" বিপর্যস্ত কর্ণফুলী নদীকে  বাঁচাতে  হবে " 

প্রকাশিত: ২৬ মে, ২০২২ ০১:১৪:৪৭

নিজস্ব প্রতিনিধি: কর্ণফুলী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি প্রধান নদী । সুজলা, শস্য -শ্যামলা এবং  পাহাড় বেষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিভাগের  যে খ্যাতি তার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান এই কর্ণফুলী নদীর । এই নদীর বিধৌত পলি বালি ও  কাঁকর প্রবৃত্তির সমন্বয় গড়ে ওঠেছে  চট্টগ্রামের অববাহিকা । চট্টগ্রামের মানুষের জীবনযাত্রায় কর্ণফুলী নদীর  প্রভাব অপরিসীম । শুধু তাই নয় এ নদী আমাদের  দেশের অর্থনীতির প্রাণবায়ু ।  এই নদীর তীরে গড়ে উঠেছে বাণিজ্যিক শহর ও  সমুদ্র  বন্দর সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ  শিল্প স্থাপনা । তাছাড়া এ নদীর পানিকে গতিরোধ করে কাজে লাগিয়ে কাপ্তাই উপজেলায় উৎপন্ন করা হচ্ছে জলবিদ্যুৎ  ।

এদেশের মৎস্য সম্পদের একসময় অন্যতম প্রধান উৎস ছিল এই নদী।  হাজার-হাজার মানুষ এই নদীকে ঘিরে সারাবছর বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে । এমনকি এই নদী   আমাদের  বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে  বড় এক অংশজুড়ে রয়েছে । এছাড়া জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই নদীর সৌন্দর্য ও নাব্যতা দেখে  মুগ্ধ হয়ে তার কর্ণফূলী কাব্য গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন এই নদী তীরে বসে । সর্বোপরি বলতে গেলে কর্ণফুলী বাংলাদেশের অর্থনীতি , মানুষের জীবনযাত্রায় এবং   সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে  এই  নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। 

চট্টগ্রাম শহরের কোলঘেষা কর্ণফুলী নদী বর্তমানে মারাত্মক দূষণের শিকার ।  শহরের ময়লা-আবর্জনা,  শিল্প কারখানার বর্জ্য, গৃহস্থতলির আবর্জনা ও হাজার হাজর টন পলিথিন ইত্যাদি প্রতিনিয়ত এই নদীকে  বিষাক্ত বর্জ্যের বহমান আঁধারে পরিণত করে চলছে । প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার টন বর্জ্য পদার্থ পতিত হচ্ছে কর্ণফুলী নদীতে । পাশাপাশি রয়েছে শিল্প-কারখানা ও চিকিৎসালয়ের রাসায়নিক  বর্জ্য ।  এছাড়াও অসংখ্য  নৌযানের পোড়া তেলের প্রভাবে  বর্তমানে কর্ণফুলী নদীর  দূষণ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে । তাছাড়া  জনগণের সচেতনতার অভাবে কর্ণফূলী নদীর তলদেশে পলিথিনের  স্তর পর্যন্ত  পড়েছে।    আর তার উপর রয়েছে নদীর তীরে অবৈধ স্থাপনা তৈরি করে  নদী ভরাট এর মতো জঘন্য কাজ  ।
  
গত বছরে চট্টগ্রামের নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন নামের  একটি অরাজনৈতিক  সংগঠনের জরিপে দেখা যায় ,  ২০১৪ সালে শাহ আমানত  সেতুর নিচে কর্ণফুলী নদীর প্রবাহমান ছিল প্রায়  ৮৬৭ মিটার ।  এখন তা সংকুচিত হয়ে  ভাটার সময়  প্রায় ৪১০ এবং  জোয়ারের সময় প্রায়  ৫১০  মিটারে এসে দাঁড়িয়েছে  । এই জরিপে আরও বলা হয় ২০১৬  সালের দিকে এই নদীর তীর ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে বেশ সংখ্যক   মাছ বাজার,  বরফ ফ্যাক্টরি,  অবৈধ বসতি স্থাপন ও ভেড়া মার্কেট । ফলশ্রুতিতে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে  নদীর প্রবাহমান ব্যাপক হারে হ্রাস পায় । একইসাথে এই কর্ণফূলীর অসংখ্য শাখা নদী মৃত্যুকূপে ধাবিত  হয়ে পড়ে ।

