স্বাধিকার আন্দোলনের সাথে যুক্ত একটি আন্ডারগ্রাউন্ড গ্রুপে (নাৎসী বিরোধী দল)-র সাথেও নিজেকে যুক্ত করেন তিনি। সেই সাথে চলে লেখালেখিও।

১৯৪৪ সালে প্যারিসে যুদ্বাবসানের সময়কালে তিনি আমেরিকার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করেন যা উচ্চ প্রশংসিত হয় এবং সার্ত্রের সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই পাশ্চাত্য জগতের এ দার্শনিক চিন্তানায়ক হিসেবে সারাবিশ্বে খ্যাতির শীর্ষে ওঠেন। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ল’ ত্রে এত্ল নিয়াত বা ‘বিং এন্ড নাথিং নেস’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৩ সালে।

এরপর তার নিজস্ব দার্শনিক মতবাদ ‘লেস্ শেমিনস্ দ্য লা লিবার্তে’ তিনখণ্ডে প্রকাশিত হয় ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত। সার্ত্রের সমাজতান্ত্রিক মতবাদ ‘ক্রিতিক দ্য লা রেসঁ দিয়া লেক্তিক’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। ১৯৭১ সালে তার আত্মজীবনী ‘ফ্লরেয়ার’ প্রকাশিত হয়।

ব্যক্তিগত জীবনে কোনো সমাজতান্ত্রিক দলের সাথে সরাসরি সম্পর্ক না রাখলেও নানা সময়ে তার লেখনীতে খুঁজে পাওয়া যায় সমাজতান্ত্রিক ধারার প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন। এছাড়াও নিজের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক বিশ্বাস ও স্পষ্ট ভাষণের কারণে নানা সময়ে বহু সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে তাকে। এমনকি আলজেরিয়ায় ফরাসি আগ্রাসন এবং আমেরিকার ভিয়েতনাম যুদ্ধের কট্টর সমালোচক ছিলেন সার্ত্রে, এই কারণে তার ফ্ল্যাটে বোমা ছোঁড়া হয়। বহুবারই পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন সার্ত্রে। এমনকি তাকে হত্যার চেষ্টাও হয়েছে বেশ কয়েকবার।

জ্যঁ পল সার্ত্রেকে তার বহুমুখী সাহিত্য প্রতিভার জন্য ১৯৬৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয় কিন্তু পুরস্কার গ্রহণে তিনি অস্বীকৃতি জানান। তার কারণ, তার মতে ‘একজন লেখকের কখনই নিজেকে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণতি হতে দেওয়া উচিত নয়।’

নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর সার্ত্র মিডিয়া থেকে, হোলেন ডি বেউভোয়ারের গক্সউইলারের বাড়িতে লুকানোর চেষ্টা করেছিলেন।

পাশ্চাত্য দর্শন ধারা, মহাদেশীয় দর্শন, অস্তিত্ববাদ, মহাবিশ্বতত্ত্ব, মার্কসবাদ, নৈরাজ্যবাদ। তাছাড়া তার প্রধান আগ্রহের বিষয় ছিল- অধিবিদ্যা, জ্ঞানতত্ত্ব, নীতিশাস্ত্র, সাহিত্য, রাজনৈতিক দর্শন।

জ্যঁ পল সার্ত্র তার কাজের মাধ্যমে সমাজবিজ্ঞান, সাহিত্যতত্ত্ব, উত্তর উপনিবেশবাদী তত্ত্ব ও সাহিত্য গবেষণায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। ফরাসি লেখিকা সিমন দ্য বোভোয়ারের সাথে সার্ত্রের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তারা পরস্পর বন্ধনহীন প্রেমে আবদ্ধ ছিলেন।

জ্যঁ পল সার্ত্র ফরাসি অস্তিত্ববাদী দার্শনিক, নাট্যকার, সাহিত্যিক এবং সমালোচক। তিনি ছিলেন অস্তিত্ববাদ ও প্রপঞ্চবিজ্ঞানের (সৃষ্টিতত্ত্ব) দর্শনে একজন পথিকৃৎ ও বিংশ শতকের ফরাসি দর্শন ও মার্কীজমের অন্যতম প্রভাবশালী দার্শনিক।


