উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ রাখতে সচেতনতা জরুরি

প্রকাশিত: ০৯ জুন, ২০২২ ০৫:৩৩:৪৭

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ রাখতে সচেতনতা জরুরি

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব বলছে, উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভুগে থাকেন বিশ্বের প্রায় ১৫০ কোটি মানুষ।  আর এই সমস্যায় সারা বিশ্বে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ প্রতি বছর মারা যায়।

বিশ্বজুড়ে উচ্চ রক্তচাপ একটি নীরব ঘাতক হিসেবে পরিচিত এবং আরও অনেক দেশের মত বাংলাদেশেও বিপুল সংখ্যক মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগে থাকেন।  বাংলাদেশ জনমিতি স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৭-১৮-এর হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক প্রতি পাঁচজনের একজন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। এতে আক্রান্ত ৫১ শতাংশ ও ৬৭ শতাংশই জানে না যে, তাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। এ বিষয়ে গণসচেতনতা তৈরি করতে হবে।

হৃৎপিণ্ডের ধমনীতে রক্ত প্রবাহের চাপ অনেক বেশি থাকলে সেটিকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেশার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।  হার্ট সুস্থ রাখতে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার এবং সুস্থ জীবন-যাপনের অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি।আজকের বিষয় নিয়ে কলাম লিখেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক ও জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ডা.এম এম মাজেদ তার কলামে লিখেন... বাংলা কথা রক্ত চাপ। কিন্তু ইংরেজীটাই পরিচিতি বলে বাংলা বুঝিনা।এই ব্লাড প্রেসার নামক রোগটি আজকাল ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ,করেছে।যে কোন রোগীই ডাক্তার খানায় গিয়ে বলে থাকেন,ডাক্তার সাহেব,আমার প্রেসার টা একটু দেখেন তো।এটির সাধারণতঃশহরের ধনীও বিলাসী ব্যক্তিদের রোগ। খেটে খাওয়া বা দিন মজুর মানুষের এরোগ হয় না। আর হলেওতা উচ্চ রক্ত চাপ হয় না,নিম্ন চাপেই থাকে।এখন বুঝতে হবে এই রক্ত চাপটি কি? উচ্চ রক্তচাপ ইহার ভাবী ফল অত্যন্তন ভয়ানক, আশংকা জনক।

হৃৎপিন্ডের স্পন্দন দ্বারা যে শক্তি চালিত হয় ইহাই উচ্চ রক্তচাপ।ব্লাড প্রেসার অন্য রোগের লক্ষণ মাএ।কোন সময় রক্তচাপ অত্যন্ত বাড়িয়াও যায়,কোন সময় কমিয়া যায়,শির পীড়া,মাথা ঘুরা,বুকে চাপ বোধ,বুক ধড়ফড় করা,মাথা ভার বোধ,শারীরিক পরিশ্রমে অনীহা,শ্বাস কষ্ট,হাঁপানীর মত অবস্থা নিদ্রা কমিয়া যায়,মাঝে মাঝে নাসিকা হইতে রক্ত পড়ে।আরো অনেক লক্ষন আসতের পারে,মাথায় রক্ত উঠিয়া অস্থিরতা,,চিলিক মারা মাথা ব্যথা,চোখ,মুখ লাল তন্দ্রাচ্ছন্নভাব কিংবা সংজ্ঞাহীন অবস্থা হৎপিণ্ড সঙ্কোচ-প্রসারণের ফলে রক্তনালীর মাধ্যমে সারা দেহে রক্ত সঞ্চালিত হয়। রক্তনালীর মাধ্যমে প্রবাহিত হওয়ার সময় রক্ত ধমনীর গায়ে যে চাপ সৃষ্টি করে, তাই ব্লাড প্রেসার বা উচ্চ রক্তচাপ। রক্তচাপের দু’টি মান থাকে সিস্টোলিক এবং ডায়াস্টোলিক।• হৃৎপিণ্ড সঙ্কোচনের সময় ব্লাড প্রেসার বেশি হয়। হৃৎসঙ্কোচনের ফলে ধমনীর গায়ে সৃষ্ট এই রক্তচাপকে ‘সিস্টোলিক’ ব্লাড প্রেসার বলে। অপর পক্ষে,• হৃৎপিণ্ড যখন প্রসারিত হয় তখন ধমনীর গায়ে রক্তের চাপ পড়ে কম। 