এছাড়াও বর্তমানে এই নদীর তীরে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এমনকি ব্যক্তিগতভাবে অবৈধ  দখলের  মহোৎসব চলছে  ।  নদীর তীব্র দূষণ ও দখলের কারণে সম্প্রতি অসংখ্য নদী ও মৎস্য গবেষকের  গবেষণায় উঠে এসেছে প্রায় ৩০ প্রজাতির মাছ এই নদী  থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে এবং অসংখ্য জলজ  সম্পদ বিপন্ন হওয়ার পথে । প্রকৃতপক্ষে  তীব্রতর দূষণের  কারণে এই নদী   নাব্যতা হারিয়েছে  এবং অবৈধ দখলের কারণে বর্তমানে এই নদী চরম  বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে । 

কর্ণফুলী নদী দেশের অর্থনীতির প্রাণবায়ু । কিন্ত এ নদী বর্তমানে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায়, দেশের অর্থনীতি,   স্বাস্থ্যখাত,  জলজ সম্পদ ও মৎস্যখাতসহ  বিভিন্ন খাতে  ক্ষতির সম্মুখীন দেশবাসী । এমনকি ইতিমধ্যে  নদী গবেষকরা বলেছেন  এই নদীর দূষণের কারণে দেশের জীববৈচিত্র্য  চরম হুমকি সম্মুখীন   । ফলে  এই  নদীকে বাঁচানোর লক্ষ্যে   সরকার ও বাংলাদেশ  নদী রক্ষা কমিশন মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল ।  ক্র্যাশ প্রোগ্রাম,  স্বল্প মেয়াদী,  মধ্যমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী অ্যাকশন রেখে সাজানো হয়েছে ১০ বছরের সেই মহাপরিকল্পনাটি । এতে ৪৫ টি মূল কার্যক্রম এবং ১৬৭ টি সহযোগী কার্যক্রম করা হয়েছিল । কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়  সরকারের গৃহীত  সেই  মহাপরিকল্পনাটি আজও কর্ণফূলী নদীর সংরক্ষণে সুষ্ঠুভাবে  ও ব্যাপক পরিসরে  বাস্তবায়িত হয়নি । একইসাথে হাইকোর্টের বিশেষ   নির্দেশনা  থাকার সত্ত্বেও এই নদীর তীরে অবৈধ দখলদারত্বের আজও সম্পন্ন  অবসান ঘটেনি। 

কর্ণফুলী নদী বাণিজ্যিক শহর চট্টগ্রাম প্রাণ।  তাই এই নদীর সুরক্ষা এবং  রক্ষণাবেক্ষণ একান্ত  প্রয়োজন ।  কেননা নদী বিপর্যস্ত হলে বিপর্যস্ত হবে দেশের অর্থনৈতিক জলজ সম্পদ এবং  স্বাস্থ্যখাত সহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ খাত সমূহ । আর এই নিষ্ঠুর প্রভাব পড়বে এদেশের মানুষের উপর ।  তাই এই নদীকে সুরক্ষা রাখতে  সর্বপ্রথম  ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে । পাশাপাশি  সরকার এবং  নদী কমিশনের গৃহীত  মহাপরিকল্পনাগুলো জেলা প্রসাশন এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে দলমত নির্বিশেষে  দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।

একইসাথে পরিবেশ অধিদপ্তরকেও এই নদীর সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে  এগিয়ে আসতে হবে ।  যাতে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের  প্রাণ এবং দেশের অর্থনীতি প্রাণবায়ু ,  কর্ণফুলী নদীর দূষণ ও অবৈধ স্থাপনা রোধ হয়  এবং  নদীর নাব্যতা পৃর্ব অবস্থায় ফিরে  আসে । 

শিক্ষার্থী, 
সরকারি হাজি মুহাম্মদ মহসিন কলেজ চট্টগ্রাম


প্রজন্মনিউজ২৪/রেদওয়ান

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