যে লেখাগুলি সার্ত্রেকের বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দেয় তার মধ্যে রয়েছে ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হওয়া সার্ত্রের প্রথম উপন্যাস ‘লা নাজি’, দ্য মুর, ব্যারিওনা (প্রথম নাটক), দ্য ফ্লাইজ, নো এক্সিট, দ্য ভিক্টর’স, দ্য চিপস্ আর ডাউন, ইন দ্য ম্যাস, ডার্টি হ্যান্ডস, ট্রাবলড পি, দ্য ডেভিল অ্যান্ড দ্য গুড লর্ড, কিন, দ্য কনডেমড অব অ্যালটোনা, দ্য ট্রোজান ওম্যান, দ্য ফ্রড সিনারিও প্রভৃতি। মূলত উল্লিখিত এ সবগুলোই ছিল সার্ত্রের লেখা উপন্যাস, নাটক ও ছোটগল্পের তালিকা।

আর এসবের বাইরে দার্শনিক যেসব প্রবন্ধ ও সমালোচনা দিয়ে সার্ত্রে নজর কাড়েন তার মধ্যে রয়েছে: দ্য ট্রানসেন্ডেন্স অব দ্য ইগো, স্কেচ ফর এ থিওরি অব দ্য ইমোশন্স, দ্য ইমেজিনারি, বিয়িং অ্যান্ড নাথিংনেস, এক্সিসটেনসিয়ালিজম ইজ এ হিউম্যানিজম, সার্চ ফর এ মেথড, ক্রিটিক অব ডায়লেকটিক্যাল রিজন, এন্টি সেমাইট অ্যান্ড জিউ, বদলেয়ার, সিচুয়েশন সিরিজ (ওয়ান টু টেন), ব্ল্যাক অরফিউজ, দ্য হেনরি মার্টিন অ্যাফেয়ার প্রভৃতি।

এছাড়া ‘সার্ত্রে বাই হিমসেল্ফ, দ্য ওয়ার্ডস, উইটনেস টু মাই লাইফ কোয়াইট মোমেন্টস ইন এ ওয়ার এবং ওয়ার ডায়েরি’স। সার্ত্রে ও বোভেয়া’র মিলে ‘লেস ভেজপস মোদারনেস’ নামক মাসিক পত্রিকা বের করতেন। এ পত্রিকাটি সে সময় দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করে।

তার উল্লেখযোগ্য অবদান-
Bad faith, “existence precedes essence,” nothingness, “every consciousness is a non-positional consciousness of itself,” situation, Sartrean terminology
(খারাপ বিশ্বাস, “অস্তিত্ব সারমর্মের পূর্বে আছে,” শূন্যতা, “প্রত্যেক চেতনাই নিজের একটি অ-অবস্থানগত চেতনা,” পরিস্তিতি, সার্ত্রিয়ান পরিভাষা)।

তাঁর ভাবগুরু-
Aron, Camus, de Beauvoir, Flaubert, Freud, Hegel, Heidegger, Husserl, Kierkegaard, Kojeve, Mao, Marx, Merleau-Ponty, Nietzsche, Nizan, Rousseau

ভাবশিষ্য-
Raymond Aron, Albert Camus, de Beauvoir, Frantz Fanon, Michel Foucault, Che Guevara, R.D. Laing, Maurice Merleau-Ponty

প্রখ্যাত সাহিত্যিক, দার্শনিক ও মহান চিন্তানায়ক জ্যঁ পল সার্ত্র ফুসফস সংক্রান্ত জটিলতা এবং শারীরিক নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে ১৯৮০ সালের ১৫ এপ্রিল ৭৪ বছর বয়সে প্যারিসে (ফ্রান্সে) মারা যান।

সংকলন ও সম্পাদনায়: সৈয়দ মুহাম্মদ আজম


প্রজন্মনিউজ২৪/এসএমএ

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন





ব্রেকিং নিউজ