`নেটওয়ার্কের বাইরে' আস্ত একটি গ্রাম, দূর্ভোগে জনজীবন

প্রকাশিত: ২৩ মে, ২০২২ ০৯:৫৪:০০ || পরিবর্তিত: ২৩ মে, ২০২২ ০৯:৫৪:০০

`নেটওয়ার্কের বাইরে' আস্ত একটি গ্রাম, দূর্ভোগে জনজীবন

আজিজুর রহমান, জুড়ীঃ বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে যখন বাংলাদেশ ডিজিটালাইজেশনের যুগে স্বদর্পে পদার্পণ করছে ঠিক তখনই “নেটওয়ার্কের বাইরে” অবস্থান করছে হাজার হাজার মানুষ। অদৃশ্য জাল বা নেটওয়ার্কে জড়িয়ে গোটা বিশ্ব হাতের মুঠোয় কিংবা গ্লোবাল ভিলেজে রূপ লাভ করলেও এই গ্লোবালাইজেশনে যুক্ত হতে পারেনি গোয়ালবাড়ির মানুষেরা।

বলছি বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বের জেলা মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার কথা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতের পরশে আলোকিত হয়েছে গোটা বাংলাদেশ, ডিজিটাল পরিসেবার আওয়াভুক্তও হয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু এত এত ডিজিটাল নেটওয়ার্কিংয়ের সময়েও পিছিয়ে রয়েছে জুড়ী উপজেলার গোয়ালবাড়ি ইউনিয়নের লাঠিটিলা, ডোমাবাড়ী, লঙ্গর খানা, নালাপুঞ্জি, লালছড়া, রুপাছড়া-সহ কয়েকটি গ্রামের ১০-১৫ হাজার মানুষ। প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশের ডিজিটাল পরিসেবা থেকে বঞ্চিত এ অঞ্চলের মানুষেরা। জরুরি প্রয়োজনে মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় নিয়মিত বিড়ম্বনায় পড়েছেন তারা।

করোনা মহামারীতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনলাইনে ক্লাস করতে চাইলেও পারেনি এখানকার শিক্ষার্থীরা। মোবাইল নেটওয়ার্ক পরিসেবা অত্যন্ত নিম্নমানের হওয়ায় অনলাইন ক্লাসে যুক্ত হওয়াই ছিল শিক্ষার্থীদের জন্য এক যুদ্ধ। যদিও কোনোক্রমে অনলাইন ক্লাসে যুক্ত হতে পারলেও সেই সংযুক্তি ছিল আরেক ধরণের যন্ত্রণার। কথা শোনা গেলেও ভিডিও দেখা যেত না, আবার ভিডিও দেখা গেলেও শোনা যেত না অডিও....।
 
অভিভাবকদের দাবি, তাদের সন্তান যেন অন্তত জরুরি নেটওয়ার্কের এই সুবিধাটি পায়। এছাড়া কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও নেই মোবাইল নেটওয়ার্কের সুবিধা। সারা বাংলাদেশের মানুষ যেখানে ঘরে বসে ডিজিটাল সুবিধা পাচ্ছে, সেখানে আমাদের ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ জনগণএই সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

শিক্ষার্থী কিবরিয়া আহমদ বলেন, ইন্টারনেটভুক্ত যেসকল ডিজিটাল সুযোগ-সুবিধা আছে তা আমরা পাচ্ছি না। আমাদের নেটওয়ার্কের অসুবিধার কথা বিবেচনা করে একটি মোবাইল টাওয়ারের সুব্যবস্থা করে দিলে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম উপকৃত হবো। পাশাপাশি আমাদের এলাকার প্রবাসীদেরও সুবিধা হবে।

স্থানীয়রা বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের যেমন প্রয়োজন তেমনি ডিজিটাল যুগে নেটওয়ার্কেরও প্রয়োজন। কেননা বর্তমান সময়ে নেটওয়ার্কহীন অবস্থান দিনযাপন করা অসম্ভব প্রায়। নেটওয়ার্কের বাইরে বসবাস করা মানে নিজেকে আদিম যুগের মানুষের শামিল করা এক জিনিস। নেটওয়ার্ক দূর্ভোগের কারণে একাধিক বার জুড়ী উপজেলার জনপ্রতিনিধিদের কাছে লিখিত অভিযোগ করলেও মিলেনি কোন সাড়া। এমনকি বন পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী শাহাব উদ্দিনের বরাবর লিখিত চিঠি দিলে উনার সুপারিশে বিটিআরসি বরাবর চিঠি পৌছালেও কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা নেয়নি।

নিম্নমানের নেটওয়ার্ক সার্ভিসের কারণে যেমন শিক্ষার্থীসহ স্থানীয় বাসিন্দারা পড়েছে বিড়ম্বনায় তেমনি বিড়ম্বনায় পড়েছেন প্রবাসীরা। নেটওয়ার্কের শক্ত পরিসেবা না থাকায় পরিবারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ বিঘ্ন হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তারা। মালয়েশিয়া প্রবাসী মুহাম্মদ ফয়জুর রহমান বলেন, দেশে আমার পরিবার রেখে আমি প্রবাসে জীবনযাপন করছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় মাসে একবার হলেও ফোনে কথা বলতে পারছি না। আমরা রেমিট্যান্স যোদ্ধারা দেশের জন্য, নিজের পরিবারের জন্য বিদেশের মাটিতে অবর্ণনীয় কষ্ট করতেছি তবুও আজ আমরা নেটওয়ার্কের এই বিশেষ সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

