দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জনজীবনে দূর্ভোগ ।

প্রকাশিত: ০৯ এপ্রিল, ২০২২ ১০:২৭:০৯

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জনজীবনে দূর্ভোগ ।

দিনাজপুর প্রতিনিধি: দুই মাস পরিবারের কারো মুখে মাছ-গোশত তুলে দিতে পারি নাই, দাম বেশি। তিন'শ টাকা হাজিরা দিয়া কি মাছ-গোশত খাওয়া যায়?' দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত বৃদ্ধিতে এভাবেই নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন অনিল মহন্ত নামে খানসামা উপজেলার এক দিনমজুর। আয়েশা বেগম (৫৫) নামের আরেক পৌঢ়া দেড় মাস নাতি-নাতনীদের নিয়ে মাছ-মাংস খেতে না পেরে বলেন, “মোর বেটা দিনত যা ইনকাম করে তা দিয়া সংসারের খরচই ঠিক মতোন হয়না। মাছ-গোস্ত ফির কুনঠে থাকি কিনিবে! ছাওয়াগিলার বইপড়ার খরচও দিবার নাগে।" দ্রব্যমূল্য” বৃদ্ধির যাঁতাকলে নিম্ন আয়ের মানুষের পাশাপাশি পিষ্ট হচ্ছেন মেস বা হোস্টেলে থাকা শিক্ষার্থীরাও।

দিনাজপুর সরকারি কলেজের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী আবু হানিফ বলেন, কলেজের হলে আবাসন ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না হওয়ায় আমরা অধিকাংশ শিক্ষার্থীই বাইরে বিভিন্ন মেসে থাকি। আমার মত অধিকাংশ শিক্ষার্থীরাই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের। কিন্তু হঠাৎ করে দ্রবমূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধিতে আমরা একেবারে নাজেহাল হয়ে পড়েছি। আগের তুলনায় বর্তমানে প্রতিমাসে আরও এক থেকে দেড় হাজার টাকা বেশি লাগছে। যা পরিবার থেকে দেওয়া অনেকের জন্যই বেশ কষ্টকর।

রিয়াজুল কবির নামের আরেক শিক্ষার্থী  জানান আগে আমাদের মিলরেট (দৈনিক খাবার খরচ) ২২ থেকে ২৫ টাকা ছিল। রমজান শুরু হলে ৩০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয় কিন্তু এবারের অস্বাভাবিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে মিলরেট ৪৫ থেকে ৫০ টাকা করে আসছে। আমরা মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান, এই অতিরিক্ত খরচের টাকা কথা থেকে পাবো? জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় টিউশনিও পাওয়া যাচ্ছে না।'

রায়হান কবির নামে এক চাকরিজীবি বলেন, তেল গ্যাস থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম শুধু বাড়ছে আর বাড়ছে। সাধারণ মানুষ অসাধারণ হতে পারছে না বলে তাদের কষ্টের সীমা নেই। নুন আনতে পান্তা ফুরায় - প্রবাদটি আজ চরম সত্য হয়ে ঘাড়ে বসেছে।

এদিকে মাছের দাম বেশি হওয়ায় ক্রেতা হারিয়েছে ব্যবসায়ীরা। খানসামা উপজেলার কাচিনিয়া বাজারের মৎস্য ব্যবসায়ী শ্রী শংকর দাস বলেন, বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতার সংখ্যাও অনেক কমেছে। আবার মাছের দামও বেশি হওয়ায় রোজার আগের মতো ব্যবসা হচ্ছে না। আরেক ব্যবসায়ী রমনাত দাস জানান, আগে দিনে এক-দেড়'শ ক্রেতা পেতাম আর এখন কোনোরকম ৫০ জন ক্রেতা পাই। আড়তে মাছের দাম বেশি হওয়ায় আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। দাম বেশির কারণে রমজান হওয়া সত্ত্বেও ক্রেতা নাই।

শুক্রবার জেলার বিভিন্ন বাজারে সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, আলু, পটল, টমেটো, শসা, বেগুন, কুমড়া ইত্যাদি সবজির দাম  থাকলেও স্থির নেই মাছ-মাংসের দাম। সাধারণ মানুষের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসেব মিলছে না। নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষ হতাশ হয়ে পড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে ক্ষোভ। হতাশায় নিমজ্জিত খেটে খাওয়া মানুষের পাশাপাশি মধ্যবিত্তরাও।

কৃষি নির্ভর জেলা হওয়ায় এখানকার প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। কৃষি পণ্য উৎপাদন করে বাজারে সরবরাহ করে ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না চাষিরা। চাষাবাদে যে পরিমাণ খরচ মেটাতে হয় তার কিয়দাংশ দাম পেলেও ঘাটতি থাকে অনেক। ফলে উপার্জন প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। এই অবস্থায় দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়েছে অনেকের।

নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধি গরীব, নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষসহ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবনকে রীতিমত দুর্বিসহ করে তুলছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারেও আজ নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর দশা।

কথা হয় আগ্রা ভূত্যপাড়ার চাষি অনিল চন্দ্রের সাথে। তিনি জানান, দেড় বিঘা জমিতে রশুন আবাদ করতে খরচ হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার টাকা। বাজারে রশুনের কেজি ৮ টাকা সেই হিসেবে ৩০ হাজার টাকা পাবো। এতে ১০ হাজার টাকা ঘাটতি। জিনিসপত্রের দাম বেশি তারওপর আবাদে লস এতে শুধু সংসার চালানোই কষ্টকর না টিকে থাকাই মুশকিল।

দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতির ফলে দৈনিক জীবনে নেমে এসেছে অপ্রত্যাশিত দূর্ভোগ। এর কারণ হিসেবে অনেকে মজুতদারদের সিন্ডিকেটের কথা বলেছেন, জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির পেছনে দায়ী কিছু মুনাফালোভী অসাধু মজুতদাররা। তারা অধিক পরিমাণ মুনাফা লাভের আশায় দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়িয়ে দেয়৷ এই সিন্ডিকেট চক্রকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার দাবি ভুক্তভোগীদের।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উৎপাদনের উৎস থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত অনেক স্তর রয়েছে। উৎপাদনকারী ন্যায্য মূল পাচ্ছে না। অথচ ভোক্তাকে অনেক বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এর মধ্যে মধ্যসত্বভোগী একটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। এছাড়া বিপনন ব্যবস্থা দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্থ থাকায় সাধারণ মানুষ কষ্ট ভোগ করছে। পুরো বিপনন ব্যবস্থার মধ্যে যে অব্যবস্থা রয়েছে তা সরকারকে দূর করতে হবে।


প্রজন্মনিউজ২৪/রেদওয়ান

পাঠকের মন্তব্য (০)

লগইন করুন



আরো সংবাদ