হৃৎপ্রসারণকালের এই রক্তচাপকে বলে ‘ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ’।ধরুন চিকিৎসক আপনার ব্লাড প্রেসার মেপে বললেন, আপনার ব্লাড প্রেসার ১১০/৭০ (মি.মি. পারদ)। এখানে বুঝতে হবে আপনার ‘সিস্টোলিক’ ব্লাড প্রেসার ১১০ এবং ডায়াস্টোলিক ব্লাড প্রেসার ৭০।  
> উচ্চ  রক্তচাপ বৃদ্ধির কারণঃ-
১. শতকরা ৫ ভাগ ক্ষেত্রে হাই ব্লাড প্রেসারের কারণ জানা যায়। যেসব হাই ব্লাড প্রেসারের কারণ জানা যায়, তাদের বলা হয় সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন (উচ্চ রক্তচাপ)। এসব কারণের মধ্যে রয়েছে কিডনির অসুখ, এড্রেনাল গ্লান্ডের অসুখ ইত্যাদি।
২. শতকরা ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রে হাই ব্লাড প্রেসারের কারণ জানা যায় না। কারণ না জানা এই উচ্চ রক্তচাপকে বলা হয় এসেনসিয়াল হাইপারটেনশন।
১৯৩০-১৯৪০ সালের দিকে কিছু প্রভাবশালী চিকিৎসক বিশ্বাস ও প্রচার করতেন যে, সরু ও অনমনীয় রক্তনালীর ভেতর দিয়ে রক্ত প্রবাহিত করতে ব্লাড প্রেসার বৃদ্ধি অপরিহার্য, বিশেষত বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে। তারা এটাও বলতেন, এ ব্লাড প্রেসার বৃদ্ধিতে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে না। অনেক সময় পেরিয়েছে, অনেক সমীক্ষা ও গবেষণা হয়েছে; আজ এটা প্রতিষ্ঠিত যে, ব্লাড প্রেসার বৃদ্ধি অপরিহার্য নয় বা তা বয়োবৃদ্ধির অত্যাবশ্যকীয় পরিণতি নয় বরং ব্লাড প্রেসার বৃদ্ধিতে রক্ত সংবহনতন্ত্রের বিভিন্ন জটিলতা এবং মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে। আগের ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে কিন্তু নামটা এখনো রয়ে গেছে- অপরিহার্য উচ্চ রক্তচাপ। এসেনসিয়াল হাইপারটেনশন বা অপরিহার্য উচ্চ রক্তচাপের সঠিক কারণ জানা না গেলেও জানা গেছে, কিছু প্রভাবকের কথা যা উচ্চ ব্লাড প্রেসার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। এগুলোকে বলা হয় ঝুঁকিপূর্ণ প্রভাবক। উল্লেখযোগ্য ঝুঁকিপূর্ণ প্রভাবকগুলো হলো- বংশগত ধারা, বয়স, গোত্র, কম শারীরিক পরিশ্রমযুক্ত জীবনযাত্রা, মানসিক চাপ, ধূমপান, মদ্যপান, মেদবাহুল্য ইত্যাদি।৯০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের কোনো নির্দিষ্ট কারণ জানা যায় না, একে প্রাইমারি বা অ্যাসেনশিয়াল রক্তচাপ বলে। সাধারণত বয়স্ক মানুষের উচ্চ রক্তচাপ বেশি হয়ে থাকে। 

কিছু কিছু বিষয় উচ্চ রক্তচাপের আশঙ্কা বাড়ায়, যা নিম্মে আলোকপাত করা হলোঃ-
* উচ্চ রক্তচাপের বংশগত ধারাবাহিকতা আছে, যদি বাবা-মায়ের উচ্চ রক্তচাপ থাকে, তবে সন্তানেরও এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এমনকি নিকটাত্মীয়ের উচ্চ রক্তচাপ থাকলেও অন্যদের এর ঝুঁকি থাকে।
*  ধূমপান: ধূমপায়ী ব্যক্তির শরীরে তামাকের নানা রকম বিষাক্ত পদার্থের প্রতিক্রিয়ায় উচ্চ রক্তচাপসহ ধমনি, শিরার নানা রকম রোগ ও হৃদ রোগ দেখা দিতে পারে।
* অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ: খাবার লবণে সোডিয়াম থাকে, যা রক্তের জলীয় অংশ বাড়িয়ে দেয়। ফলে রক্তের আয়তন ও চাপ বেড়ে যায়।
* অধিক ওজন ও অলস জীবনযাত্রা: যথেষ্ট পরিমাণে ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রম না করলে শরীরের ওজন বেড়ে যেতে পারে। এতে হৃদ্যন্ত্রে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়। অধিক ওজনসম্পন্ন লোকদের উচ্চ রক্তচাপ হয়ে থাকে।
*  অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাবার, যেমন—মাংস, মাখন ও ডুবো তেলে ভাজা খাবার খেলে ওজন বাড়ে। ডিমের হলুদ অংশ এবং কলিজা, গুর্দা, মগজ এসব খেলে রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে যায়। রক্তে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল হলে রক্তনালির দেয়াল মোটা ও শক্ত হয়ে যায়। ফলে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে।
* ডায়াবেটিস: বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ডায়াবেটিসের রোগীদের উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়। এ ছাড়া তাঁদের অন্ধত্ব ও কিডনির নানা রকম রোগ হতে পারে।
* অতিরিক্ত উৎকণ্ঠা: অতিরিক্ত রাগ, উত্তেজনা, ভীতি এবং মানসিক চাপের কারণেও রক্তচাপ সাময়িকভাবে বেড়ে যেতে পারে। যদি এই মানসিক চাপ অব্যাহত থাকে এবং রোগী ক্রমবর্ধমান মানসিক চাপের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারেন, তবে এই উচ্চ রক্তচাপ স্থায়ী রূপ নিতে পারে।