তিনি বলেন, প্রবাস থেকে দেশে নিজের পরিবারের সাথে আমার বাড়িতে সরাসরি কল দিয়ে কথা বলতে পারছি না। ইমো-হোয়াটসঅ্যাপে'র মাধ্যমে সরাসরি কথা বলাটা অনেক এখন স্বপ্ন। দূর প্রবাসে থেকে সরাসরি না হলেও প্রযুক্তিযোগ পরিবারের মুখগুলো দেখতে মন চায় কিন্ত সে সুযোগ কই? প্রযুক্তির এই সুবিধা যেন আমাদের গ্রামবাসী পায়, আমরা প্রবাসীরা যেন পাই, আমরা যেন প্রবাসে থেকে অন্তত পরিবারের সাথে একটু কথা বলতে পারি এই ব্যবস্থা করার জন্য সরকার ও বেসরকারী নেটওয়ার্ক কোম্পানিগুলোর কাছে আমরা প্রবাসীরা অনুরোধ জানাচ্ছি।

মালয়েশিয়া প্রবাসীদের নিয়ে তৈরী সংগঠন প্রবাসী কল্যাণ এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান বলেন, আমরা কি শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশের জনগণ নই? আমরা নেটওয়ার্ক সমস্যার সমাধান চাই! কেন আমরা নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন থাকব? বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে  ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সরকার যখন কাজ করছে, ঠিক তখনি ডিজিটাল বাংলাদেশের সেবা থেকে বঞ্চিত আমরা! এলাকাগুলোতে নূন্যতম 2G নেটওয়ার্ক পর্যন্তও নেই। দেশের উন্নয়ন দিয়ে কি করবো আমরা যদি সামাজিক যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকি।
 
স্থানীয় বাসিন্দা জুবায়ের আহমেদ বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। সেখানে নেটওয়ার্কের মতো একটা প্রযুক্তি সেবা আমাদের এলাকায় নেই! এটা অত্যন্ত দূঃখজনক বিষয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা চাইলেই এর সমাধান করতে পারেন। সারা দেশব্যাপী যখন করোনা মহামারি ছিল তখন দেশের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীরা ভার্চুয়াল পাঠদানে অংশগ্রহণ করে কিন্তু আমাদের এলাকার প্রায় পাঁচ শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল। আমরা দ্রুত এর সমাধান চাই।

কাঁচামাল ব্যবসায়ী মকবুল মিয়া বলেন, আমাদের এ এলাকায় কমলা, কাঁঠাল, সাতকড়া, জাম্বুরা,আদালেবু -সহ বিভিন্ন ধরনের মৌসুমী ফসল হয়। কিন্তু নেটওয়ার্কের জন্য সময় মত দূর দূরান্তের ব্যবসায়ীদের সাথে যোগাযোগ করতে না পারায় এখানকার ফসলের সঠিক মূল্য পাই না।

কৃষক উন্নয়ন সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন  বলেন, আমরা আমাদের এলাকার চাহিদা পূরণ করে প্রতিবছরে প্রায় ৩০ লক্ষ জাম্বুরা,  ৫০ লক্ষ কমলা, ২৫ লক্ষ কাঁঠাল ও ৫ লক্ষ ছড়া কলাসহ অনেক রকমের ফসল রাজধানী ঢাকা, চিটাগাংসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠাই। তবে উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়া পেলে আমরা এটাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবো। আমরা যেন ডিজিটাল প্রযুক্তি নেটওয়ার্কের এই সুবিধা পাই।

এ বিষয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমার নির্বাচনীএলাকা ৩নং ওয়ার্ডের মূল সমস্যা হচ্ছে নেটওয়ার্ক। এখানে জরুরি প্রয়োজনে কোন যোগাযোগ করা সম্ভব হয় না। এই দূর্ভোগ থেকে মুক্তির জন্য জরুরি প্রয়োজন মোবাইল নেটওয়ার্কের। এখানে বিদ্যুৎ আছে এবং যোগাযোগের ব্যবস্থাও ভালো। তাহলে কি জন্য নেটওয়ার্ক সমস্যার সমাধান হয়না?

তিনি আরও বলেন, আমরা এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান চাই। প্রয়োজন হলে আমি নিজে টাওয়ারের জায়গা দেব। তবুও এই ওয়ার্ডের মানুষ ডিজিটাল বাংলাদেশের ছোঁয়া পাক।

গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল কাইয়ূম বলেন, আমার  এই ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ৩নং ওয়ার্ডের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর প্রধান সমস্যা মোবাইল নেটওয়ার্ক। তারা নেটওয়ার্ক সমস্যার সমাধান চায়। এখানে অনেক প্রবাসী পরিবারের দাবি মাসে একবার হলেও তাদের ছেলে সন্তান ও পরিবারের সদস্যের সাথে কথা বলার সুযোগ পায় তারা।

তিনি বলেন, সিলেট বিখ্যাত সবুজ কমলার আবাদ হয় এই এলাকায়। এই সবুজ কমলা সারাদেশ জুড়ে পরিচিত। তাছাড়া জাম্বুরা, সাসনি লেবু, কাগজি লেবু, সাতকড়াসহ নানা রকম নিত্যনতুন ফসলের আবাদ হয় এখানে। কৃষি খাতে তারা অনেক এগিয়ে থাকলেও বর্তমান প্রযুক্তির কাছে তারা অন্ধকার। প্রতি বছর কৃষি খাতে সরকার কোটি টাকা রাজস্ব পায়। তাহলে কেন তারা ডিজিটাল এই ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত থাকবে। এই সমস্যা দ্রুত সমাধান হোক।

উন্নয়নশীল ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত সকল সুযোগ-সুবিধা লাভ এ অঞ্চলের গণমানুষের এখন প্রাণের দাবি।


প্রজন্মনিউজ২৪/এসএমএ

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ














ব্রেকিং নিউজ