> কিছু কিছু রোগের কারণে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া গেলে একে বলা হয় সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন। এ কারণগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো:
* কিডনির রোগ।
*  অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি ও পিটুইটারি গ্রন্থির টিউমার।
* ধমনির বংশগত রোগ।
* গর্ভধারণ অবস্থায় একলাম্পসিয়া ও প্রি এ্যাকলাম্পসিয়া হলে।
* অনেক দিন ধরে জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ির ব্যবহার, স্টেরয়েড জাতীয় হরমোন গ্রহণ এবং ব্যথা নিরামক কিছু কিছু ওষুধ খেলে।

> উচ্চ রক্ত চাপের ঝুঁকি কমাতে পরামর্শঃ-
* জীবন যাএার পরিবর্তন এনে
উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। বংশগতভাবে উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তা কমানো সম্ভব নয়। তবে এ রকম ক্ষেত্রে যেসব উপাদান নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেগুলোর ব্যাপারে বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত।
* অতিরিক্ত ওজন কমাতে হবে: খাওয়াদাওয়া নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। একবার লক্ষ্য অনুযায়ী ওজনে পৌঁছালে সীমিত আহার করা উচিত এবং ব্যায়াম অব্যাহত রাখতে হবে। ওষুধ খেয়ে ওজন কমানো বিপজ্জনক। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওজন কমানোর ওষুধ না খাওয়াই ভালো।
* খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্কতা: কম চর্বি ও কম কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে। যেমন—খাসি বা গরুর মাংস, কলিজা, মগজ, গিলা, ডিম কম খেতে হবে। কম তেলে রান্না করা খাবার এবং ননী তোলা দুধ, অসম্পৃক্ত চর্বি যেমন—সয়াবিন, ক্যানোলা, ভুট্টার তেল অথবা সূর্যমুখীর তেল খাওয়া যাবে। বেশি আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ করা ভালো। আটার রুটি এবং সুজি-জাতীয় খাবার পরিমাণমতো খাওয়া ভালো।
* লবণ নিয়ন্ত্রণ: তরকারিতে অতিরিক্ত লবণ পরিহার করতে হবে।
* মদ্যপান: মদ্যপান পরিহার করতে হবে।
* নিয়মিত ব্যায়াম: সকাল-সন্ধ্যা হাঁটাচলা, সম্ভব হলে দৌড়ানো, হালকা ব্যায়াম, লিফটে না চড়ে সিঁড়ি ব্যবহার ইত্যাদি।
* ধূমপান বর্জন: ধূমপান অবশ্যই বর্জনীয়। ধূমপায়ীর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকুন। তামাক পাতা, জর্দা, গুল লাগানো ইত্যাদি পরিহার করতে হবে।
* ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: যাঁদের ডায়াবেটিস আছে, তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
* মানসিক ও শারীরিক চাপ সামলাতে হবে। নিয়মিত বিশ্রাম, সময়মতো ঘুমানো, শরীরকে অতিরিক্ত ক্লান্তি থেকে বিশ্রাম দিতে হবে। নিজের শখের কাজ করা ইত্যাদির মাধ্যমে মানসিক শান্তি বেশি হবে।
* রক্তচাপ নিয়মিত পরীক্ষা: নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে গিয়ে রক্তচাপ পরীক্ষা করানো উচিত। যত আগে উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়ে, তত আগে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং জটিল রোগ বা প্রতিক্রিয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

>  হোমিওপ্রতিকারঃ- রোগ নয় রোগীকে চিকিৎসা করা হয়, এই জন্য রোগীর পুরা লক্ষন মিলিয়ে চিকিৎসা দিতে পারলে তাহলে হোমিওতে উচ্চ রক্ত চাপ রোগীর চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। অভিজ্ঞ হোমিও চিকিৎসক গন উচ্চ রক্ত চাপের জন্য যেসব ঔষধ ব্যবহার করে থাকেন,একোনাইট,এড্রিনালিন,অরামমেট,ক্যাকটাস গ্র্যান্ডি,কেলিফস,নেট্রাম মিউর,ক্যাটে গ্র্যাস,সেফালেন্ড্রা ইন্ডিকা,অর্জুন সহ আরো অনেক মেডিসিন লক্ষনের উপর আসতে পারে। তবে সাবধান চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ঔষধ সেবন করলে রোগ আরো জটিল আকারে পৌছতে পারে।

লেখকঃ ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ  


প্রজম্মনিউজ২৪/ফারহান আহমেদ

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন





ব্রেকিং নিউজ